সংক্ষিপ্ত
- ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধ করে শহিদ হয়েছিলেন টিপু সুলতাল
- মহিশুরের সুতলান ছিলেন ব্রিটিশদের সাম্রাজ্য বিস্তারে বাধা
- দীর্ঘ লড়াই করতে হয়েছিলে টিপুকে হারানোর জন্য
- ব্রিটিশ বাহিনীর কাছে রীতিমত ত্রাস ছিলেন তিনি
১৭৯৯ সালে ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধে শ্রীরঙ্গপত্তমে টিপু সুলতানের মৃত্যু হয়। ৪ মে টিপুর মৃত্যুসংবাদ শুনে বৃটিশ সাম্রাজ্যের তৎকালীন পরিচালক রিচার্ড ওয়েলেসলি মদের গ্লাস হাতে প্রথম উক্তি ছিল, ‘ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ, ভারতবর্ষের মৃত আত্মাকে স্মরণ করে আমি পান করছি’। এরপর তিনি বলেছিলেন, ‘গোটা ভারতবর্ষই এখন আমাদের’।
ঔপনিবেশিক শক্তি বৃটিশদের কাছে তৎকালীন ভারতবর্ষে সাম্রাজ্য বিস্তারে টিপু সুলতান যে একটি বড় বাধা ছিল তা ওয়েলেসলির এই দুটি মন্তব্য থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়। কারন অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকেও ব্রিটিশ শাসকের কাছে টিপুর নাম ছিল এক বিভীষিকা। তাই টিপুর মৃত্যু সংবাদে তাঁরা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল, এদেশের মাটিতে তো বটেই, খবর পৌঁছানোর পর ব্রিটেনের মাটিতেও উৎসবের ঢেউ লাগে।
টিপু সুলতান ছিলেন ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামী ও শহীদ রাজা। কেবল তাই নয়, শের-ই-মহীশুরখ্যাত টিপু সুলতান অষ্টাদশ শতকে ভারতীয় উপমহাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে এক মূর্তিমান আতঙ্ক ছিলেন। ইংরেজরাই তাকে মহীশুরের বাঘ উপাধি দিয়েছিল। তবে দেশপ্রেমী বীর শহীদ টিপু সুলতানকে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা সাম্প্রতিককালেও হিন্দুবিদ্বেষী রাজা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
কর্নাটকের বিজেপি নেতা ও কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী অনন্ত কুমার হেগড়ে টিপু সুলতানকে একজন খুনি ও ‘কুখ্যাত ধর্ষণকারী’ আখ্যায়িত করেছিলেন। তিনি এও বলেছিলেন, টিপু সুলতান গণহারে অসংখ্য নারীকে ধর্ষণ করেছিলেন। পরবর্তীতে দিল্লি বিধানসভায় ৭০ জন স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং দেশপ্রেমিকের ছবি উন্মোচন করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। গ্যালারিতে রাখা ওই ছবিগুলোর মধ্যে টিপু সুলতানও ছিলেন। বিজেপি নেতারা দাবি করেন, টিপু ছিলেন কট্টর হিন্দুবিরোধী এবং গণহত্যাকারী।
টিপুর চরিত্রে কালিমা লেপনের চেষ্টা হয়েছে বহুবার। বলা হয়েছে, টিপু ইসলাম ধর্মাবলম্বী হলেও তার প্রজাদের বেশিরভাগই ছিলেন হিন্দু। কারও দাবি, তিনি ইসলাম প্রচারের জন্য জোর করে হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করেন, ফার্সি ও উর্দু ভাষায় জোর দেন এবং ইসলামি আদলে বিভিন্ন স্থানের নতুন নামকরণ করেন। অভিযোগ ১৭৮৮ সালে টিপু কালিকট অধুনা ইসলামাবাদের গভর্নর শের খানকে চিঠি দিয়ে হিন্দুদের মুসলমানে ধর্মান্তর করার নির্দেশ দেন এবং ওই বছর জুলাই মাসে দুশোর বেশি ব্রাহ্মণকে জোর করে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তর করা হয়। এছাড়াও তিনি ২৭টি ক্যাথলিক চার্চ ধ্বংস করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
তবে টিপুর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ অধিকাংশ ইতিহাসবিদ মানতে নারাজ। তাদের মত টিপু সুলতান হিন্দুদের এবং অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। মারাঠার রঘুনাথ রাও পটবর্ধনের ঘোড়সওয়ারেরা ১৭৯১ সালে কন্নড়ের মন্দিরগুলির ওপর ধ্বংসলীলা চালায়, ওই সময় তারা বহু পুরোহিতকে হত্যা ও আহত করে। পরবর্তীতে টিপু সুলতান মন্দিরগুলি পুনর্নির্মাণে সহায়তা করেন এবং পুরোহিতদের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেন। এমনকি ফরাসিদের সঙ্গে বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে বেশকিছু গির্জাও নির্মাণ করেন তিনি।
বেশ কয়েকজন ইতিহাসবিদ দাবি করেন, টিপু সুলতানের প্রশাসনিক কাজেও একাধিক হিন্দু কর্মকর্তা যুক্ত ছিলেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম হিসাবরক্ষক কৃষ্ণা রাও, ডাক এবং নিরাপত্তামন্ত্রী স্বামী আইয়েঙ্গার। মুঘল সাম্রাজ্যে টিপুর প্রধান প্রতিনিধি ছিলেন সুজন রায় এবং মূলচান্দ। তাঁর পেশকার ছিলেন সুবা রাও।
টিপু মালয়লি লোকসাহিত্যের অন্যতম নায়িকা উন্নিয়ারচাকে বন্দি করে নিজের প্রাসাদে নিয়ে গিয়েছিলেন বলেও অনেক ঐতিহাসিকের দাবি। উন্নিয়ারচা ছিলেন এক সাহসী যোদ্ধা এবং রূপসী নারী। তিনি দক্ষ ছিলেন মার্শাল আর্টে। উরুমি নামে বিশেষ এক ধরনের তলোয়ার চালাতে দক্ষ ছিলেন তিনি। টিপু যখন মালবার উপকূলে অভিযান চালান তখন তেল্লিচেরি প্রদেশে তাঁর বাহিনীর মুখোমুখি হন উন্নিয়ারচা। তবে নিজের পরিবারকে বাঁচাতে তিনি অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করেন। কথিত শেষ পর্যন্ত উন্নিয়ারচার স্থান হয়েছিল টিপু সুলতানের হারেমে। যেখানে আরও ছশো মহিলা ছিলেন। এও জানা যায়, উন্নিয়ারচাকে বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছিলেন টিপু সুলতান।
আদি কর্নাটক রাজ্য মহীশুর নিয়ে নানা কিংবদন্তি ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের পাতায়। মহীশুরের শাসক ও ‘মহীশুরের বাঘ’খ্যাত টিপু অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ইংরেজ বাহিনী তাঁর দেশপ্রেমকে ভয় পেত। যে কারণে মহীশুরবাসীর অন্তরে টিপু সুলতান আজও অমর হয়ে আছেন।