সংক্ষিপ্ত
দেবলীনা দত্ত-ও আমার চোখে দেবীর মতোই। ওর জীবনেও লড়াই কম নয়। ‘ভটভটি’র শ্যুটিংয়ে আমরা ওর তত্ত্বাবধানে থাকতাম। ভীষণ নিরাপদ বোধ করতাম।
মেয়ে জন্ম লড়াইয়ের। নিজের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার। তাই নারী মানেই ‘দুর্গা’। ‘দুর্গা’ তো আসলে লড়াইয়ের নাম। প্রতীকী নাম। যে বাধার পাহাড় পেরিয়ে খোলা আকাশে নারীকে পাখা মেলতে শেখায়। তাই বছরে একবার নয়, প্রতি মুহূর্তে ঘরে ঘরে ‘দুর্গা’রা জন্ম নেয়—তৃতীয়ায় এশিয়ানেট নিউজ বাংলাকে একথা জানালেন পরিচালক-অভিনেতা তথাগত মুখোপাধ্যায়
ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে প্রতিটি নারীই ‘আমার দুর্গা’। নারী জন্ম মানেই তো ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই হাজারো বিধি-নিষেধ। রাত-বিরেতে ফাঁকা, অন্ধকার রাস্তায় হাঁটবে না। ইচ্ছে হলেও গঙ্গার পাড়ে হাঁটতে হাঁটতে পাবে না। কোনও পুরুষকে পছন্দ হলেও ঘুরে দেখতে পারবে না। অনুষ্ঠান বুঝে পোশাক পরবে। এবং কখনও খোলামেলা পোশাক পরবে না! নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে এত কিছু কী অনায়াসে চাপিয়ে দিই মা-বোন-বান্ধবীদের উপরে। পুরুষেরা কিন্তু এর সব কটাই করতে পারেন। খালি গায়ে ঘোরা থেকে রাত-বিরেতে মদ-সিগারেট খাওয়া হয়ে পছন্দের নারীকে ইচ্ছেমতো ভোগ করা— নিষেধ নেই কিছুতেই! আজন্ম হাজারো বাধার বেড়া ডিঙিয়ে, কখনও তাকে ভেঙে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে যেতেই তো এক একজন নারী ‘আমার দুর্গা’ হয়ে ওঠে।
তাই, জীবনের প্রতি ধাপে একাধিক ‘দুর্গা’ দেখেছি। প্রথমে ঘর থেকেই শুরু করি? বাকিদের মতো আমার জীবনেরও প্রথম ‘দুর্গা’ আমার মা। কেন? আমার মাকে মাত্র দুটো হাতে দশ হাতের কাজ সামলাতে দেখেছি। আমার মা বিশুদ্ধ গৃহবধূ। সংসার, সন্তান, রান্না ধ্যান-জ্ঞান। তার মধ্যেই সময় করে সকালে চা খেতে খেতে সাহায্যকারী দিদির সঙ্গে মনখুলে আড্ডা দিতেন। এত কাজের মধ্যেও তিনটে লাইব্রেরির সদস্য! আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, আশাপূর্ণা দেবী-সহ সে সময়ের সমস্ত লেখকদের লেখা ভীষণ আগ্রহ নিয়ে পড়তেন। মায়ের পাল্লায় পড়ে আমি একসঙ্গে পাঁচটি লাইব্রেরির বই পড়তাম।
আবার প্রেক্ষাগৃহে যখন ছোটদের ভাল ছবি আসত, যেমন, টারজান, স্পাইডারম্যান, কিং কং-- সে সবও মা-ই দেখাতে নিয়ে যেতেন। আর শুধুই আমাদের জন্য রান্না করতেন এমনও নয়। সংসারের বাইরেও মায়ের একটা সংসার ছিল। রাস্তার কুকুর, বেড়ালদের জন্য নিজে হাতে রাঁধতেন। নিজে হাতে খাওয়াতেন। এত কিছু মা কিন্তু একাই সামলে গিয়েছেন। যৌবনে আমার জীবনের দুর্গা আমার প্রথম প্রেমিকা। খুব সাদামাঠ ঘরের মেয়ে। সারা ক্ষণ বেঁচে থাকার লড়াই করতে হত তাকে। তার সঙ্গে ১০ বছরের প্রেম। তার অষ্টম শ্রেণি থেকে কলেজে যাওয়ার সঙ্গী আমি। ওই বয়স থেকেই অভাব সামলাতে দেখেছি। শেষে কলেজে পড়তে পড়তেই চাকরি খুঁজে নিয়ে সংসারের হাল ধরা— এই কাজ এক জন দুর্গাই পারে।
তার পরেও অন্য ‘দুর্গা’ আবির্ভূত হয়েছেন। দেবলীনা দত্ত-ও আমার চোখে দেবীর মতোই। ওর জীবনেও লড়াই কম নয়। সে সব পেরিয়ে দেবলীনা সফল। ‘ভটভটি’ ছবিতে অভিনয়ের পাশাপাশি পোশাক নির্মাণ করেছে। শ্যুটিংয়ের সময় আমরা ওর শাসনে, তত্ত্বাবধানে থাকতাম। এবং ভীষণ নিরাপদ বোধ করতাম। তা হলে দেবলীনাই বা কেন ‘আমার দুর্গা’ নয়? আসলে প্রত্যেক মেয়েই তার নিজ গুণে অজান্তে এই বিশেষ তকমা বলুন বা সম্মানের অধিকারী হয়ে ওঠে। মা দুর্গা অসুরের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। অসুর এখানে অশুভ শক্তির প্রতীক। পৃথিবীর তথাকথিত ‘দুর্গা’রাও নিজেদের অধিকার আদায় করতে গিয়ে, সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে লড়ে চলেছে।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল ইরানের সাম্প্রতিক নারী-প্রতিবাদের কথা। সে দেশে পুলিশি হেফাজতে থাকার সময় ২২ বছরের কুর্দি যুবতী মাশা আমিনের রহস্য-মৃত্যুর প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিলেন দেশের বাকি নারীরা। চুল কেটে, হিজাব খুলে রাস্তায় বেরিয়ে তাঁরা সমর্থন জানিয়েছিলেন তাঁকে। সে সব দেখে মনে হয়েছিল, আমার দুর্গা পৌঁছে গিয়েছে মুসলিম অধ্যুষিত দেশেও। সেখানেও সে লড়তে শেখাচ্ছে নারীকে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ছে আবারও। দুর্গাপুজোর আগে এই নারীশক্তিকেই আমার কুর্নিশ। যত দিন নারী নিয়মের শেকলে বাঁধা তত দিন যুগে যুগে ‘দুর্গাশক্তি’ জন্ম নেবে।