সংক্ষিপ্ত
- ফের কাঠগড়ায় সিএমআরআই হাসপাতাল
- সাড়ে চার বছর আগে গুরুতর অভিযোগ ছিল
- এবারও সেই অভিযোগের সূত্রে ফের কাঠগড়া তারা
- রাজশ্রী কুণ্ডুর করোনা আক্রান্তের খবরে আঙুল উঠেছে তাদের দিকে
সংক্রমণ ছড়াতে পারে আইসিইউ-তে। তাই কাঁচের ঘরের বাইরে থেকেই স্ত্রী রাজশ্রীকে দেখে মনের আকুলতা মেটাতে হয় অর্ণবকে। ২০১৬ থেকে এখন ২০২১। এভাবেই সাড়ে চার বছর ধরে এই আইসিইউ-এর ঘেরাটোপে নিজের দাম্পত্যকে টিকিয়ে রাখার লড়াই লড়ে যাচ্ছেন অর্ণব মুখোপাধ্যায়। স্ত্রী রাজশ্রী ও অর্ণব- দুজনেই পেশায় চিকিৎসক। কিন্তু, যে চিকিৎসা সাধনার শপথ নিয়ে মানুষের সেবায় ব্রতী হয়েছিলেন মালদহের দুই তরুণ-তরুণী। সেই চিকিৎসা পরিষেবার গাফিলতিতে আজ সাড়ে চার বছর ধরে আইসিইউ-তে পড়ে রয়েছেন ডক্টর রাজশ্রী কুণ্ডু মুখোপাধ্যায়। শরীরে সাড়় নেই। মুখে কথা নেই। এক্কেবারে বেবাক। চোখের নিস্পলক উদাস দৃষ্টিতে আদৌ প্রিয়জনকে চিনতে পারেনন কি না রাজশ্রী তাও জানা নেই অর্ণবের। মাঝে মাঝে রাজশ্রীর চোখ দিয়ে বেড়ে আসা জল, স্বামীকে দেখলে চোখের মণির সামান্য ওঠা-নামা খুশি করে অর্ণবকে স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু, ভালবাসার মানুষটা এবার কোভিড আক্রান্ত। এই খবর অর্ণবের কাছে পৌঁছনোর পর থেকে নাওয়া-খাওয়া ছুটেছে তাঁর। কারণ, যে সংক্রমণের ভয়ে অর্ণব এবং তাঁর পরিবারের লোকেরাও রাজশ্রীর কেবিনে ঢোকার অনুমতি পান না, সেখানে কী করে পৌঁছল করোনার গ্রাস!
২০১৬ সালে ইউটেরাস-এর টিউমারের সামান্য একটা অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে কোমায় চলে যান রাজশ্রী। সেই থেকে সিএমআরআই কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এক লড়াইয়ে নেমেছেন অর্ণব এবং তাঁর পরিবার। প্রথমে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল ৬ মাসের মধ্যেই সেরে উঠবেন রাজশ্রী। সেই ছয় মাস পার করে আজ রাজশ্রী সাড়ে চার বছর ধরে সিএমআরএই-এর আইসিইউ-এ। দিনের পর দিন তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। এবার সেই রাজশ্রী-র শরীরে নাকি মিলেছে কোভিড ১৯ ভাইরাস। সিএমআরএই-এর বিরুদ্ধে রাজশ্রীর চিকিৎসার গাফলতি নিয়ে বারবারই অভিযোগ করে এসেছেন অর্ণব। এমনকী, রাজশ্রীর শরীর থেকে যে কোভিড-এর নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে, সে তথ্যও ফোন করে অর্ণবকে দেওয়া হয়নি। ২৩ তারিখে সরকারি কোভিড পোর্টাল থেকে ফোনে আসা একটি মেসেজে প্রথমে অর্ণবরা জানতে পারেন যে রাজশ্রীর সোয়াব টেস্টের নমুনা নেওয়া হয়েছে। রাতেই ওই পোর্টালের আপলোড করা তথ্য থেকে অর্ণবরা জানতে পারেন রাজশ্রী কোভিড পজিটিভ।
আইসিইউ-এর ঘেরাটোপে থাকা একজন কী করে কোভিড আক্রান্ত হতে পারেন তা জানার চেষ্টা করেন অর্ণব। কিন্তু, ফোনে কাউকে না পেয়ে মালদহ থেকে ছুটে আসেন কলকাতায়। সিএমআরআই-এ যাওয়ার পর তিনি জানতে পারেন যে তাঁর স্ত্রীর কোভিড ১৯ পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে এবং তিনি কোভিড পজিটিভ। নমুনা সংগ্রহের বিষয়টি কেন যথাসময়ে তাঁকে জানানো হল না, তা নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে প্রশ্নও করেছিলেন অর্ণব। তাঁর অভিযোগ, কোনও উত্তরই পাওয়া যায়নি। এমনকী কোভিড ওয়ার্ডে স্ত্রী রাজশ্রীকে যে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে সে খবরও হাসপাতালে পৌঁছে জানতে পারেন।
এরপর থেকে আর স্ত্রী রাজশ্রীর কোনও খবর পাননি অর্ণব। রবিবার সকালে জানতে পারেন স্ত্রী রাজশ্রীর শরীরে মারাত্মকভাবে বাসা বেঁধেছে কোভিড ১৯-এর ভাইরাস। রাজশ্রীর শারীরিক অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। এরপরই পরিবারের লোকেদের নিয়ে হাসপাতালে ছোটেন অর্ণব। তার আগে এশিয়ানেট নিউজ বাংলার সঙ্গে টেলিফোনিক কথোপকথনে অর্ণব সিএমআরআই কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে রীতিমতো ক্ষোভ উগড়ে দেন। শনিবার গভীররাতে তাঁর পরিবারের কাছে একটি ফোন আসে সিএমআরআই থেকে। রাজশ্রীকে একটি নতুন ওষুধ দেওয়া নিয়ে সম্মতি চায় সিএমআরআই কর্তৃপক্ষ। আচমকা এমন ফোন পেয়ে স্বাভাবিকভাবেই আতঙ্কিত অর্ণবের পরিবার।
অর্ণব জানিয়েছেন, বহুদিন আগেই ক্রেতা সুরক্ষা কমিশনে সিএমআরআই কর্তৃপক্ষ এবং ৮ চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। তার শুনানি চলছে। এমনকী রাজ্যের ক্লিনিক্যাল এস্টাবলিসমেন্ট রেগুলেটরি কমিশনের কাছেও অভিযোগ জানিয়েছেন। স্ত্রী রাজশ্রীর জন্য লড়াইয়ে অর্ণবকে ছাড়তে হয়েছে রেলের চিকিৎসকের দায়িত্ব। দিনের পর দিন তিনি পড়ে থেকেছেন কলকাতায় স্ত্রী-র জন্য ন্যায় বিচার পেতে। এর জন্য মাঝেমধ্যেই তাঁর বিভিন্ন মহল থেকেও হুমকি দেওয়া হয়েছে। তাঁর কেরিয়ার শেষ করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে। এতেও যখন অর্ণবকে দমানো যায়নি তখন রাজশ্রী-র আরও ক্ষতি করে দেওয়া
রও হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এই মামলায় রাজ্যের এক প্রভাবশালী চিকিৎসক কাম মন্ত্রীর হাত রয়েছে বলেও অভিযোগ করেছেন অর্ণব। এত সহজে তিনি যে লড়াই থেকে পিছু হঠবেন না তা সাফ জানিয়েছেন। আইসিইউ-তে কর্মরতদের নিয়মিত কোভিড ১৯ টেস্ট হয়েছে কি না তার রিপোর্ট সিএমআরআই কর্তৃপক্ষের কাছে চেয়েছেন অর্ণব। এশিয়ানেট নিউজ বাংলার পক্ষ থেকেও সিএমআরআই কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি। ফোন বেজে গেলেও তা কেউই ধরেননি।
২০১৬-র ২৬ অক্টোবর কালীপুজোর জন্য প্রচুর বাজি কিনেছিলেন রাজশ্রী। ইচ্ছে ছিল অস্ত্রোপচারের পর বাড়ি ফিরে দীপাবলিতে সেই বাজি ফাটাবেন। ২৭ অক্টোবর সিএমআরআই-এ ভর্তি করানো হয় রাজশ্রীকে। ২৮ অক্টোবর অস্ত্রোপচারের পরই কোমায় চলে যান তিনি। কালীপুজোর বাজি ফাটানোর জন্য আর বাড়ি ফিরে আসতে পারেননি। সেই থেকে সাড়ে চার বছর ধরে হাসপাতালের আইসিইউ-তেই রাজশ্রী। এবার কোভিড আক্রান্ত। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়াইয়ের সফরে আরও এক কঠিন লড়াইয়ে তিনি।