গত বার কংগ্রেসের হাত থেকে অসমের ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল বিজেপি
এবারও তারা ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে কিনা, তা নিয়ে চলছে কাটাছেঁড়া
কিন্তু এই রাজ্যের ভোটের অঙ্কটা বড়ই জটিল
ধর্ম আর ভাষার ভেদাভেদে কীভাবে ঘেঁটে অসমের রাজনীতি, দেখুন
সদ্য শেষ হয়ে গেল আসামের তিন দফা বিধানসভা ভোটগ্রহণ পর্ব। গত বার কংগ্রেসের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া এই রাজ্যে বিজেপি এবারও ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে কিনা, তা নিয়ে চলছে শেষবেলার কাটাছেঁড়া। কিন্তু ধর্ম আর ভাষার ভেদাভেদে অসমের মেরুকরণের রাজনীতি যেভাবে ঘেঁটে আছে, তাতে ভোটের অঙ্ক কষা মুশকিল।
আসামে সবচেয়ে বড় ইস্যু মাইগ্রেশন বা পরিযায়ীরা। দু’ভাবে মাইগ্রেশন হয়েছে এই রাজ্যে। এক, স্বাধীনতার আগে ও পরে দফায় দফায় বাংলাদেশ থেকে বহু মানুষ এখানে এসে বসবাস করছেন। এই বাঙালিদের সঙ্গে অসমীয়াদের বিরোধ বহু দিনের। কিন্তু বাঙালি মানেই যেমন এখানে বাংলাদেশের মুসলিম নয়, আবার অসমীয়া মানেই তেমন হিন্দু নয়। উত্তর-পূর্বের এই রাজ্যে বাঙালি হিন্দু যেমন রয়েছে তেমনই অসমীয়া মুসলিমও রয়েছে। শতাংশের নিরিখে দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুসলিম জনঘনত্ব অসমে, ৩৪.২ শতাংশ। যদিও ২৭টি জেলার মধ্যে ১৫টিতে মুসলিম জনঘনত্ব রাজ্যের গড় হিসাবের তুলনায় কম। কিন্তু বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী ৯টি জেলায় মুসলিম জনঘনত্ব খুবই বেশি। এর কারণ হিসাবে বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের দায়ী করে থাকেন অসমের মূলবাসী। এদিকে, ২০১১ সালের জনগণনার হিসাব অনুযায়ী, এই রাজ্যে ২৮.৯ শতাংশ মানুষ বাংলাভাষী। এরা যে সবাই মুসলিম জনঘনত্ব বেশি থাকা জেলাগুলিতে রয়েছে তা নয়। কারণ বাঙালি হিন্দুও রয়েছে। যেমন ৩টি জেলা নিয়ে গঠিত বারাক উপত্যকা, যেখানে মোট ১৫টি বিধানসভা কেন্দ্র রয়েছে, সেখানে বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যা ৮০.৮ শতাংশ। কিন্তু মুসলিম জনসংখ্যা ৪৮.১ শতাংশ। অর্থাৎ বাকিরা বাঙালি হিন্দু। এই ভাবে মাইগ্রেশন সমস্যার জেরে বাঙালি হিন্দু, বাঙালি মুসলিম, অসমীয়া হিন্দু, অসমীয়া মুসলিম- নানারকম ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে এই রাজ্যের জনজাতি। দ্বিতীয় পরিযায়ী বর্গ হল চা বাগানের শ্রমিক, যারা মূলত ওবিসি সম্প্রদায়ভুক্ত। এরা আর্থিক দিক দিয়ে বা শিক্ষাগত ভাবে একেবারে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির মানুষ। এছাড়াও আসামের একটা বড় অংশে এসটি বা তফসিলি উপজাতির মূলবাসীদের বাস। এদের প্রত্যেকের দাবি-দাওয়া আলাদা। কোনও একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষে সকলের দাবি-দাওয়া মানা সম্ভব নয়। যেমন, দীর্ঘ দিন এই রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা কংগ্রেসের সমর্থন-ভিত্তি হল অসমীয়া ভাষী মুসলিমরা। বাঙালি মুসলিমরা সমর্থন করে বদরুদ্দিন আজমলের দল এআইইউডিএফকে। ২০১৬ সালে এযাবৎকালের সবচেয়ে বেশি ভোটশেয়ার যখন ছিল এআইইউডিএফ-এর, তখনও তারা ২০ শতাংশ ভোট পেয়েছিল বারাক উপত্যকা থেকে। এবং আসনের হিসাব ধরলে ৩১ শতাংশ এই অঞ্চল থেকে পেয়েছিল তারা।
আরও পড়ুন - করোনা আবহে ভোট - মমতার হুঙ্কারেও কমছে না মোদীর সভা, তবে বদলে যাচ্ছে তার চেহারা
এই প্রেক্ষিতে কংগ্রেস-এআইইউডিএফ জোট বাঁধায় শেষ দিকে এসে অসমের নির্বাচনী রাজনীতিতে অন্য মেরু তৈরি হয়ে গেল। কংগ্রেসের এই মহাজোটে সঙ্গী হয়েছে সিপিআই, সিপিএমের মতো বামপন্থী দলগুলি, বড়ো পিপলস ফ্রন্ট (বিপিএফ), আঞ্চলিক গণ মোর্চা (এজিএম) এবং রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি)। জানুয়ারিতে যেখানে মনে হচ্ছিল, বিরোধীশক্তি নেই বলে আসামে বিজেপির ক্ষমতায় আসা একপ্রকার সুনিশ্চিত, গত তিন মাসে ভোটের হাওয়া পর্যবেক্ষণ করার পর তেমনটা বলছে না কেউ।
পাঁচ বছর এত জনকল্যাণমূলক কাজ করার পরেও বিজেপিকে এই শক্ত লড়াইয়ের মুখে পড়তে হল কেন?
আরও পড়ুন - সংক্রমিত অন্তত ৭১ জন - মমতার অভিযোগই কি সত্যি, করোনা সংক্রমণে কতটা দায়ী কেন্দ্রীয় বাহিনী
কারণ, গত কয়েক বছরে বিভিন্ন সম্প্রদায়কে খুশি করতে বিজেপি বিভিন্ন অবস্থান নিয়েছে। যেমন, ১৬০০ কোটি টাকা খরচ করে বিশাল তথ্যভাণ্ডার তৈরি করার পর এখন হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলছেন, আমরা এই এনআরসি মানি না। উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব প্রদানের আইন করার পর বিজেপির মনে হচ্ছে, অসমীয়াদের একটু বেশিই খেপিয়ে ফেলেছে তারা। ফলে বন্ধ হয়ে গিয়েছে সিএএ-র বিধি প্রণয়ন। বাংলার ভোটপ্রচারে মতুয়াদের কাছে গিয়ে অমিত শাহ বলছেন, দ্রুত সিএএ কার্যকর করা হবে। কিন্তু আসামে এই নিয়ে একবারও মুখ খোলেননি তিনি। হিন্দু বাঙালিরা এই দ্বিচারিতাকে ভাল চোখে দেখছে না। হিন্দু অসমীয়াদের দলে টানতে তড়িঘড়ি অসম চুক্তির ছয় নম্বর ধারাকে টেনে তোলা হল। উচ্চ পর্যায়ের কমিটি সুপারিশ করল, অসমীয়ার সংজ্ঞা নির্ধারণে ১৯৫১ সালকে ভিত্তিবর্ষ ধরা হোক। কিন্তু সেই রিপোর্টও শেষমেশ আর বাস্তবের আলো দেখল না। এই ভাবে নানা দোলায় দুলতে গিয়ে বিজেপি তার জনভিত্তিকে নড়বড়ে করে ফেলেছে। হিন্দুত্বের তলায় চাপা পড়ে গিয়েছে আঞ্চলিকতাবাদের রাজনীতি।
সুযোগ বুঝে সেই অস্ত্র কাঁধে তুলে দিয়েছে লুরিনজ্যোতি গগৈয়ের অসম জাতীয় পরিষদ এবং কারাবন্দি অখিল গগৈয়ের রাইজর দল। এবারের ভোটে জোট বেধে লড়ছে তারা। আসন না পেলেও অনেক জায়গায় ভোট কাটাকুটির খেলায় এরা পাশার দান উল্টে দিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। বিজেপির শরিকদের অবস্থাও ভাল নয়। বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে অগপ তার আঞ্চলিকতাবাদের পরিচিতিকে হারিয়ে ফেলেছে অনেকটা। বড়োল্যান্ড অঞ্চলে ইউপিপিএল-এর চেয়ে শক্তিশালী এখন বিপিএফ।
তাহলে কী বিজেপির পক্ষে জয়ের ম্যাজিক ফিগারে পৌঁছনো কঠিন হবে? শেষবেলায় কি বাজিমাত করবে কংগ্রেস?
রাজনীতির কারবারিদের মতে, তত্ত্ব-পরিসংখ্যান যতই কংগ্রেসের পক্ষে থাকুক, বাস্তবে আসামে এই রাজনৈতিক দলের জনভিত্তি অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে। চা বাগানে গিয়ে প্রিয়াঙ্কা বঢরা যতই পাতা তুলুন না কেন এই জনগোষ্ঠী গেরুয়াশিবিরে ঢলে গিয়েছে অনেকদিন। এআইইউডিএফ-এর মতো বাঙালি মুসলিমদের দলের সঙ্গে হাত মেলাতে গিয়ে অসমীয়াদের একটা বড় অংশের বিরাগভাজন হয়েছে কংগ্রেস। তাছাড়া সিএএ বিরোধী যে ভোটের ওপর বড় ভরসা মহাজোটের, তার কিছুটা কেটে নেবে এজেপি-রাইজর দল।
আরও পড়ুন - ভারতী ঘোষের রোডশোতে 'লুঙ্গি পড়া লোক'এর হামলা, পুলিশের সামনেই বেধড়ক মার বিজেপি কর্মীদের
অর্থাৎ দড়ি টানাটানির খেলায় শেষমেশ কে এগিয়ে থাকল, বলা কঠিন। এর জন্য অপেক্ষা করতে হবে ২ মে ভোটের ফল প্রকাশ পর্যন্ত।