এককালে রাজনীতির নেতাদের পা-ই পড়ত না টোটোপাড়ায়, এখন সেখানে তৃণমূল বনাম বিজেপি-র লড়াই

ডুয়ার্সের এই অঞ্চলে অসংখ্য ছোট ছোট আদিবাসী রাজ্য ছিল একটা সময়। টোটোদেরও গোষ্ঠীর রাজা ছিলেন। টোটোরা গভীর জঙ্গলে থাকা জীব-জন্তু শিকার করে এবং ফলমূল খেয়েই জীবনধারণ করত। যেহেতু পুরো এলাকাতেই পাহাড়ের ঢাল। সেই কারণে বর্ষা নামলেই এখানে চারিদিকে পাহাড় থেকে জল নেমে আসে। ফলে টোটোদের বাড়িগুলোও বেশ অদ্ভুত।
 

/ Updated: Apr 09 2021, 09:42 PM IST
Share this Video
  • FB
  • TW
  • Linkdin
  • Email

নদী ডিঙিয়ে আমরা এখন চলেছি টোটো পাড়ার উদ্দেশে। আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছে মাদারিহাট থেকে। টোটোপাড়া নামটা শুনলে আজও কেমন যেন একটা অন্ধকার-পাণ্ডব বর্জিত জায়গার ছবি মনে ভেসে ওঠে। আসলে টোটোরা হল এক আদিম জনজাতি। যাদের পাওয়া যায় এই ডুয়ার্সের বুকে। একটা সময় টোটোদের বলা হল বীরের জাতি। ডুয়ার্সের ঘন জঙ্গলে ভুটান সীমান্ত লাগোয়া টোটোপাড়া ছিল এক দূর্ভেদ্য এলাকা। যেখানে যাওয়ার কোনও নির্দিষ্ট রাস্তা নেই। এখনও টোটোপাড়া যেতে গেলে পার হতে হয় এমনই সব পাহাড়ি নদী।  চলার পথে মাঝে মাঝে পড়ে এমন রাস্তা। আসলে টোটোদের উন্নয়নে নানা কাজ হয়েছে গত এক দশকে। জঙ্গলের বুকে চিরে যেখানে যেখানে রাস্তা সম্ভব সেখানে রাজ্য সড়কের মানোন্নয়ন ঘটানো হয়েছে। কিন্তু, টোটোদের গ্রামে যাওয়ার পথে যে পাহাড়ি নদীগুলি রয়েছে তার উপরে ব্রিজ করা সম্ভব হয়নি। ডুয়ার্সের এই অঞ্চলে অসংখ্য ছোট ছোট আদিবাসী রাজ্য ছিল একটা সময়। টোটোদেরও গোষ্ঠীর রাজা ছিলেন। টোটোরা গভীর জঙ্গলে থাকা জীব-জন্তু শিকার করে এবং ফলমূল খেয়েই জীবনধারণ করত। যেহেতু পুরো এলাকাতেই পাহাড়ের ঢাল। সেই কারণে বর্ষা নামলেই এখানে চারিদিকে পাহাড় থেকে জল নেমে আসে। ফলে টোটোদের বাড়িগুলোও বেশ অদ্ভত। পাহাড়ের পাদদেশে জন্মানো এক বিশেষ ধরণের মোটা বাশ দিয়ে তৈরি বাড়িতে বসবাস করে টোটোরা। মাটি থেকে বাঁশের খুঁটি দিয়ে মাচা বানিয়ে, তার উপরে ঘর করার মতো। এতে বর্ষাকালে জল এলেও টোটোদের ঘরে সহজে জল ঢুকতে পারত না। তবে, পাহাড় থেকে ধস নামলে বাড়ির অস্তিত্ব আর খুঁজে পাওয়া যেত না। অবশেষে নদী আর ছোট ছোট টিলার রাস্তার চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আমরা পৌঁছলাম টোটোদের গ্রামে- যার পোশাকি নাম এখনও টোটোপাড়া। সামনে একটা পথ নির্দেশ- যাতে লেখা রয়েছে- দীনেশ টোটো রোড। টোটো পাড়া এভাবেই রাস্তা পাক খেতে খেতে উপরে উঠেছে। কয়েক বছর আগেও এখানে পাকা রাস্তার কোনও বন্দোবস্ত ছিল না। সেই টোটোপাড়ায় এখন দেখা মেলে সাজানো-গোছানো কিছু বাড়ি, জলের পাইপ লাইনের। টোটোদের মূল জীবিকাই পশুপালন এবং এদের জীবন পুরোপুরি বনজ আনাজপাতির উপরে নির্ভরশীল। রয়েছে সুপারির ব্যবসা। এছাড়া রয়েছে কমলালেবু বিক্রি। টোটোপাড়াতে সেভাবে এখন কমলালেবুর চাষ হয় না। পাশেই ভুটান সীমান্ত। সেই সীমান্ত পেরিয়েই কমলালেবু এনে টোটোপাড়ায় তা বিক্রি করা হয়। এমনকী ভুটানের কমলালেবু কিনতে টোটোপাড়াতেও এসে ভিড় করেন মাদারিহাট, শিলিগুড়ির ব্যবসায়ীরা। আমরা প্রথমে টোটোদের যে পাড়াতে প্রবেশ করেছিলাম- তাদের অবস্থা একটু সচ্ছ্বল, ফলে এদের ঘরবাড়ি এখন অনেকটাই উন্নত। ছেলে-মেয়েরাও এখন শিক্ষার আলোয় আলোকিত হচ্ছে। এখানে সেভাবে এখন আর পুরনো টোটোদের যে ঐতিহ্যশালী বাড়ি তা নেই। আর এই উচ্চবিত্ত টোটোদের মধ্যে এখন নেপালি জনজাতিরও প্রবেশ ঘটেছে। টোটো সম্প্রদায়ের মধ্যে এক নতুন একটা জনজাতি জন্ম নিয়েছে যাদের বলা হচ্ছে নেপালি টোটো। অর্থে সেভাবে হয়তো এখনও বলশালী হয়ে উঠতে পারেনি টোটোরা। কিন্তু নিজেদের সামাজিক কাঠামো রক্ষায় তারা বড়ই সচেতন। টোটাদের সমাজে এখনও মেয়েরা মাতব্বর এবং গৃহকর্তার অনুমতি ছাড়াঅন্য কোনও জনজাতির ছেলে বিয়ে করতে পারে না। মেয়েরা এমন কোনও পদক্ষেপ নিলে তাদের সমাজচ্যূত করাটাই নিয়ম। তবে, ছেলেরা চাইলে অন্য সম্প্রদায়ের মেয়েকে বিয়ে করে টোটো সমাজের অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। টোটোদের মধ্যে এখনও পুরুষরা পশুপালন এবং মজদুরি কাজে লেগে থাকে। মহিলারাও কাজ করেন। তবে এদের বেশিরভাগই ছোটোখাটো কাজ এবং দোকান চালানোর মতো কাজে নিয়োজিত হন। টোটোদের মধ্যে সেখানকার স্থানীয় মদের প্রবল জনপ্রিয়তা রয়েছে। এই মদের বিক্রির কাজ মূলত মহিলারাই পরিচালিত করেন। টোটো সমাজে মহিলারা এই কাজকে যথেষ্টই সম্মানের বলে মনে করেন। যার ফলে স্কুল পড়ুয়া মেয়েরাও এই কাজে যুক্ত থাকে। তবে, সময়ের সঙ্গে টোটোপাড়ায় এইসব ভাটিখানার চল কমে আসছে। টোটোদের মধ্যে পড়াশানোর চল বাড়াতে সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। যার ফলে এখানে বেশকিছু প্রাথমিক বিদ্যালয়ও পরিচালনা করা হচ্ছে। এছাড়াও টোটোপাড়া থেকে কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে বেশিকিছু উচ্চবিদ্যালয়। টোটোদের মধ্যে যদিও, ছেলেদের থেকে মেয়েরাই এখনও শিক্ষায় অনেকটা এগিয়ে। টোটোপাড়ায় এমন কিছু মেয়ের সন্ধান মিলেছে যারা স্নাতক স্তরের পড়া শেষ করে এখন কলকাতায় সরকারি পরীক্ষার প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। টোটোপাড়ার আশা আগামীদিনে তাদের এলাকা থেকে আরও ছেলে-মেয়ে উচ্চশিক্ষার দিকে এগোবে। তবে, তাদের অনুরোধ, সরকার যদি সুকাজের বন্দোবস্ত না করে দেয় তাহলে টোটোরা হয়তো আবার সেই আদিম জীবন-যাপনে ফিরে যাবে। টোটোপাড়ায় স্নাতকদের সরকার চাকরি দেবে বলে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তা রক্ষা করতে হবে বলেই তাঁদের মত। সেই সঙ্গে সরকারের কাছে তাদের আর্জি ভুটান জল বন্ধ করে দেওয়ায় টোটোপাড়ায় জলের সঙ্কট রয়েছে। গ্রীষ্মকালে এই সঙ্কট আরও বাড়ছে। তাই টোটোপাড়ায় আরও ২টো বোরিং ওয়াটার পাম্প বসালে এলাকার মানুষের সুবিধা হবে বলে তাঁরা মনে করছেন। টোটোপাড়া পরিক্রমা শেষে এবার ফেরার পালা। দূরআকাশে ভুটানের সীমান্তে পাহাড়ের মাথায় সূর্য তখন অস্তাচলে। ঘরমুখী পশুদের নিয়ে মাঠ থেকে ফিরছেন টোটোরা। শৈশবের দুরন্তপণাকে ছুঁয়ে নিয়ে শুকনো নদীর গর্ভে খুনসুটিতে ব্যস্ত ছোট ছোট টোটো ছেলে-মেয়েরা। একটা সময় যে টোটো পাড়া মানেই ছিল যে অবহেলা আর বঞ্চনার কাহিনি এখন সেখানে শিক্ষায় আলোয় জেগে ওঠার প্রবণতা স্বাভাবিকভাবেই মন ছুঁয়ে যাবে। টোটোদের হাসিমুখ আর এক স্বপ্ন ভরা চোখের অভিজ্ঞতাকে সামিল করে আমরা বিদায় নিলাম। পিছনে টোটোপাড়াকে রেখে গাড়ি ফের ছুটে চলল নদীর ডিঙিয়ে মাদারিহাটের উদ্দেশে।