দুর্গাপুজোয় কনকনে শীত আর হিমেল বাতাস, হেলসিংবর্গের একেবারে অন্যরকম দুর্গাপুজোয় পুরোহিত হচ্ছেন নারীরা। জেনে নিন সেই অভাবনীয় প্রবাসী পুজোর গল্প।
অক্টোবর এর কনকনে ঠাণ্ডায় হিমেল বাতাসকে উপেক্ষা করেই, ২০১৭ থেকে হইহই করে হেলসিংবর্গ এর বাসিন্দারা দুর্গা পুজো করে আসছেন। দক্ষিণ সুইডেনের হেলসিংবর্গে বেঙ্গলি কালচারাল সোসাইটির পুজো এবার পা দিল ৬ বছরে। এবারের অন্যতম আকর্ষণ থিম পুজো, এইবছরের ভাবনা- ‘আত্মজা’। নারীশক্তির ক্ষমতায়নের প্রতীক থাকছে সাজে, পুজোর আয়োজনে, আর সমগ্র উৎসবের সঞ্চালনায়।
আমাদের 'আত্মজা' পূজিতা হবেন নারী পুরোহিতের হাতেই । যে সকল নারী দশভূজা হয়ে প্রতিনিয়ত ঘর ও বাহির সামলাচ্ছেন নিপুণ হাতে ,তারাই এবার মায়ের পুজোর আয়োজনে অগ্রণী এবং মা পূজিতা হবেন তাঁরই মেয়ের হাতে। সোমা,মহুয়া ও মধুমিতা নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছেন এই গুরুদায়িত্ব।
এইবছর প্রথমবার বেঙ্গলি কালচারাল সোসাইটি অফ সাউথ সুইডেন এর পুজো হবে তিথি মেনে। বিগত সফরগুলিতে ছুটির দিন বেছে পুজো সারা হতো শনিবার ও রবিবার । এবার পুজো ৩ দিন ব্যাপি পালন করা হবে। এবার তিথি অনুযায়ী – সপ্তমীর পুজো সপ্তমীতে , অষ্টমীর পুজো অষ্টমীত, সন্ধ্যেবেলায় সন্ধি পুজো। থাকছে চন্ডীপাঠের বিশেষ আয়োজন। ২রা অক্টোবর থেকে ৪ঠা অক্টোবর পর্যন্ত চলবে পুজোর উদযাপন।
গত ২ বছর করোনার দাপটে, এক সাথে ৫০ জনের বেশি জমায়েতের নিষেধ মেনে পুজো হয়েছে। পুজোর মণ্ডপে একরাশ দর্শনার্থী ঢোকার পর পুরো এলাকা স্যানিটাইজ করে ফের আরেকদল দর্শনার্থী প্রবেশ করানো হত। এ বছর সেই বাধা না থাকায় রয়েছে বাড়তি উৎসাহ ও উন্মাদনা।
সাউথ সুইডেন বেঙ্গলি কালচারাল সোসাইটির আয়োজকরা প্রবাসে সকলে মিলে এই পুজোর আয়োজন করে। এই দূরপ্রান্তরের পুজোর জোগাড় করা বেশ কঠিন হয়ে ওঠে। প্রবাসে মূর্তি প্রতি বছর আনানো সম্ভব হয় না, তাই একই মূর্তিতে মায়ের আরাধনা হয়ে এসেছে বিগত বছরগুলোতে। প্রতিবছর অত্যন্ত সুব্যবস্থায় সংরক্ষণ করে রাখা হয়ে মায়ের মূর্তি পরের বছরের জন্য। সাউথ সুইডেনে অক্টোবর মাসে বেশ ঠাণ্ডা, সেই জন্যে খোলা মাঠে পুজো করা সম্ভব হয় না এখানে, কমিউনিটি হল ভাড়া করে দুর্গা মায়ের পুজো সম্পন্ন করতে হয়।
বাংলা থেকে দূরে এই উদ্দীপক পুজোর দিনগুলো কাটে দারুণ হৈ-হুল্লোড়ের মধ্যে দিয়ে। সকলে মিলে পুজোর জোগাড় করা, অতিথি ও দর্শকদের আপ্যায়ন, ভোগ রান্না, কবজি ডুবিয়ে খাওয়া দাওয়ার পাশাপাশি চলে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বড় এবং ছোট সদস্যদের নিয়েই হয়ে আবৃত্তি, গান, নাচ আর নাটকের অনুষ্ঠান। সন্ধ্যাগুলোতে সুন্দর অনুষ্ঠান উপহার দিতে প্রস্তুতি চলে প্রায় মাস খানেক ধরে। সঙ্গে থাকে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা যেমন ধুনুচি নাচ, মোমবাতি জ্বালানো, সেরা জুটি ইত্যাদি।
'বারে বারে মা আবার এসো ফিরে', এই বার্তা মনে রেখে প্রতি বছর খুব জাঁকজমক, নাচে গানে বিসর্জনের আগে দেবী বরণ ও সিঁদুর খেলার অনুষ্ঠান করে মাকে বিজয়া জানানো হয়। এ কদিন আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে কাজ ভুলে পুজোয় মেতে ওঠেন সাউথ সুইডেনের প্রবাসী বাঙালিরা। আশেপাশের শহরগুলি থেকে বাঙালিরা এখানে পুজো দেখতে আসেন। ভেদাভেদ ভুলে এই মিলন উৎসবে দু’পার বাংলার বাঙালীদের সঙ্গে যোগ দেন বেশ কিছু অবাঙ্গালি পরিবারও। এই দুর্গাপুজোর অনুষ্ঠানে ভারতের অন্যান্য প্রদেশের মানুষ, সুইডেনের বাসিন্দা ও বিদেশীদের উপস্থিতি উৎসবের এই সেরা প্রাঙ্গনকে যেন আরও আলোকময় করে তোলে। উৎসব প্রাঙ্গন হয়ে ওঠে সত্যিকার বিশ্বায়নের প্রতিচ্ছবি।
ষষ্ঠী থেকে দশমী এখানে রকমারি ভোজের ব্যবস্থা থাকে । এ বছর মেনুতে থাকছে ছানার ডালনা ,আলু ফুলকপি, কাশ্মীরি আলু,মাছ, কষা মাংস, পোলাও, বিরিয়ানি ও মিষ্টি।
উজ্জ্বল ফটো এবং ভিডিও ছাড়া কোনো অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ হয় না। আমাদের ফটোগ্রাফারদের নিরলস প্রচেষ্টা আমাদের পরবর্তী দিনগুলোকে আনন্দে ভরিয়ে রাখার জন্য আরও স্মৃতি তৈরি করতে সাহায্য করে এবং পুজোপরবর্তী আলোচনার জন্য আলোচিত বিষয় হয়ে ওঠে।
বেঙ্গলি কালচারাল সোসাইটি অফ সাউথ সুইডেনের সচিব সৌমেন দত্ত বলেন ”প্রথম বছর থেকে আমাদের পুজোর প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বাঙালি অবাঙালি সবার একত্রিত সমন্বয়ে বঙ্গ মহোৎসব উৎযাপন করা। প্রতিবছর আমাদের দুর্গা পুজোর কমিটির উদ্দীপনা, উত্তেজনা পুজো পরিকল্পনার সাথেই শুরু হয়ে যায়। কমিটির বাইরেও অনেকে আমাদের নানাভাবে সাহায্য করে থাকে এই পুজোকে সাফল্যমন্ডিত করে তোলার জন্য। প্রতি বছর ভারতের বাইরে এরকম এক পুজোর আয়োজন করা খুব সহজ হয়না। পুজোর উপকরণ রীতি নীতি সব মেনে প্রস্তুত হতে আমাদের কয়েক মাস সময় লেগে যায়, সাথে দুপুর-রাতে চলতে থাকে একসাথে বাঙালি ভোজ ও মিষ্টিমুখ। কিন্তু সবাই হাতে হাত লাগিয়ে, বিভিন্ন পুজোর বিভাগ বিতরণ করে সুন্দরভাবে আমরা পুজোর দিনগুলো সংগঠিত করে তুলি। পুজোর ভোগ অনেকেই স্ব-ইচ্ছায় বাড়ি থেকে প্রস্তুত করে এনে পরিবেশন করেন, আর থাকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আড্ডা, ধুনুচি নাচ, বরণ, সিঁদুর খেলা, ভাসান-নৃত্য। বছর বছর ধরে একটু একটু করে চলতে চলতে ষষ্ঠ বছরের গণ্ডি পেরোচ্ছে আমাদের দুর্গোৎসব, আর বাংলার এই প্রধান উৎসবের সাফল্যের ভাগিদার অবশ্যই দক্ষিণ সুইডেনের ভারতীয়দের সবার উদ্যোগ।”
বেঙ্গলি কালচারাল সোসাইটি অফ সাউথ সুইডেনের ভাইস প্রেসিডেন্ট কথিকা পাল বলেন ”দুর্গাপুজো মানেই বাঙালির প্রাণের উৎসব, আজন্ম পালিত এক আবেগ, যার সাথে ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে পরতে পরতে। সে দেশই হোক, বা প্রবাসের প্রান্তরে। শরতের বাতাসে হিমেল পরশ যতই তীব্র হোক না কেন, দক্ষিণ সুইডেনবাসী বাঙালীদের উন্মাদনা তাকে টেক্কা দেয়। সেই ঐতিহ্যকে পাথেয় করে বেঙ্গলি কালচারাল সোসাইটির ষষ্ঠ বর্ষের পরিবেশনা 'আত্মজা' যেখানে মহামায়া পূজিতা হবেন মেয়ের হাতে। এই উদ্যোগ নারী সশক্তিকরণের, যেখানে নেই লিঙ্গ বা জাতি বৈষম্যের বেড়াজাল। তাই নারী এই পুজোর আয়োজন থেকে পৌরহিত্য থেকে সব ক্ষেত্রে অগ্রণী। ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমি খুবই উদ্দীপিত এই রকম এক উদ্যোগের অংশীদার হতে পেরে। সকলে আমাদের পাশে থেকে অনুপ্রাণিত করবেন এই আশাতেই আমদের পথ চলা।”
আরও পড়ুন-
কেবলমাত্র কল্লোলিনী কলকাতা নয়, দিলওয়ালো কা দিল্লিতেও দুর্গাপুজো ছাড়িয়েছে একশো বছর, রইল সেরা মণ্ডপগুলির হদিশ
‘সিটি অফ জয়’ থেকে ‘সিটি অফ ড্রিমস’, দুর্গাপুজোর আমেজ স্বপ্নের মুম্বইতেও, জেনে নিন এখানকার পুজোর বিশেষত্বগুলি
দুর্গাপুজোয় প্যাচপ্যাচে কাদা, নাকি কাঠফাটা রোদ্দুর? কবে ঠাকুর দেখতে পারবেন, জেনে নিন আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাস