সংক্ষিপ্ত

  • ভাগ্য়বিপর্যয়ের মাঝে পড়েছেন এদেশের পরিযায়ী শ্রমিকরা
  • অভুক্ত শরীরে দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হচ্ছে তাঁদের
  • দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে রেঙ্গুন থেকেও এইভাবে চারলাখ ভারতীয় পাড়ি দিয়েছিলেন
  • বার্মা তখন জাপানিরা দখল করেছিলেন

রেঙ্গুনে তখন প্লেগ  এদিকে কাউকে কিছু না-জানিয়েই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্য়ায় পাড়ি দিলেন সেখানে তা, সেই সময়ের বর্মা, যা আজ মায়ানমার, জাহাজে করে সেখানে নামার পরই আটকানো হল তাঁকে বন্দর থেকে সোজা পাঠানো হল কোয়ারিন্টনে একটা প্রায় জঙ্গলের মতো জায়গায় তিনি কাটালেন টানা সাতদিন

 

শুধুই যে প্লেগের মতো মহামারীর দুঃস্মৃতিই বহন করছে আজকের মায়ানমার বা সেদিনের বর্মা, তা কিন্তু নয় আজকের ভারতে যেমন হাজারো পরিযায়ী শ্রমিক কয়েকশো মাইল পথ হেঁটে পাড়ি দিয়েছেন নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশে, পথেই মারা গিয়েছেন বেশ কয়েকজন, সেদিনও ঠিক তেমনটাই ঘটেছিলসময়টা ১৯৪২ সালদ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে তখনসুভাষচন্দ্র বোস তৈরি করে ফেলেছেন তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজবার্মা তখন বলতে গেলে তখন ভারতেরই অংশরেঙ্গুন ভারতেরই এক শহরএই পরিস্থিতিতে জাপান আক্রমণ করলো  বার্মাব্রিটিশরা পিছু হটতে শুরু করলএদিকে রেঙ্গুনে তখন অসংখ্য় ভারতীয়যাঁদের মধ্য়ে বাঙালির সংখ্য়াই বেশিসেই সময়কার বাংলা গল্প-উপন্য়াস সাক্ষ্য় দিচ্ছে, অসংখ্য় বাঙালি তখন রেঙ্গুনে গিয়ে থাকতে শুরু করেছিলেনভালো চাকরি অথবা ব্য়বসাবাণিজ্য়ের কারণেতা এই পরিস্থিতিতে সেই মানুষগুলো তো বিপদে পড়লেন বোমা বিধ্বস্ত শহরে তো আর থাকা যায় নাতখন তাঁরা একে-একে পাড়ি দিতে লাগলেন বাংলাদেশের  পথে (অবিভক্ত বাংলা)সেই ফিরে আসার স্মৃতি আজকের প্রজন্মের কাছে সেরকম দগদগে নয় ঠিকইতবে কেউ কেউ তা মনে রেখেছেন বইকি সেই সময়ে যারা অত বড় পথ পাড়ি দিয়েছিলেন বিপর্যয়ের মাঝে, তাঁদের উত্তরসূরিরা তো এখনও রয়েছেনআর বড়দের মুখে  মুখে শোনা সেইসব ঘটনার স্মৃতিও যে সবার ফিকে হয়ে গিয়েছে, তেমনটা নয়সম্প্রতি, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এমনই কয়েকজন উত্তরসূরিদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেতাঁদেরই মধ্য়ে একজন মিতালি চৌধুরীযিনি এই করোনার মরশুমে, লকডাউনের মরশুমে বিপর্যস্ত পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশার ছবি সামনে রেখেই স্মৃতিচারণ করেছেন তাঁদের কয়েক প্রজন্ম আগের সেইসব মানুষগুলোর কথা বলে রাখা দরকার, সেইসময়ে ভাগ্য় বিপর্যয়ের জেরে রেঙ্গুন থেকে পাড়ি দিয়েছিলেন চারলাখ মানুষশ্বাপদসঙ্কুল সেই পথের দীর্ঘ যাত্রা কেমন ছিল?

 

মিতালি চৌধুরী এখন লন্ডনে থাকেন দক্ষিণ কলকাতার মেয়ে মিতালি মনে করলেন তাঁর প্রপিতামহ জয়চন্দ্র দত্ত-র কথা স্বাধীনতা-পূর্ব ভারতে কাঠের ব্য়বসা করতে জয়চন্দ্র গিয়েছিলেন রেঙ্গুনেমনে করা হয়, জয়চন্দ্রের জীবনই অমিতাভ ঘোষকে অনুপ্রাণিত করেছিল তাঁর সেই বর্মা-ভিত্তিক উপন্য়াস লিখতে-- দ্য় গ্লাস অব প্য়ালেসজয়চন্দ্রের মেয়ের নাতি সতীশচন্দ্র রায়যাঁর মেয়ে মিতালিসতীশচন্দ্রই হলেন বংশের শেষ প্রজন্ম, যিনি বর্মাতে ছিলেন তাঁর ছোটবেলায়২০০৭ সালে মারা যান সতীশচন্দ্রওঁর মুখেই মিতালি শুনেছেন বার্মা থেকে ফিরে আসার সেই দিনগুলোর কথামিতালির কথায়-- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন শুরু হয়ে গিয়েছেবাবার বয়য় তখন কুড়িকয়েকমাসের মধ্য়েই কলেজের পরীক্ষায় বসার কথা আমাদের পরিবারের বাবাই ছিলেন শেষজন মধ্য়ে স্টিমারে উঠে পালিয়ে আসতে পেরেছিলেন বাড়ির মহিলা আর শিশুদের নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে আসার সময়ে বাবাকেই সব দায়িত্ব নিতে হয়েছিলস্টিমারে ওঠার সময়ে ওঁর দাদা একটা টাকার ব্য়াগ হাতে তুলে দিয়ে বলেছিল, বাড়ির সবার যেন খেয়াল রাখেন... হাওয়ায় তখন উড়ছে ভয় বাবা তখন জানেন না যে, ওঁর দাদা স্থলপথে কখন গিয়ে ঢাকায় গিয়ে পৌঁছবেন এদিকে সেই পথ খুব ঝুঁকিপূর্ণ চারদিকে ঘন জঙ্গল শ্বাপদসঙ্কুল ওই পথে আসতে আসতে আমার এক পিসি টাইফয়েডে আক্রান্ত হলেন পৌঁছনোর সাথেসাথেই মারা গেলেন তিনি...রেঙ্গুনে কিন্তু আমরা যথেষ্ট স্বচ্ছল ছিলাম বর্মার কিং থাব-র কাছে যে  একসময়ে যে গহনা ছিল, আমার মাকে তা দেওয়া হয়েছিল বংশের চিহ্ন হিসেবে সবকিছু  ছেড়েছুড়ে কলকাতায় এসে  ছা-পোষা জীবন কাটানোর শকটা তাঁরা কোনওদিনই মেনে নিতে পারেননি