সংক্ষিপ্ত
- নওশাদ তাঁর কাজে অন্য কারও হস্তক্ষেপ বরদাস্ত করতেন না
- একটি গানের কথা ওই সুরকারের হাতে পৌঁছানো
- সুর তৈরি হয়ে শিল্পীকে দিয়ে রিহার্শাল করিয়ে রেকর্ডিং স্টুডিওতে পৌঁছতেন তিনি
- এত সময় নিতেন যে বছরে খুব বেশি হলে তিনি দুটি ছবির কাজ করতে পারতেন
তপন মল্লিক, কলকাতা
রিমিক্সের জমানাতেও নওশাদ বছরে এক কোটি টাকা রয়্যালটি তুলেছিলেন। একটি গান রেকর্ডিঙের আগে সেই গানটির সুরকার গানটির জন্য নির্বাচিত সঙ্গীত শিল্পিকে দিয়ে কতবার রিহার্সাল করান? ১৯৪৯ সালে বোম্বাইয়ে দিলীপ কুমার, রাজ কাপুর, নার্গিশ অভিনীত মেহবুব খান পরিচালিত ছবি ‘আন্দাজ’-এর জন্য মজরু সুলতানপুরির লেখা ‘তু কাহে অগর’ গানটি মুকেশকে দিয়ে রেকর্ডিং করানোর আগে সুরকার তেইশ দিন রিহার্শাল করিয়েছিলেন। রিহার্শাল হত সুরকারের বাড়িতে, আর তার জন্য মুকেশকে প্রতিদিন লম্বা পথ পেরিয়ে সেই সুরকারের বাড়িতে পৌঁছতে হত। রেকর্ডিং ওকে হয়ে যাওয়ার পরও যে শিল্পী স্বস্তি পেয়েছেন, তেমনটা নয়। ১৯৫৪ সালে দিলীপ কুমার, মধুবালা, নিম্মী অভিনীত মেহবুব খান পরিচালিত ছবিতে সুর করেছিলেন ওই একই সুরকার। শাকিল বদাউনি-র লেখা ‘তেরে সদকে বালম না কর কোই গম ইয়ে’ গানটি গেয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর। লতা ওই গানটির রেকর্ডিং নিয়ে জানান, রেকর্ডিং ওকে হয়ে যাওয়ার পর সুরকার তাঁকে বাইরে যেতে বলেন। এরপর সুরকার নিজে স্টুডিওর দরজা বন্ধ করে একাধিক বার গানটি শোনেন। কোথাও কিছু খামতি থেকে গেল কিনা। কিছুক্ষণ পর সুরকার বেরিয়ে এসে বললেন ‘ইয়ে’ কথাটির সুরের মুড়কিটা সঠিক হয়নি।তএব ফের রেকর্ডিং। একের পর এক টেক চলছে কিন্তু সুরকারের মন মতো হচ্ছে না। এক সময় লতা শারীরিক ভাবে এতটাই বিধ্বস্ত হলেন যে রেকর্ডিং করতে করতে তিনি স্টুডিওর মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর আবার রেকর্ডিং। তারপর অবশ্য লতা সেই সুরকারকে খুশি করতে পেরেছিলেন।
একটি গানের কথা ওই সুরকারের হাতে পৌঁছানো থেকে সুর তৈরি হয়ে শিল্পীকে দিয়ে রিহার্শাল করিয়ে রেকর্ডিং স্টুডিওতে পৌছতে তিনি এত সময় নিতেন যে বছরে খুব বেশি হলে তিনি দুটি ছবির কাজ করতে পারতেন। সেখানে অন্য সুরকাররা বছরে আধ ডজন ছবির কাজ করে ফেলতেন। এতটা সময় লাগার কারন, তিনি যতক্ষণ না মনে করতেন গানটি সঠিক মানে পৌঁছেছে ততক্ষণ তিনি চেষ্টা চালিয়ে যেতেন। কিন্তু তেমন পরিচালকেরা আবার ওঁর জন্যই অপেক্ষা করে থাকতেন। এই সুরের জাদুকর মানুষটি তাঁর সঙ্গীত জীবনে মাত্র ৬৭টি ছবিতে সংগীত পরিচালনা করেছেন। অবশ্য তার মধ্যে ২৫টি রজতজয়ন্তী, ৯টি সুবর্ণজয়ন্তী এবং ২টি হীরকজয়ন্তীর গৌরব অর্জন করে।
সেই সময় এসএম শ্রীরামুলু নাইডু দিলীপ কুমার আর মীনা কুমারীকে নিয়ে বোম্বাইয়ে ‘আজাদ’ ছবিটি তৈরি করছিলেন। অন্যদিকে একই সময় মাদ্রাজে ছবিটির তামিল ভার্সান তৈরি হচ্ছিল। ছবির প্রযোজক চাইছিলেন তাঁর এই ছবির গানে সুর করুন আলোচিত এই সুরকার। প্রযোজক সুরকারকে অনুরোধ করলেন তিনি যেন কুড়ি দিনের মধ্যে গানগুলির সুর করে দেন, বিনিময়ে তিনি তাঁকে এক লক্ষ টাকা পারিশ্রমিক দেবেন। সুরকার ওই প্রযোজককে প্রায় তাড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, তাঁর একটি গানের সুর করতেই কম করে কুড়ি দিন লেগে যাবে। শেষ পর্যন্ত ‘আজাদ’ ছবির সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে কাজ করেন সি রামচন্দ্র।
বোম্বাইয়ের সিনেমা জগতের আলোচিত এই সুরকার তখন ‘মুঘল-ই-আজম’ ছবিতে কাজ করছেন। ওই ছবিতে তানসেন চরিত্রের লিপে দুটি গানের জন্য তিনি নির্বাচিত করলেন পাটিয়ালা ঘরানার প্রবাদপুরুষ সঙ্গীত শিল্পী ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খানকে। ওস্তাদ সিনেমার গান শুনে স্বভাবতই পিছিয়ে গিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত সুরকার নওশাদের অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারলেন না। তবে মাত্র দুটি গানের জন্য তিনি যে টাকা পারিশ্রমিক চেয়েছিলেন তা সেদিনের পক্ষে অবিশ্বাস্য। ওদিকে তানসেনের লিপে শকিল বাদাউনির লেখা ‘শুভ দিন আয়ো রাজ দুলারা’ ও ‘প্রেম জোগান বন কে’ এই দুটি গানের জন্য নওশাদের তাঁকেই চাই। ছবির প্রযোজক ও পরিচালক কে আসিফ নওশাদের সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। সেই সময় বোম্বাইয়ে সিনেমার গানে সর্বাধিক পারিশ্রমিকের শিল্পী লতা মঙ্গেশকর পেতেন পাঁচশো টাকা। আর গুলাম আলি নিয়েছিলেন পঁচিশ হাজার টাকা।
নওশাদ তাঁর কাজে অন্য কারও হস্তক্ষেপ বরদাস্ত করতেন না। আজকের মতো কোনও প্রযোজক বা পরিচালক নওশাদকে দিয়ে ফরমায়েশি গান প্ররোচিত করতে সাহস পেতেন না। ‘মাদার ইন্ডিয়া’, ‘আন্দাজ’, ‘আন’, ‘অমর’, ‘আওরত’ প্রভৃতি বিখ্যাত ছবির সিনেমা পরিচালক মেহবুব খান একবার তার একটি ছবির মিউজিক স্কোরিঙের সময় নওশাদকে কিছু পরামর্শ দিচ্ছিলেন। পরের দিন নওশাদ মেহবুবের শুটিং ফ্লোরে গিয়ে ক্যামেরায় চোখ রেখে আলো, চরিত্রদের অবস্থান ইত্যাদি নিয়ে কথা বলতে থাকেন। মেহবুব নওশাদকে জিঙ্গেস করেন, ‘আপনি এখানে কি করছেন?’ নওশাদ জানান, ‘আপনি কাল যা করছিলেন, টাইম পাশ’। এমন বহু গল্প শোনা যায় স্বাধীনচেতা সঙ্গীতকার নওশাদ সম্পর্কে। আবার ‘রতন’ ছবিতে একটি গানে সফলভাবে ইকো ব্যবহার করেছিলেন ফাঁকা বন্ধ ঘরে রেকর্ডিং করে। ‘আন’ ছবির একটি গানে সিম্ফনি অক্রেষ্ট্রার মেজাজ তৈরি করতে যেমন ১০৬ জন বাদ্যযন্ত্রী ব্যবহার করেছিলেন তেমনি ‘উড়ন খটোলা’ ছবির’ মোরে সইয়া জি উতরেঙ্গে পার হো নদীয়া’ গানটিতে যন্ত্রানুষঙ্গের পরিবর্তে ব্যবহার করেছিলেন ১০০ কন্ঠের কোরাস। কয়েক বছর আগেও বছরে কোটি টাকার রয়্যালটি জমা হত তাঁর নামে।