সংক্ষিপ্ত

  • করোনাভাইরাস মহামারিতে জর্জড়িত বিশ্ব
  • ২৪ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস
  • শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির কার্যত বন্ধ চলছে অনলাইন ক্লাস
  • ছাত্র ছাত্রীদের দৈনন্দিন সম্পর্কে ছেদ পড়ে

তপন মল্লিক- এখনও বিশ্ব করোনাভাইরাস মহামারিতে জর্জড়িত। পৃথিবীর সব দেশেই কার্যত স্কুল-কলেজসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বন্ধ রয়েছে। এমন একটা প্রেক্ষিতে আজ ২৪ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস।  জাতিসংঘের তথ্য বলছে, করোনা অতিমারির প্রাথমিক পর্ব থেকেই সারা দুনিয়ার ৯০ শতাংশের বেশি ছাত্র-ছাত্রীর সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির সম্পর্ক কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। স্কুল কলেজের সঙ্গে ছাত্র ছাত্রীদের দৈনন্দিন যে সম্পর্ক তাতে ছেদ পড়ে। অর্থাৎ তাদের সেখানে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়, নিজেদের মশ্যে মেলামেশ, ছাত্র-শিক্ষক কথাবার্তা সবই অচল হয়ে পরে। কারণ এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা—সব মহাদেশের প্রায় সমস্ত দেশের স্কুল-কলেজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির দরজা সরকারিভাবে বন্ধ রাখা হয়। অধিকাংশ দেশে সেগুলি এখনও বন্ধই রয়েছে। তবে তুলনায় উন্নত বহু দেশ একটা সময় থেকে তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যে বাড়ি থেকেই যাতে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনা চলে তার জন্য উদ্যোগ নেয়। অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়। 

আরও পড়ুন- নেতাজির জন্মদিনে তাঁর বই ‘দ্য ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল’ নিয়ে অজানা গল্প ...

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী সারা দুনিয়ার প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ছাত্র ছাত্রী অনলাইনে পড়াশুনো করার চেষ্টা করছে। সবাই যে ঘরে বসেই অনলাইনের সুযোগ পাচ্ছেন তা কিন্তু নয়। আমাদের দেশের বহু জায়গায় ছাত্র ছত্রীকে উঁচু গাছের ডালেও উঠতে হচ্ছে টেলি যোগাযোগ পেতে। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক সেই অনলাইন পড়াশোনায় কি সামগ্রিক শিক্ষা অর্জন সম্ভব হচ্ছে? গোড়া থেকেই সেই প্রশ্ন ছিল। কারণ তথ্যপ্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকা দেশেগুলি সেই সুবিধাটুকুও কাজে লাগাতে পারেনি। আমাদের দেশের বহু ছাত্র ছাত্রী সেই সুযোগ থেকে এখনও বহু দূরে রয়ে গিয়েছে। যারা অনলাইনে পড়াশুনা করছে তারাও রয়েছে নানা বিভ্রান্তির মধ্যে। 

আরও পড়ুন- পায়ে হেঁটে পেরিয়েছিলেন কাঁকরভর্তি হিন্দুকুশ পর্বতমালা, দেশের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন 

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি পরিসংখ্যান জানাচ্ছে,  করোনা অতিমারির বহু আগে থেকেই সারা দুনিয়ার প্রায় আড়াই কোটি শিশু স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পায় নি। তাই একথা বলতে অসুবিধা নেই যে করোনাকালেই বিভিন্ন দেশে স্কুলছুটের সংখ্যাটা বাড়তে বাড়তে কোন জায়গায় গিয়ে দাঁড়াবে। এছাড়া উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশে এর সবথেকে বিরূপ প্রভাব পড়বে কন্যাশিশুদের ওপর। বাল্যবিবাহ ও অপরিণত বয়সে মা হওয়ার হার যেমন বাড়বে তেমনই এর সামগ্রিক প্রভাব পড়বে একটি অঞ্চলের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক খাতে। সেভ দ্য চিলড্রেনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনার জন্য প্রায় ৯০ লাখ শিশু শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে চলে যাবে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী অনলাইন ক্লাসের সুযোগ নিতে পারেনি এক তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী। কারণও একটাই, অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করার মতো সুযোগ অর্থাৎ ডিভাইস বা ইন্টারনেট সংযোগ না থাকা। জাতিসংঘের ওই হিসাব থেকেই জানা যাচ্ছে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ ও ইলেকট্রনিক সুবিধা না থাকায় বিশ্বজুড়ে আনুমানিক ৪৬ কোটি ৩০ লাখ শিশু অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারছে না। এতগুলি মাস এত ছাত্র ছাত্রী যে পাঠক্রমের বাইরে থেকে গেল তা তো নিছক একটি সংখ্যা নয়, এটা গোটা বিশবের শিক্ষা সংকট। আগামী কয়েক দশক ধরে সমাজ ও অর্থনীতিতে এর প্রতিক্রিয়া ঘটবে গভীর ও ভীষণভাবে। 

এদেশে করোনা টিকা দেওয়া শুর হওয়ার আগে থেকেই সরকার স্কুল বা অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু এখনও কোনও ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে পারেনি। খবর অনুযায়ী কিছু অঞ্চলে দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির জন্য স্কুল খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দিল্লিতে এমন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গিয়েছে। খবর অনুযায়ী মহারাষ্ট্র, গুজরাট, রাজস্থান ও কর্ণাটকেও খুব তাড়াতাড়ি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পুনের কিছু অঞ্চলে জানুয়ারির শেষেই স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে অভিভাবকেরা আদৌ তাদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাবেন কি না,  তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। এর আগে স্থানীয় কিছু সমীক্ষায় দেখা গেছে, করোনার সংক্রমণ বেশি থাকার সময় বেশিরভাগ অভিভাবকই তাদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতে ইচ্ছুক ছিলেন না। তবে সরকারের তরফে স্কুল কলেজগুলিতে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলা হচ্ছে। বিশেষ করে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা, হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখা ও মাস্ক পরায় কড়াকড়ি থাকবে বলে জানানো হয়েছে। 

কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে যে অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা চলেছে তার প্রভাব থেকেই যাবে। সেই ব্যবস্থার সুবিধাগুলি ছাত্র ছাত্রীরা নেওয়ার চেষ্টাও করবে। কিন্তু সে ব্যবস্থা আগে যাদের ছিল না বা আগামীদিনও থাকবে না তারা কি করবে?  সবার কাছে আধুনিক ডিভাইস কি পৌঁছে দেওয়া যাবে? প্রযুক্তির ব্যবহার কি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীরা পাবে না? ইন্টারনেটের যুগে তাতো আরও সহজলভ্য হওয়া দরকার। জাতিসংঘ আনুমানিক এক হিসাবে জানিয়েছে, মহামারি ঠেকাতে জারি লকডাউন ও স্কুল বন্ধ থাকায় বিশ্বজুড়ে ১৫০ কোটি ছাত্র ছাত্রীর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।  সব দেশের সব অঞ্চলে পরিসংখ্যানটি অবশ্য এক রকম নয়। যেমন আফ্রিকা বা এশিয়ার দেশগুলোর চেয়ে  ইউরোপে ক্ষতিগ্রস্ত ছাত্র ছত্রীদের সংখ্যা অনেকটা কম। এর চেয়েও বড় সমস্যা ছাত্র ছাত্রীদের স্কুল কলেজে না যেতে পারা। ছোটাছুটি করতে না পারা। অবাধ অগাধ মেলামেশা না করতে পারা। ঘরবন্দি মন আর অনলাইন কিংবা নেট দুনয়ায় বিচরণ করতে করতে তাদের মানিসিকতা যে অবস্থায় ইতিমধ্যে পৌঁছে গিয়েছে সেখান থেকে কবে কিভাবে তারা বেরতে পারবে সেটাই সবথেকে বড় প্রশ্নচিহ্ণ।