সংক্ষিপ্ত
২৭ মাস ধরে মাইনে না পেয়ে সঞ্চিত অর্থের সবটুকু খরচ হয়ে গিয়েছিল। তীব্র আর্থিক অনটনের শিকার হয়ে অবশেষে আত্হননের পথ বেছে নিয়েছেন অসমের হিন্দুস্থান পেপার কর্পোরেশনের কারখানায় কর্মরত বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার বিশ্বজিৎ মজুমদার। সুইসাইড নোটে তিনি তাঁর মৃত্যুর জন্য দায়ী করেছেন ভারত সরকারকে। শুধু বিশ্বজিতই নন, একইরকম আর্থিক দুরবস্থায় পড়ে ধুঁকছেন কারখানার তিন হাজার কর্মী ও তাঁদের পরিবার।
৩০ বছর ধরে তিনি হিন্দুস্থান পেপার কর্পোরেশন লিমিটেডের কর্মী ছিলেন। কিন্তু জীবনের শেষ মুহূর্তে আর প্রিয় সাদা কাগেজের উপর ভরসা রাখতে পারেননি অসমের বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার বিশ্বজিৎ মজুমদার। বরং নগাঁও-এ দশ ফুট বাই আট ফুটের ছোট্ট সরকারি আবাসে আত্মঘাতি হওযার সময় মৃত্যুকালীন জবানবন্দী লেখার জন্য বেছে নিয়েছিলেন ঘরে থাকা রেফ্রিজারেটরের দরজাকেই। তার গায়েই বড় বড় ইংরিজি হরফে তাঁর মৃত্য়ুর জন্য ভারত সরকারকেই দায়ী করে যান বিশ্বজিৎ। আশ্চর্য সমাপতন বলা যেতে পারে, তিনি চরম সিদ্ধান্ত নেওয়ার দুদিন পরই কেন্দ্রীয় সরকার হিন্দুস্থান পেপার কর্পোরেশন লিকুইডেশনে চলে যাওয়ার কথা ঘোষণা করেছে।
আদিবাড়ি কালনায় হলেও বর্তমানে পেশায় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার বিশ্বজিতের পরিবার থাকত কলকাতার বেলগাছিয়াতে। অবশ্য পড়াশোনার জন্য যমজ দুই মেয়ের একজন দিল্লিতে ও অপরজন কেরলে থাকেন। কাজের খাতিরে নগাঁও-তে একাই থাকতেন বিশ্বজিৎ। গত শনিবার (২৭ এপ্রিল) থেকেই তিনি অফিসে আসছিলেন না। রবিবার থেকে স্ত্রী ও কন্যারা তাঁকে ফোনে পাচ্ছিলেন না। অবশেষে মঙ্গলবার তাঁর সরকারি আবাসের ঘরের দরজা ভেঙে তাঁর ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার করা হয়।
কিন্তু, কেন এই সিদ্ধান্ত নিলেন বিশ্বজিৎ? কেনই বা মৃত্যুকালীন জবানবন্দীতে তিনি ভারত সরকারকে দায়ী করলেন? বস্তুত, হিন্দুস্থান পেপার কারখানার কর্মীদের আত্মঘাতি হওয়ার ঘটনা এই প্রথম নয়। ২০১৭ সালের মার্চ মাস থেকে কারখানার বেতন বন্ধ হয়ে রয়েছে। এই নিয়ে তিন-তিনজন কর্মী আর্থিক অনটনের শিকার হয়ে আত্মঘাতি হলেন। গত বছরই রাধিকা মজুমদার ও প্রভা ডেকা নামে দুই কর্মী একই পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এছাড়া, বিনা চিকিৎসায় পড়ে থেকে মৃত্যু হয়েছে আরও ৩১ জনের।
জানা গিয়েছে এর আগে হিন্দুস্থান পেপার কর্পোরেশনেরই কাছাড়ের পাঁচগ্রাম কারখানায় নিযুক্ত ছিলেন বিশ্বজিৎ। ২০১১ সালে এসেছিলেন নগাঁওয়ের জাগি রোড কারখানায়। ভালো গান গাইতে পারতেন। সহকর্মীদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। কিন্তচু গত ২৭ মাস ধরে বেতন বনব্ধ থাকায় একে একে যাবতীয় সঞ্চয় শেষ হয়ে যাচ্ছিল। দুই মেয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছেন। তাঁদের পড়াশোনার খরচ, রোজকার সাংসারিক খরচ সব মিলিয়ে প্রায় সর্বস্বান্ত হওয়ার জোগার হয়েছিল। সেই আর্থিক চাপ সহ্য করতে না পেরেই ৫৫ বছরের বিশ্বজিত আত্মহননের পথে বেছেছেন বলে মনে করছে পুলিশ।
তবে, বিশ্বজিতের এই দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর পরেও কি অবস্থাটার পরিবর্তন হবে? কোনও আশা দেখছেন না বিশ্বজিতের সহকর্মীরা। নগাঁও পেপার মিল ইউনিয়নের নেতা হেমন্ত কাকতি জানিয়েছেন, কর্মীদের অধিকাংশই এখন ঋণের দায়ে জর্জরিত। অধিকাংশ পরিবারই রয়েছে আধপেটা খেয়ে। রোগ-বিরোগে চিকিৎসা করানোর মতো অবস্থাও নেই। ছেলেমেয়ের লেখাপড়া বন্ধ। সরকারি চিকিৎসা-বিমার টাকা মেলে না, এমনকী ২০১৫ সালের পর থেকে ভবিষ্যতনিধি তহবিলের কিস্তিও জমা পড়েনি। আর এখন তো সরকার কারখানা লিকুইডেশনে চলে যাওয়ার কথাই ঘোষণা করে দিল। কাজেই পরিস্থিতি বরং দিন কে দিন আরো খারাপ হবে বলেই আশঙ্কা করছেন হিন্দুস্থান পেপার কর্পোরেশনের তিন হাজার কর্মী।