সংক্ষিপ্ত
- বাবার কারখানা বন্ধ, ঘরেতে টনটনে অভাব
- তবু পোট্রেট এঁকে টাকা তুলছেন যুবক ছেলে
- আর্ট কলেজের এই প্রাক্তনী এখনও পর্যন্ত তুলেছেন দশ-বারো হাজার টাকা
- সেই টাকায় হুগলির গোন্দলপাড়ার শ্রমিকদের জন্য় কেনা হয়েছে চালডাল
শ্রমিক পরিবারে জন্ম আর আর্ট কলেজে পড়াশোনা। স্কুলবেলায় বাবার কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বড়বেলাতেও একাধিকবার বন্ধ হয়েছে বাবার কারখানা। অতএব টনটনে অভাব আর অর্ধাহারের সঙ্গে পরিচিতি একেবারে ছোট্ট বয়স থেকেই। তাই এই ঘোর লকডাউনের সময়ে, হুগলি শিল্পাঞ্চলে দু-বছর ধরে বন্ধ থাকা গোন্দলপাড়ার চটকল শ্রমিকদের দুর্দশা কেমন হতে পারে আর সেই পরিস্থিতিতে কী করা যেতে পারে, তা বুঝবার জন্য় 'কী করিতে হইবে' পড়ার দরকার পড়েনি শেওড়াফুলির শুভঙ্কর সিনহা রায়কে। স্রেফ রং-তুলি সঙ্গে করে আর 'দুশো টাকা'র বাজি ধরে বছর পঁচিশের এই যুবক একেবারে মাঠে নেমে পড়লেন গোন্দলপাড়ার শ্রমিক বস্তির জন্য়। অবশ্য়ই নিঃশব্দে।
কীভাবে?
পোট্রেট আঁকিয়ে হিসেবে একসময়ে কম সুনাম ছিল না শুভঙ্করের। সে এক সময় ছিল, যখন কলকাতা বইমেলার মাঠে বসে দেদারসে এঁকে গিয়েছেন পোট্রেট। যদিও মাঝখানে কিছুদিন সেভাবে পোর্টেট আঁকেননি ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজের এই প্রাক্তনী। কিন্তু তাতে কী, 'ছেড়েছো তো অনেক কিছু পুরোনো অভ্য়েস'। আবার নতুন করে পোট্রেট ধরলেন শুভঙ্কর। বন্ধু-বান্ধবদের কাছে ফেসবুকে অনুরোধ করলেন, "তোমরা আমাকে তোমাদের একটা ছবি দাও, আমি ওই ছবি দেখে পোট্রেট এঁকে দেবো। আর তার বদলে তোমরা অনলাইনে দুশো টাকা পাঠিয়ে দিও আমাকে। ওই টাকা আমি খরচ করবো গোন্দলপাড়ার শ্রমিক বস্তিতে। ওখানে দু-বছর ধরে বন্ধ রয়েছে চটকল। আমার বন্ধুরা ওখানে গিয়ে তাদের সাধ্য়মতো কিছু চালডাল দিয়ে আসবে।"
প্রথমদিকে শুভঙ্কর ভেবেছিলেন, ক-জনই-বা প্রশ্রয় তাঁর এই 'পাগলামি'কে। বড়জোর দু-চারজন। কিন্তু ঘটলো ঠিক তার উল্টোটা। হু-হু করে আসতে লাগলো অনুরোধ। ইনবক্স উপচে পড়লো। শেওড়াফুলির বাড়িতে বসে শেষে নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে ছবি আঁকতে শুরু করলেন শুভঙ্কর। মোটামুটি দিনকয়েকের ভেতর এঁকে ফেললেন ৫০ থেকে ৬০ খানা পোট্রেট! আঁকাগুলো হোয়াটসআপে পাঠিয়েও দিলেন। আর সেই সঙ্গে অ্য়াকাউন্টে এসে গেল দশ থেকে বারোহাজার টাকা। সেই টাকায় গোন্দলপাড়ার শ্রমিকদের জন্য় কেনা হলো চালডাল।
তারপর?
শুরু হল আর এক বিপত্তি। মেসেঞ্জারে আসতে লাগলো অনুরোধের-পর-অনুরোধ। পোট্রেট আঁকার জন্য়। কিন্তু সমস্য়া দেখা দিলো অন্য়ত্র। আঁকার জন্য় যে একটু ভালো মানের কাগজ দরকার হয়, তা ফুরিয়ে গেলো। এলাকার কোনও দোকানেই পাওয়া গেল না সেই কাগজ। অগত্য়া পাল্টা অনুরোধ করতে হলো শুভঙ্করকে, "প্লিজ, আপনারা আর অনলাইনে টাকা পাঠাবেন না। যতক্ষণ-না আঁকার কাগজ পাই, ততক্ষণ পর্যন্ত আমার পক্ষে আঁকা আর সম্ভব হবে না।"
আপাতত ওই তরুণ শিল্পী বসে রয়েছেন আঁকার কাগজের দিকে মুখ চেয়ে। যদি কোনওভাবে কিছু কাগজের বন্দোবস্ত করা যায়, তাহলে শুভঙ্কর আরও পোট্রেট আঁকতে পারবেন। আরও কিছু টাকা আসতে পারে। আরও কিছু চাল কেনা যেতে পারে। আরও কিছু অভুক্ত পেট পূর্ণ হতে পারে। আর কিছু শ্রমিক বস্তিতে গরম ভাতের গন্ধ ভেসে বেড়াতে পারে বেলা দুপুরে। 'কথায় কথা বাড়ে', তাই ছোট্ট করে অনুরোধ করলেন শুভঙ্কর, "আমার প্রচারের দরকার নেই। শুধু একটু দেখবেন, কেউ যদি একটু কাগজের ব্য়বস্থা করে দেন, তাহলেই হবে।"
শুভঙ্করের হাতে আঁকার কাগজ এখন গোন্দলপাড়ার শ্রমিক বস্তির কাছে অস্তিত্ত্বের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাবা বিশ্বনাথ সিংহ রায় যে প্লাইউডের কারখানায় কাজ করেন, তা এখন বন্ধ। এই ঘোর লকডাউনের বাজারে দু-বেলা দু-মুঠো জোগাড় করতে কালঘাম ছুটে যাচ্ছে এই নিম্মবিত্ত পরিবারের। কিন্তু তবু, ছেলের কাজে পুরো সমর্থন রয়েছে বাবার। তাহলে? এই 'দিন আনি দিন খাই' পরিবারটির কাছে আমরা কি কিছু শিখলাম? ক্য়ামেরাদুরস্ত দানধ্য়ানের বাজারে এমন নিঃশব্দ, নির্বাক, ক্য়ামেরা-হীন বেঁচেবর্তে থাকার যাপনচিত্র কোনও দিন হয়তো সমকালের এক মৌখিক ইতিহাসে পরিণত হবে। যেদিন লেখা হবে-- করোনার মরশুমে আমাদের সমবেত খিদের সংক্রমণ আর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।