সংক্ষিপ্ত

কেন্দ্র রাজ্য সংঘাতে নতুন মাত্রা যোগ করল নেতাজি ট্যাবলো বিতর্ক (Netaji Tableau Controversy)। এতে অবশ্য রাজনৈতিক ফায়দা রয়েছে বিজেপি (BJP) ও মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায় (Mamata Banerjee) - দুই পক্ষেরই। 
 

৭৩তম প্রজাতন্ত্র দিবসের (73rd Republic Day) আগের কয়েকটা দিন ধরে তীব্র বিতর্কের হয়েছে নেতাজি ট্যাবলো (Netaji Tableau Controversy) নিয়ে। নয়াদিল্লির রাজপথে কুচকাওয়াজে পশ্চিমবঙ্গ থেকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু (Netaji Subhas Chandra Bose) এবং তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজের (Indian National Army) অবদানের বিষয়ে একটি ট্যাবলো প্রদর্শনীর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। এরপরই রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে, নেতাজি তথা বাংলাকে বঞ্চনা এবং অপমান করার অভিযোগ তোলা হয়। সেই অভিযোগ খণ্ডন করেছে কেন্দ্র। তাদের দাবি, যা হয়েছে নিয়ম মেনেই হয়েছে এবং এর পিছনে কোনও রাজনৈতিক স্বার্থ নেই। ফলে, এই ট্যাবলো প্রদর্শনী নিয়েও তৈরি হয়েছে কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাতের পরিবেশ। প্রশ্ন হল, এই সংঘাতের কি আদৌ কোনও সারবত্তা রয়েছে? সত্যিই কি বাংলাকে বঞ্চিত করছে কেন্দ্র? নাকি স্রেফ বিরোধিতার জন্যই বিরোধিতা করে যাচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee)? 

শুরুটা হয়েছিল, প্রজাতন্ত্র দিবসের কয়েকদিন আগে থেকে। হঠাতই নবান্ন (Nabanna) থেকে জানানো হয়েছিল, বাংলার নেতাজি বিষয়ক ট্যাবলো প্রদর্শনীর প্রস্তাব বাতিল করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর (PM Narendra Modi) হস্তক্ষেপ চেয়েছিলেন। সরাসরি চিঠি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীকে। তার জবাব এসেছে, দুই দিনের মধ্য়েই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং (Rajnath Singh) চিঠি লিখে জানান, কেন্দ্রীয় লোক নির্মাণ বিভাগ বা সিপিডব্লুডি (CPWD), ওই একই বিষয়ে একটি ট্যাবলো প্রস্তুত করছে। ট্যাবলো বাছাইয়ের নিয়ম অনুসারে, একই বিষয়ে দুটি ট্যাবলো প্রদর্শিত হয় না। তাই বাদ পড়েছে বাংলা। কেন্দ্রীয় সরকারেরও এতে কোনও ভূমিকা ছিল না, একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি এই বাছাইয়ের বিষয়টি দেখেন। এটা তাঁদেরই সিদ্ধান্ত। 

আরও পড়ুন - Netaji Tableau: রাজপথে সিপিডব্লুর নেতাজি ট্যাবলো, রেডরোডে রাজ্যের - কোনটি বেশি ভাল, দেখুন

আরও পড়ুন - Republic Day Tableaux Controversy: কেন বাদ পশ্চিমবঙ্গ, কোথায় ভুল করলো মমতার সরকার

আরও পড়ুন - Netaji Hologram Statue: হলোগ্রাম কী, স্মার্টফোন দিয়ে ঘরে বসেই কীভাবে তৈরি করবেন

এরপরও কিন্তু, এই বিতর্কের অবসান ঘটেনি। তৃণমূল কংগ্রেসের (TMC) পক্ষ থেকে ক্রমাগত বাংলা ও নেতাজিকে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার কীভাবে বঞ্চিত করছে, সেই রেকর্ড বাজিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পাল্টা বিজেপি নেতারা শুনিয়ে যাচ্ছেন, প্রধানমন্ত্রী মোদীই কীভাবে নেতাজির প্রাপ্য সম্মান দিচ্ছেন। কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত কোনও নতুন বিষয় নয়। কেন্দ্রের বিভিন্ন প্রকল্প রাজ্যে রূপায়িত করার প্রশ্নেই হোক, কী ঘুর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সহায়তা -  কেন্দ্রে মোদী সরকার আসার পর থেকেই এই সংঘাতের ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে। তবে তাতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে, এই নেতাজি ট্য়াবলো বিতর্ক, বা বলা ভাল এই বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছেন যে মানুষটি, সেই নেতাজি।

৭৩তম প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন নয়াদিল্লির রাজপথে সিপিডব্লুডির নেতাজি ট্যাবলো -  

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, তৃণমূল কংগ্রেসের জন্মই হয়েছিল সিপিআইএম (CPIM) বিরোধিতার মধ্য দিয়ে। সিপিআইএম ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর, সেই অর্থে তৃণমূলের চালিকা শক্তি হতে পারে, এই রকম কোনও রাজনৈতিক মতবাদ তাদের কাছে ছিল না। এই অবস্থায়, ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে, দলকে নতুন ভাবে ব্র্যান্ডিং করা হয়। মহারাষ্ট্রে ১৯৭০-৮০'এর দশকে বাল ঠাকরে (Bal Thackeray) ও তাঁর শিবসৈনিকরা যেমন মারাঠা জাতিকে কেন্দ্র করে পরিচয়ক ভিত্তি রাজনীতি করতেন, অনেকটা সেই ধাঁচে বাঙালি জাতি ভিত্তিক রাজনীতির সূচনা করে তৃণমূল কংগ্রেস। আর এখান থেকেই, বিগত নির্বাচনে জন্ম হয়েছিল 'বহিরাগত', 'বাংলার মেয়ে'র মতো রাজনৈতিক শব্দবন্ধ। 

এই বাঙালি জাতি-পরিচয় ভিত্তিক রাজনীতিতে সুভাষচন্দ্র বসুর থেকে বড় আইকন আর কে হতে পারে? ভাবনার জগতে তিনি ছিলেন যতটাই আন্তর্জাতিক, আবেগের টানে ততটাই বাঙালি। সেই সঙ্গে আপামর ভারতবাসীর কাছে রয়েছে বিপ্লবের রোমান্টিক আবেদন। কেন্দ্রীয় একটি বিভাগ নেতাজি ট্যাবলো করছে বলে, পশ্চিমবঙ্গের ট্যাবলো বাদ দেওয়া হল - প্রাথমিকভাবে, কেন্দ্রের এই যুক্তি যথেষ্টই দুর্বল। তবে, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ (Nirmala Sitharaman), টুইট করে জানিয়েছেন, নেতাজি ট্যাবলো প্রস্তাব যে বাতিল হয়েছে, তা বাংলার সরকারকে জানানো হয়েছিল ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসেই। সেই সময়ই হয়েছিল প্রাথমিক বাছাই। কাজেই, বিষয়টি এতদিন পরে কেন সামনে আনলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। 

কলকাতার রেডরোডে প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নেতাজি ট্যাবলো - 

অন্যদিকে, নেতাজিকে হাতছাড়া করা বিজেপির পক্ষেও অসম্ভব, এমনটাই বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাঁদের দাবি, ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছরে, কংগ্রেসের ইতিহাস ধুয়ে মুছে দিতে একজন আইকন প্রয়োজন ছিল বিজেপির। কিন্তু, বিজেপি বা সংঘের ইতিহাসে এমন কোনও ব্যক্তি নেই, যাকে এই ভূমিকায় উপস্থাপন করা যেতে পারে। সাধ্বী প্রজ্ঞারা যতই সাভারকরকে মহান নেতা হিসাবে তুল ধরার চেষ্টা করুন না কেন, বিজেপির মাথারা ভাল করেই জানেন, সেই ভাষ্যের সর্বগ্রহণযোগ্য আবেদন নেই। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দাবি, এই কারণেই বিজেপি নেতারা খুঁজছিলেন গান্ধী-নেহেরুদের দ্বারা বঞ্চিত কোনও কংগ্রেস নেতাকে। 

প্রথমে বিজেপি আশ্রয় নিয়েছিল বল্লবভাই প্যাটেলের (Ballav Bhai Patel)। লৌহমানবের বিশাল মূর্তি স্থাপিত হল। কিন্তু, সেভাবে সাড়া জাগাতে পারলেন না। এরপরই, তাঁরা একই চেষ্টা চালাচ্ছেন সুভাষচন্দ্র বসুকে কেন্দ্র করে। ২০১৮ সালে নেতাজির স্থাপিত আজাদ হিন্দ সরকারের ৭৫ বছর পূর্তিতে নেতাজি টুপি পড়ে লালকেল্লায় পতাকা তোলা, আন্দামান সফরে গিয়ে নেতাজির নামে দ্বীপের নামকরণ, নেতাজির জন্মদিবসকে পরাক্রম দিবস হিসাবে ঘোষণা, ইন্ডিয়া গেটে নেতাজির মূর্তি স্থাপন - সবটাই এই ধারাবাহিকতারই অংশ, এমনটাই বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। নাহলে, বিতর্ক হতে পারে বুঝেও,  বাংলার নেতাজি ট্যাবলো বাতিল করত না কেন্দ্র। সরকার চাইলে সিপিডব্লুডির ট্যাবলোর বদলে বাংলার ট্যাবলোটিকে জায়গা দেওয়া যেত না, এই কখাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। দিল্লির ইন্ডিয়া গেটে নেতাজি মূর্তি স্থাপনও, যেন তড়িঘড়ি ড্যামেজ কন্ট্রোল। নইলে আসল মূর্তির বদলে হলোগ্রাম মূর্তি উন্মোচন করতেন না প্রধানমন্ত্রী।