সংক্ষিপ্ত
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখছেন, " লক্ষ্মীপেঁচা, লক্ষ্মীর পদচিহ্ন আর ধানের ছড়া হল এই আলপনার প্রধান অঙ্গ।" পূর্ববঙ্গে অনেকে লক্ষ্মীপুজোয় মা লক্ষ্মীকে ইলিশ মাছ উৎসর্গ করেন। সেকারণে আলপনাতেও সেই মাছের প্রতিফলন দেখা যায়। লিখছেন অনিরুদ্ধ সরকার
"আঁকিলাম আলপনা, দূরে ফেলি আবর্জনা। শুভ-শুদ্ধ মন নিয়ে, করি তব আরাধনা।” - লক্ষ্মীপুজোর দিন এমন হাজারো গান কিম্বা ছড়া গাইতে গাইতে আলপনা দিতে দেখা যায় গ্রামের কূলবধূদের।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখছেন, " লক্ষ্মীপেঁচা, লক্ষ্মীর পদচিহ্ন আর ধানের ছড়া হল এই আলপনার প্রধান অঙ্গ। বাড়ির সদর দরজা থেকে শুরু করে লক্ষ্মী দেবীর ছোটো ছোটো পদচিহ্ন এঁকে লক্ষ্মীর আসন পর্যন্ত তুলে আনা হয়। কোথাও মূর্তিতে, কোথাও পটে আবার কোথাও বা সরায় দেবীর পূজা হয়ে থাকে। সরা হল মাটির তৈরি ছোটো থালার মতো। লক্ষ্মীর ছবি আঁকা সরাকে বলা হয় লক্ষ্মীসরা।"
গ্রামবাংলার লোকায়ত সংস্কৃতির সাথে লক্ষ্মীপুজো প্রবলভাবে জড়িয়ে আছে। ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে নানারকম রীতি, আচার দেখা যায় আর দেখা যায় নানারকমের আল্পনা যা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে লক্ষ্মীপুজোর সাথে। গ্রামাঞ্চলে এখনও ঘরের উঠোন, সদর দরজা থেকে পুজোর বেদী, ধানের গোলা পর্যন্ত আল্পনায় ধানের ছড়া আর তার দুপাশে ছোট ছোট পায়ের ছাপ এঁকে দিতে দেখার রীতি দেখা যায়। বলা বাহুল্য এটি কেবল কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোতে নয়, পশ্চিমবঙ্গে পৌষ মাসে পালিত লক্ষ্মীপুজোতে বহুলভাবে প্রচলিত।
কলার বেড়ী দিয়ে লক্ষ্মী তৈরি করার প্রথাও বেশ প্রাচীন। কলার বাকলকে গোল করে নারকেলের নতুন কাঠি দিয়ে আটকানো হয়। তাতে সিঁদুর দিয়ে স্বস্তিকা চিহ্ন আঁকা হয়। কলার বাকল দিয়ে তৈরি হয় একটি চোঙাকৃতি ধরন। তা ৯ টি বানানো হয়। অন্যদিকে কাঠের আসনের উপরে লক্ষ্মীর পদচিহ্ন আঁকা হয়। বিভিন্ন ধরনের আলপনা দেওয়ার পর তার ওপরে ওই ৯টি চোঙা রাখা হয়। এই ৯টি বাকলের মধ্যে পঞ্চশস্য দেওয়া হয়।
পুজোয় ব্যবহৃত লক্ষ্মীর প্রতীক হিসাবে লক্ষ্মী সরা সুপরিচিত। মাটির বড় ঢাকনাতে দেবী লক্ষী ও তার সাথে সম্পর্কিত নানা বিষয় যেমন প্যাঁচা, ধানের শীষ, পদচিহ্ন এসব আঁকা হয়। অঙ্কনশৈলীর তারতম্য বিশেষে সরা চার প্রকার – সুরেশ্বরী, ফরিদপুরী, ঢাকাই আর গণকী। ফরিদপুরের সুরেশ্বর গ্রাম থেকেই এর উৎপত্তি, পরে তা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা ও ফরিদপুর জেলার অন্যান্য অঞ্চলে। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর আসন সাধারণভাবে কাঠের বড়ো জলচৌকিতে পিটুলি গোলা দিয়ে আলপনা আঁকার পর সেখানে লক্ষ্মীর সরা বসানো হয়। যার দুপাশে থাকে দইয়ের ভাঁড়। একটি পাত্রের ভেতর পান রাখা থাকে, সঙ্গে থাকে সুপুরি। পরিষ্কার পাত্রে ঝুনো নারকেল ফাটিয়ে তার জলে দেওয়া হয় চিঁড়ে। তার সঙ্গে থাকে কয়েক ছড়া পাকা কলা। ওই আসনেই আর থাকে কলার পেটো দিয়ে তৈরি নৌকো।
মা লক্ষ্মী স্বয়ং পদ্মফুলের উপর অধিষ্ঠিত থাকেন। সেকারণে লক্ষ্মীপুজোয় পদ্ম ফুল আলপনার নকশায় বেশি পরিমানে উঠে আসে।এছাড়া আলপনায় লক্ষ্মীর পা ও ধানের নকশা আঁকা হয়ে থাকে বেশিরভাগক্ষেত্রে। পূর্ববঙ্গে অনেকে লক্ষ্মীপুজোয় মা লক্ষ্মীকে ইলিশ মাছ উৎসর্গ করেন। সেকারণে আলপনাতেও সেই মাছের প্রতিফলন দেখা যায়। আলপনাতেও মাছ আঁকা হয়। মা লক্ষ্মীর বাহন হল পেঁচা। তিনি আসেন পেঁচায় চড়ে, তাই তার নামও লক্ষ্মীপেঁচা। পেঁচাকে শুভ কাজের প্রতীক হিসেব দেখা হয়। তাই পেঁচাও আঁকা হয় লক্ষ্মীপুজোয়। যাকে একটি জনপ্রিয় প্রতীক হিসাবে দেখা হয়ে থাকে।লক্ষ্মীপুজোর আলপনাতে তাই তিনটি ছবিই মূল- প্রথমত লক্ষ্মীর পা, দ্বিতীয় ধানের শীষের এবং তৃতীয় পেঁচা।তবে আজকের আধুনিক ব্যস্ততার যুগে অনেকেই রেডিমেড আলপনা কিনে এনে বসিয়ে দেন। আগামী দিনে হয়ত হারিয়ে যাবে বাঙালির এই আলপনা ঐতিহ্যেও।
আরও পড়ুন- কোজাগরী পূজা কখন হয়, জেনে নিন দেবী লক্ষ্মীর আরাধনার শুভ মুহুর্ত ও গুরুত্ব
আরও পড়ুন- ২০২২ সালের কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর নির্ঘন্ট, জেনে নিন কবে কখন ও ঠিক কটায় হবে দেবীর আরাধনা
আরও পড়ুন- ঘরের এই দিকে প্রতিষ্ঠা করুন দেবী লক্ষ্মীর মূর্তি, সম্পদ ঐশ্বর্যে ভরে উঠবে সংসার