৩৭০ ধারা বাতিলের বর্ষপূর্তি, গত এক বছরে কতটা বদলালো ভূস্বর্গের জীবন
- FB
- TW
- Linkdin
গত বছর ৫ অগাস্ট সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ঘোষণা করেন যে জম্মু-কাশ্মীরের ওপর থেকে সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫এ অনুচ্ছেদের ধারা তুলে নেওয়া হল। যার অর্থ বিশেষ মর্যাদা আর থাকছে না জম্মু-কাশ্মীরের। তার বদলে দু'টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে উপত্যকাকে ভাগ করে দেওয়া হয়।
প্রস্তুতি অবশ্য শুরু হয়েছিল তার আগেই। ওইদিন যে কিছু একটা হবে তা কাশ্মীরে বিভিন্ন নিরাপত্তা রক্ষী সংস্থার কর্তাদের ১১ দিন আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যে কোনও পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকার কথা তাদের জানায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। কাশ্মীরে বাড়তি আধা সেনা মোতায়েন করা হয়েছিল। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল ইন্টারনেট এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা।
উপত্যকার বিশেষ মর্যাদা তুলে নেওয়ার দিনই জম্মু-কাশ্মীরের তিন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লা, ওমর আবদুল্লা ও মেহবুবা মুফতি-সহ বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতা ও বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার বা গৃহবন্দি করা হয়েছিল। তারপর গোটা উপত্যকায় জারি হয়েছিল কড়া নিয়ন্ত্রণ।
তবে পরিস্থিতি এখন অনেকটাই বদলেছে। মোবাইল, ইন্টারনেট, কেবল টিভি, ল্যান্ডলাইন-সহ যাবতীয় পরিষেবা চালু হয়েছে। প্রায় পুরোপুরি স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে উপত্যকায়।
জম্মু ও কাশ্মীরের এই বিশেষ রক্ষা কবচ নিয়ে বিতর্ক নতুন কিছু নয়। ৩৭০ ধারা নিয়ে জম্মু ও কাশ্মীর গণপরিষদের সদস্যদের মধ্যেও এবিষয়ে চূড়ান্ত মতভেদ ছিল। গণপরিষদের সদস্যরা সুস্পষ্ট কোনও ধারনাই দিয়ে যেতে পারেননি। তারা ৩৭০ ধারাকে চিরস্থায়ী করতেও বলেননি। আবার তুলে দেওয়ার পক্ষেও মত প্রকাশ করেনি। আসলে সদস্যদের মধ্যেও ছিল এ নিয়ে দোটানা। ৩৭০ ধারার অভিমুখ নিয়েও সংশয় ছিল খোদ গণ-পরিষদের সদস্যদের মধ্যেও। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলেন স্বতন্ত্র স্বায়ত্তশাসিত প্রাদেশিক আইনসভার পক্ষে। তাদের মতে, প্রাদেশিক ক্ষমতার বিচ্যুতি ঘটলে কেন্দ্রে হাতে চলে যাবে সব ক্ষমতা ও অধিকার।
অন্যপক্ষ আবার ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পক্ষে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন গণ-পরিষদে। ১৯৪৬ সালে কংগ্রেস অধিবেশনে দলের তখনকার সভাপতি আচার্য জেবি কৃপালনিও রাজ্যগুলির যথেষ্ট স্বশাসনের পক্ষে তার বক্তব্য পেশ করেন। তার মতে, ক্ষমতা বেশি কেন্দ্রীভূত হলে প্রাদেশিক স্বাধীনতা খর্ব হবে। দেশভাগের পরও বিতর্ক চলতে থাকে। উঠে আসে নতুন প্রশ্ন। দেশের অখণ্ডতার বিষয়টিও চলে আসে সামনে। ভারতে বহুত্ববোধকে সম্মান জানিয়ে দেশের অখণ্ডতার কথা মাথায় রেখে রচিত হয় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ক্ষমতার বিন্যাস। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণকেও দেওয়া হয় গুরুত্ব।
স্বাধীনতার পর থেকেই জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে একটু বিচ্ছিন্ন হয়েই ছিল। অঙ্গরাজ্য হলেও তারা অনেকটাই নিজেদের খেয়াল মতোই চলতো। তাদের জন্য ছিল আলাদা সংবিধান! ৩৭০ ধারা বলে তারা ভারতের সংবিধানের অনেক ধারাকে মানতে বাধ্য ছিলেন না। এক দেশে থেকেও তারা পেতেন বাড়তি স্বশাসন। সেখানকার মানুষদের আবেগের কাছে রক্ষাকবচ ছিল ৩৭০ ধারা। তাই ৩৭০ ধারা নিয়ে তারা ছিলেন খুবই স্পর্শকাতর। মুষ্টিমেয়র কয়েকজন মানুষ এই ৩৭০ ধারার সুযোগ নিয়েই নিজেদের শাসন ও শোষণ কায়েম করছিলেন উপত্যকায়।
এ কারণেই জরুরি হয়ে পড়েছিল স্থানীয় মানুষদের উন্নয়ন আর নিরাপত্তার স্বার্থেই ৩৭০ ধারা রদ। আগেও বহুবার পরিবর্তন করা হয়েছে। তবে নির্মূল করা হয়নি সমস্যার। ৩৭০ ধারা নিয়ে অন্তত ৪০ বার সংশোধনী গৃহীত হয়েছে। জম্মু কাশ্মীরে দফা দফায় কেন্দ্রীয় সরকার পরিবর্তন করেছেন সরকারি নির্দেশিকা। গত বছর ৩৭০ ধারা বাতিলের আগেই ৯৭টির মধ্যে ৯৪টি বিষয় আগেই পরিবর্তিত হয়। তবে আর পরিবর্তন নয়। গত বছর ৫ আগস্ট ৩৭০-কে বাতিল করারই সিদ্ধান্ত নেয় ভারত সরকার।
সিদ্ধান্তের সমর্থনে রাজ্যসভায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জম্মু ও কাশ্মীর পুনর্গঠন বিল পেশের সময় কড়া সমালোচনা করেছিলেন ৩৭০ ধারার। তার মতে, জম্মু ও কাশ্মীরে দুর্নীতি, সন্ত্রাস আর বিচ্ছিন্নতাবাদের ৩৭০-ই মূল কারণ। ৩৭০ ধারা বিলোপের সিদ্ধান্ত রাজ্যে সন্ত্রাস দমনে সাহায্য করবে। সাধারণ মানুষ পাবেন সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের সুবিধা ভোগ করতে। তারাও পাবেন দেশের অন্যান্য রাজ্যের মতো চাকরি বা শিক্ষা ক্ষেত্রে সংরক্ষণের সুবিধা। সকলের জন্য শিক্ষা বা তথ্য জানা অধিকার গোটা দেশে চালু থাকলেও কাশ্মীরের মানুষ ছিলেন এসবের থেকে বঞ্চিত।
আসলে ৩৭০ ধারার আড়ালে উপত্যকার তপশিলি জাতি, তপশিলি উপজাতি, অনগ্রসহ শ্রেণির মানুষদের অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিল। জাতীয়-স্তরের একাধিক প্রকল্পের সুবিধার কথা এতকাল জানতেই পারতেন না তারা। ভারতের নাগরিক হয়েও সুবিধা ভোগ করার অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিল তাদের। ৩৭০ ধারা লোপ তাঁদের সেই বাধা দূর করলো। ২০০৫ সালে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন সংশোধন করা হলেও কাশ্মীরের হিন্দু মহিলারা তার সুবিধা এতকাল পাননি। এখন তারা পুরুষদের সমান উত্তরাধিকারের অধিকারী মহিলারাও। গোটা দেশের মতো কাশ্মীরেও মহিলারা ৩৭০ ধারা রদের পর পাচ্ছেন সম্পত্তির অধিকার। জম্মু ও কাশ্মীরের সম্পত্তি হস্তান্তরের আইনও বিলুপ্ত হয়েছে। ফলে ভারতীয় নাগরিকরা এখন কাশ্মীরে সম্পত্তি কেনার অধিকার পেলেন। আর কাশ্মীরিরাও পেলেন সম্পত্তি হস্তান্তরে স্বাধীনতা।
কেন্দ্রী দাবি করছে ৩৭০ ধারা বিলোপের হাতেগরম ফল পাচ্ছে ভূস্বর্গ কাশ্মীর । ঐতিহাসিক এই ধারা বাতিলের ফলে গত এক বছরে ভূস্বর্গে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। সেই খতিয়ান তুলে ধরে এক রিপোর্ট পেশ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রিপোর্টে বলা হয়েছে, জম্মু কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বিলোপের পর থেকেই সন্ত্রাসদমন অভিযানে উল্লেখযোগ্য সাফল্য মিলেছে। পাশাপাশি গত বছরের ২০১৯ সালের তুলনায় নাশকতামূলক কার্যকলাপ ৩৬ শতাংশ কমেছে। মন্ত্রকের দাবি, ২০১৯ সালের পয়লা জানুয়ারি থেকে ১৫ জুলাই পর্যন্ত কাশ্মীরে ১৮৮টি নাশকতামূলক ঘটনা ঘটিয়েছিল জঙ্গিরা। এবছর একই সময়ে নাশকতামূলক ঘটনার সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১২০। গত বছর ওই সময়ে ভূস্বর্গে ৫১ বার গ্রেনেড হামলা হয়েছিল বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। এ বছরের শুরু থেকে ১৫ জুলাই পর্যন্ত সেই সংখ্যাটি কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২১টি। গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যা সন্ত্রাসবাদীকে নিকেশ করেছে যৌথবাহিনী।