সংক্ষিপ্ত

  • আবিষ্কারের মুখে দাঁড়িয়ে ইউরেকা বলতে ইচ্ছে করছে
  • কলকাতার এক সামান্য ডাক্তার, পেশার যাবতীয় ঝক্কি সামলে এক শতাব্দী প্রাচীন মিথের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছি

অসিত দাস, কলকাতা: আবিষ্কারের মুখে দাঁড়িয়ে ইউরেকা বলতে ইচ্ছে করছে। হ্যাঁ, আমি কলকাতার এক সামান্য ডাক্তার, পেশার যাবতীয় ঝক্কি সামলে এক শতাব্দী প্রাচীন মিথের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছি। যেখান থেকে সামান্য ধুলো সরালেই ধরা দেবে বাঙালির ইতিহাসের এক অধর অধ্যায়। ব্যারিস্টার জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুরকে নতুন আলোয়  চিনলাম আমি, চেনালামও, চলুন আপনাদেরও হাত ধরে নিয়ে যাই সেইখানে, যেখানে তাঁর নাম আজও ফলকে লেখা। 

জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর কে?

জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুরের একটা পরিচয় জেন ওয়াইকে দিতই হয়। পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুর পরিবারের বিখ্যাত আইনবিদ ও পণ্ডিত প্রসন্নকুমার ঠাকুরের ছেলে জ্ঞানেন্দ্রমোহনের জন্ম ১৮২৬এর ২৪ জানুয়ারি। ঠাকুর্দা ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিন্দু কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা গোপীমোহন ঠাকুর। মাসিক চল্লিশটাকা বৃত্তি পেয়ে তিনি ১৮৪২ সালে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ডাক্তারি পড়া অসম্পূর্ণ রেখে তিনি হিন্দু কলেজে ভর্তি হন।  শিক্ষক রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন ব্যানার্জির হেদুয়ার ডেরায়  গিয়ে তিনি খ্রিস্টানধর্মে দীক্ষিত হন ও কৃষ্ণমোহনের মেয়ে কমলমণিকে বিয়ে করেন। এতে বাবা প্রসন্নকুমার অপ্রসন্ন তো হলেনই, রেগে গিয়ে তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করলেন। ফলে জ্ঞানেন্দ্রমোহন সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত তো হলেনই, ঘরছাড়া হয়ে শিবপুরে রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহনের বাড়িতে থাকতে লাগলেন। এখানে তাঁর পুত্র বরেন্দ্রমোহন ও কন্যা নিত্যেন্দ্রবালা শৈশবেই  মারা যায়। তিনি সস্ত্রীক স্বাস্থ্যউদ্ধারে বিলেত যান ১৮৫৯এ। সেখানে আইন পড়তে শুরু করেন। ১৮৬২ তে ব্যারিস্টারি পাশ করেন লিঙ্কন'স ইন থেকে। তিনি হলেন প্রথম এশীয় ব্যারিস্টার। এরপর লন্ডন  বিশ্ববিদ্যালয়ের  হিন্দু আইনের শিক্ষক হন। ১৮৬৪তে দেশে ফেরেন আর ১৮৬৫ তে কলকাতা হাইকোর্টে প্র্যাকটিশ শুরু করেন। ১৮৬৯এ স্ত্রী কমলমণির মৃত্যু হলে তিনি মেয়ে ভবেন্দ্রবালা আর সত্যেন্দ্রবালাকে নিয়ে বিলেত ফিরে যান। ১৮৮৫ তে ভবেন্দ্রবালার মৃত্যু হয়। জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর জবানবন্দি থেকে জানা যায় ভবেন্দ্রবালা(বলু) ও সত্যেন্দ্রবালা ছিলেন ঠাকুর্দা প্রসন্নকুমার ঠাকুরের মত খর্বকায়। তদুপরি ভীষণ রোগা। তাই দুজনের কারোর বিয়ে হয়নি। কেনসিংটনে ১৮৯০এর ৫ জানুয়ারি মারা যান জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর। মারা তো গেলেন। সমাধি হল কোথায়?

রবীন্দ্রনাথের 'কু-কাজ' ও ঠাকুরবাড়ির বিলেত যাত্রা

হঠাৎ এত বিষয় থাকতে জ্ঞানেন্দ্রমোহনের ব্যাপারেই বা উৎসাহ কেন? এটা ভাবলে কাউকে দোষ দেওয়া যাবে না। আসলে ব্যাপারটি শুরু হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে।প্রশান্তকুমার পালের রবিজীবনী থেকে জানা যায়, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে রক্ষিত দ্বারকানাথ ঠাকুর-বিষয়ক নথিপত্রে নাকি আগুন দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এটার জন্যে দেবেন্দ্রনাথ যেমন দায়ী ছিলেন, দেবেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথও এই কুকাজটি করেন। দ্বারকানাথের সাহেবসুবোপ্রীতি দেখতে পারতেন না দেবেন্দ্রনাথ। তাঁর রেখে যাওয়া ঋণের বোঝার দায়ও দেবেন্দ্রনাথের উপর বর্তেছিল। এই জন্যে যারপরনাই ক্ষুব্ধ দেবেন্দ্রনাথ নথিপত্রে অগ্নিসংযোগ করেন। এটার তবু একটি ব্যাখ্যা আছে, রবীন্দ্রনাথ কেন দাদুর নথিতে আগুন লাগালেন? 

শুধুই কি নীলচাষের কালো অধ্যায় মুছে দেওয়ার জন্যে, নাকি অন্য কোনও কারণ আছে এর? এটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে এক অসমসাহসী সিদ্ধান্তে উপনীত হই। লিখেও ফেলি প্রিন্ট ও বৈদ্যুতিন মাধ্যমে। রবীন্দ্রনাথের নোবেলপ্রাপ্তিতে  দ্বারকানাথের বিলেতের বিদ্বৎসমাজে প্রভাবের কোনও ভূমিকা থাকতে পারে কিনা প্রশ্ন তুলেছিলাম। এর স্বপক্ষে কোনও চিঠিচাপাটি বা নথি থেকে যেতেই পারে হয়ত দ্বারকানাথের সংগ্রহে। কেন না, রম্যা রঁল্যা, চার্ল ডিকেনস, পাঞ্চ পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলির সঙ্গে তাঁর যে সাক্ষাৎ হয়েছিল, তা অনেকেই লিখে গেছেন। তিনি ছিলেন সঙ্গীতরসিকও। তাই কোনও তদ্বিরের চিঠি থেকে থাকতেও পারে। রম্যা রল্যাঁর সঙ্গে পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। নোবেলপ্রাপ্তি যে রবীন্দ্রনাথের স্বোপার্জিত কৃতিত্বে, দ্বারকানাথের কোনও ভূমিকা ছিল না,সেটা প্রমাণের গরজ ছিল হয়ত রবীন্দ্রনাথেরতরফে। তাই দেবেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরে দ্বারকানাথের বেঁচে যাওয়া নথিপত্রে তিনি নিজেই আগুন দিয়ে দিলেন। বলাবাহুল্য এটা লেখার পরে ভীষণ ভাবে সমালোচিত হলাম। অনেকেই রবীন্দ্র-অবমাননার জন্যে কাঠগড়ায় তুলতে চাইলেন। যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা চাইলেন কেউ কেউ।

ইংলন্ডে দ্বারকানাথের মৃত্যু হয়েছিল ১৮৪৬ এ। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পেলেন ১৯১৩ সালে। মৃত্যুর ষাট-সত্তর বছর পরে দ্বারকানাথের কোনও প্রভাব থাকতে পারে কিনা সে প্রশ্নও তুললেন কেউ কেউ। ব্যাপারটা আমায় ভাবিয়ে তুলল। বিলেতে দ্বারকানাথের ছেড়ে যাওয়া ব্যাটন ঠাকুর পরিবারের কেউ বয়ে নিয়ে যেতে হাজির ছিলেন কিনা ভাবতে ভাবতে ভারতের প্রথম আই সি এস রবীন্দ্রনাথের মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা মনে পড়ল। তিনি ১৮৬২তে আই সি এস পড়তে বিলেতে যান। একটু খোঁজখবর নিতেই দেখলাম, তাঁর তিন বছর আগে অর্থাৎ ১৮৫৯ এ পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুর পরিবারের জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে যান। স্ত্রী কমলমণিকে নিয়ে। থাকতেন লন্ডনের কেনসিংটনে। পাশ করার পর মাঝে একবার কলকাতায় ফিরে হাইকোর্টে কিছুদিন প্র্যাকটিস করলেও স্ত্রীর মৃত্যুর পর পাকাপাকিভাবে বিলেত চলে যান। তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক ছিলেন।

এটা বলার উদ্দেশ্য একটাই, দ্বারকানাথ ঠাকুরের মৃত্যুর তেরো বছর পরেই ঠাকুর পরিবারের একজন বিলেতে গেলেন, তার তিনবছর পরে আর একজন গেলেন। যথাক্রমে পাথুরিয়াঘাটা সিনিয়র ব্রাঞ্চের জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর ও জোড়াসাঁকোর জুনিয়র ব্রাঞ্চের সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। দুই ব্রাঞ্চের মধ্যে কিছু তিক্ততা থাকলেও মিলও ছিল। ১৮৭৭ সালে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবীকে সপুত্রকন্যা লন্ডনে পাঠান ইংরেজি শিক্ষা ও সহবতে রপ্ত হতে। কেনসিংটনে জ্ঞানেনন্দ্রমোহনের কাছে ওঠেন জ্ঞানদানন্দিনী। যদিও কিছুদিন থেকে নিজেদের ভাড়াবাড়িতে উঠে যান। ১৮৭৮এ সত্যেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বিলেত যান। রবীন্দ্রনাথ দুবছর থেকে ১৮৮০ তে একসাথে দেশে ফেরেন দাদাবৌদি ভাইপো ভাইঝিদের সঙ্গে। এই ভাইঝিই যে পরবর্তীকালে বিখ্যাত ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী, তা বোঝাই যাচ্ছে। এত ঘটনা বলার একটাই উদ্দেশ্য দ্বারকানাথ থেকে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন শূন্যতা ছিল না, জ্ঞানেন্দ্রমোহন, সত্যেন্দ্রনাথ সেই ফাঁকটি বহুলাংশে পূরণ করেছিলেন। অর্থাৎ বিলেতের সাহিত্য সংস্কৃতির জগতে ঠাকুরপরিবারের প্রভাব থেকে থাকতেই পারে।

ভুল পেরিয়ে আমার যাত্রা 

দ্বারকানাথ ঠাকুরের কেনসাল গ্রিনের সমাধি আর রাজা রামমোহন রায়ের ব্রিস্টলের সমাধি সবাই একডাকে চেনে। জ্ঞানেন্দ্রমোহনের সমাধি হল কোথায়? ইতিহাস নীরব। এদিকে আবার শ্রীপান্থের লেখা 'কলকাতা' বইয়ের একটি তথ্য বিভ্রান্ত করে। তিনি লিখেছেন, তাঁর যতদূর মনে পড়ে লোয়ার সার্কুলার রোডের সমাধিক্ষেত্রে রয়েছে জ্ঞানেন্দ্রমোহনের সমাধি। মারা গেলেন লন্ডনের কেনসিংটনে আর সমাধি কলকাতায়! কীভাবে সম্ভব এটা?

কোথাও কোনো ক্লু না পেয়ে গুগল করলাম কেনসিংটনের কাছাকাছি কোন সেমেট্রি আছে, তা দেখার জন্যে। দেখলাম ব্রম্পটন সেমেট্রি আছে কাছাকাছি। এটি ঠিক কিনা তা দেখার জন্যে আমি ব্রম্পটন সেমেট্রির ওয়েবসাইট খুঁজলাম। কিন্তু টেকনিক্যাল অনভিজ্ঞার জন্যে হাল ছেড়ে দিলাম। ওরে বাবা, ৩৫০০০ সমাধি। কোথায় খুঁজব! এবার ফেসবুকে আমার টাইমলাইনে এবছরের ২৪ মার্চ একটি পোস্ট দিলাম জ্ঞানেন্দ্রমোহনের সম্ভাব্য সমাধি ইংলন্ডের ব্রম্পটনে,একথা জানিয়ে। শ্রীপান্থের কাছে জানার কোনো চান্স নেই, তিনি অনেকদিন আগেই প্রয়াত।

প্রায় তিনমাস পরে একজন ফেসবুক ফ্রেন্ড জানালেন, তিনি ব্রিটিশ সেমেট্রি অথরিটির সঙ্গে কথা বলে জেনেছেন জ্ঞানেন্দ্রমোহনের সমাধি ব্রম্পটনেই। বন্ধুর নামটি জানানো দরকার। গৌরব বিশ্বাস। হালকা বয়সের তরতাজা যুবক। তখন আমরা দুজন মিলে ঠিক করলাম ব্রম্পটন সেমেট্রি অথরিটিকে একটা মেল করা যাক। মেল করার কয়েকদিন পরে উত্তর এল, হ্যাঁ। আছে জ্ঞানেন্দ্রমোহনের সমাধি। সবিনয়ে একটি ছবি পাঠানোর কথা বলা হল। যে ছবি নেটে তন্ন তন্ন করে খুঁজে কোথাও পাওয়া যায় না। অবশেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ছবি পাঠালেন ব্রম্পটন কর্তৃপক্ষ। ঘাসে-আগাছায় ঢাকা পড়া কবর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে ছবি পাঠিয়েছেন। নাম লেখা আছে , GANNENDRO MOHUN TAGORE । প্রায় একশো তিরিশ বছর আগেকার সমাধিটির গায়ে উৎকীর্ণ কয়েকটি অক্ষর কালের করাল গ্রাসে ক্ষয়প্রাপ্ত। তবু তো উজ্জ্বল উদ্ধার সম্ভব হল।

লেখক পরিচিতঃ অসিত দাস পেশায় চিকিৎসক। ইএসআই প্যানেলে কুড়ি বছর চিকিৎসা করেছেন। বর্তমানে প্রাইভেট প্র্যাকটিসনার। তাঁর প্রকাশিত বইগুলি যথা 'এখন কালিকোটির ইতিকথা', 'নামধামের উৎসকথা', 'নেমপ্লেট', 'পঞ্চানন কুশারীর কবিয়ালি' বিশেষ ভাবে সমাদৃত।