- Home
- India News
- প্রযুক্তিকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া এবং সস্তা করাতে তিনি ছিলেন জাদুকর, চলে গেলেন হোম কমপিউটারের জনক
প্রযুক্তিকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া এবং সস্তা করাতে তিনি ছিলেন জাদুকর, চলে গেলেন হোম কমপিউটারের জনক
- FB
- TW
- Linkdin
স্যার ক্লাইভ সিনক্লেয়ার যখন স্কুল ছুট হন তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৭। এরপর টেকনিক্যাল জার্নালিস্ট হিসাবে কাজ করতে শুরু করেন। সেই সঙ্গে অর্থ সংগ্রহ করতে থাকেন সিনক্লেয়ার রেডিওনিক্স সংস্থা তৈরির জন্য।
১৯৭০ সাল থেকে একের এক ক্যালকুলেটর তিনি বানাতে শুরু করেন। যাদের ওজন অতি কম এবং আকারে অনেকটাই ছোট। যাতে পকেটে ঢুকে যেতে পারে এই সব ক্যালকুলেটর, সেইভাবে তিনি বানাতে শুরু করেছিলেন।
স্যার ক্লাইভ সিনক্লেয়ারের উদ্দেশ্যই ছিল যাতে প্রযুক্তিকে ঘরে-ঘরে ব্যবহার করানো যায় এবং প্রযুক্তিকে যাতে সস্তার দামে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসা যায়। এই লক্ষ্য থেকেই সিনক্লেয়ার একের পর এক উদ্যোগ নিতে শুরু করেছিলেন।
সত্তর দশকে ঘরে ঘরে ব্যবহার করার মতো কমপিউটার থাকলেও তাদের আকার-আকৃতি ছিল অনেকটা বড় এবং সেই সঙ্গে তাদের দামও ছিল সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। স্যার ক্লাইভ সিনক্লেয়ার নিয়ে আসেন ZX80 নামে প্রথম হোম কমপিউটার। যার আকার এবং আকৃতি ছিল সেই সময়ের কমপিউটারের তুলনায় অনেকটা ছোট এবং দামও ছিল অত্যন্ত কম। যা সাধারণ মানুষের সাধ্যের মধ্যে।
সিনক্লেয়ারের তৈরি করা হোম কমপিউটার তখনকার দিনে শুধুমাত্র কিট হিসাবে দাম পড়ত ৭৯.৯৫পাউন্ড এবং অ্যাসেম্বলড করলে দাম পড়ত ৯৯.৯৫ পাউন্ড। সেই সময় যে কমপিউটার পাওয়া যেত তার দামের তুলনায় এটা ছিল ৫ ভাগের এক ভাগ।
ZX80 হোম কমপিউটারের মোট ৫০ হাজার ইউনিট বিক্রি হয়েছিল সে সময়। এরপর সিনক্লেয়ার নিয়ে আসেন ZX81। যা আগের হোম কমপিউটারের মডেলকে সরিয়ে বাজারে আরও জনপ্রিয়তা অর্জন করে। কারণ ZX81 হোম কমপিউটারের দাম ছিল মাত্র ৬৯.৯৫ পাউন্ড। এই মডেলের ২৫০, ০০০ হোম কমপিউটার বিক্রি করেছিল সিনক্লেয়ারের সংস্থা।
আজ কমিউটার গেমিং-এ গেম কমপিউটার আলাদা একটা জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু, এর সূত্রটা এসেছিল সিনক্লেয়ারের হাত ধরে। তাঁর তৈরি করা টাচ বেসড কিবোর্ড কমপিউটার গেমিং-এ থ্রি-ডি মনস্টার মেজ এবং মাজোগস-এর জন্য ছিল অপরিহার্য।
বর্তমান সময়ে অনেকেই সব শক্তিশালী গেম কমপিউটার তৈরি করছেন। কিন্তু, শুরুর সময়ে এই গেম কমপিউটারে রাস্তা দেখিয়েছিল সিনক্লেয়ারের ZX মডেলের হোম কমপিউটার। এই সময়ে যারা গেম কমপিউটার তৈরি করছেন হয় তারা সিনক্লেয়ারের ZX স্পেকট্রাম 48K বা তার প্রতিদ্বন্দ্বী শিবিরের কোমোডোর 64।
ZX80 এবং ZX81 হোম কমপিউটার বেঁচে কয়েক লক্ষ পাউন্ড কামিয়েছিলেন সিনক্লেয়ার। ২০১০ সালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন যে হোম কমপিউটার বেঁচে মাত্র ৩ বছরে ১৪ মিলিয়ন পাউন্ড লাভ করেছিল তাঁর সংস্থা।
১৯৮২ সালে এই কনফিগারেশন-এর হোম কমপিউটারকে সামনে নিয়ে আসেন সিনক্লেয়ার। শুরু থেকেই এি কমপিউটার কোন স্পিড ভিডিও বা ভারী ফাইলকে সেকেন্ডের মধ্যে কমপিউটারে চালু করার ক্ষমতা রাখতো। এর ইউনিক পয়েন্ট ছিল এর রাবার কিস, প্রবল ভারী ভিডিও ফাইলকে চালানো এবং দুরন্ত সাউন্ড। পরবর্তীকালে যারা গেম কমপিউটার বানানোয় বিশ্বজোড়া নাম করেছেন তাদের কাছে রীতিমতো অনুপ্রেরণা ছিল সিনক্লেয়ারের ZX স্পেকট্রাম 48K।
১৯৮৩ সালের মধ্যে ব্রিটেন থেকে শুরু করে বিশ্বের সাধারণ মধ্যবিত্তের ঘরে ঘরে প্রবল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন সিনক্লেয়ার। একটা সময় লন্ডনের স্টোরগুলিতে কমপিউটার বিক্রি হবে- এমন স্বপ্ন কেউ দেখতো না। কিন্তু এই স্বপ্নটা দেখেছিলেন সিনক্লেয়ার। আর তিনি সেটা বাস্তবায়িত করেছিলেন। বিশ্বের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন কমপিউটার নামক এক যুগান্তকারী আবিষ্কারকে। এর জন্য ১৯৮৩ সালে সিনক্লেয়ারকে নাইটহুড সম্মানে সম্মানিত করে ব্রিটেন।
C5 নামে একটি ইলেক্ট্রিক ইউটিলিটি কারকে বাজারে নিয়ে আসেন সিনক্লেয়ার। এটা আসলে ব্যাটারি চালিত একটি ইলেক্ট্রিক ট্রিক ছিল। সিনক্লেয়ার আশা করেছিলেন অন্তত ১ লক্ষ এই ইলেক্ট্রিক কার বিক্রি হবে। কিন্তু তা না হওয়ায় বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন সিনক্লেয়ার। কারণ, অন্য কোনও গাড়ির পাদানির সমান উচ্চতার এই ইলেক্ট্রিক কার-কে গ্রহণ করেনি সাধারণ মানুষ। যদিও, এর উদ্বোধন এবং প্রোমশনে প্রচুর সময় এবং অর্থ ব্যয় করেছিলেন সিনক্লেয়ার। এর ফল স্বরূপ তাঁর কমপিউটার ব্যবসাকে আমস্টার্ড বলে একটি সংস্থার হাতে বেচে দেন।
C5- এর মতোই হাল হয়েছিল দ্য সিনক্লেয়ার TV 80-র। আসলে দ্য সিনক্লেয়ার TV 80 ছিল একটা পকেট টিভি। মানুষ চলতে ফিরতে যাতে টিভি দেখতে পায়, তার জন্য এই পকেট টিভি আবিষ্কার করেছিলেন সিনক্লেয়ার। এখন মানুষ মোবাইলে সিনেমা দেখছে, টিভি দেখছে, ওটিটি প্ল্যাটফর্মে ওয়েব সিরিজ দেখছে। অথচ সিনক্লেয়ারের এই যুগান্তকারী আবিষ্কারকে সেই সময় মানুষ গ্রহণ করেনি। এতে আরও কিছুটা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছিলেন সিনক্লেয়ার।
সিনক্লেয়ারের মেয়ে, বছর সাতান্নর বেলিন্ডা সিনক্লেয়ার জানিয়েছেন, তাঁর বাবা নিজের আবিষ্কার করা প্রযুক্তিকে কোনওদিন ব্যবহারই করতেন না। তিনি পকেট ক্যালকুলেটর বের করলেও তা ব্যবহার করেননি। এমনকী যে হোম কমপিউটারের জনক বলা হয় তাঁকে, তাও তিনি ব্যবহার করতেন না। ইমেল কোনও দিনই ব্যবহার করেননি।
প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে কবিতা পড়তে এবং লিখতে প্রবল ভালোবাসতেন। নেশা ছিল ম্যারথন দৌঁড়ের। এমনকী অবসর সময়ে পোকার খেলতেন। এহেন স্যার ক্লাইভ সিনক্লেয়ার চলে গেলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। তিনি রেখে গিয়েছেন মেয়ে বেলিন্ডা এবং ছেলে বার্থোলোমিউ-কে। যাঁদের বয়স ৫৫ এবং ৫২। এছাড়াও তাঁর রয়েছে ৫ নাতি-নাতনি এবং ২ জন গ্রেট-গ্র্যান্ডচিল্ড্রেন। দীর্ঘদিন ধরেই বার্ধক্য জনিত রোগে ভুগছিলেন সিনক্লেয়ার। তাঁর মৃত্যুতে এলন মাস্ক থেকে শুরু করে বিশ্বের তাবড় তাবড় ব্যক্তিত্ব এবং প্রযুক্তিবিদ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন। এরা প্রত্যেকেই তাঁদের শোকবার্তায় সিনক্লেয়ারের অবদানকে সকলের সামনে তুলে ধরেছেন।