কালীঘাটের সেবক হালদারদের সংবাদ পাঠালেন মহারাজা, তারাপীঠের বামাক্ষ্যাপাকে নিয়ে তিনি যাচ্ছেন কালীঘাটে। মহারাজ সেবাইতদের নির্দেশ দিলেন একঘণ্টা যেন মন্দিরে কোনও যাত্রী প্রবেশ করতে না পারে। আর সে ব্যবস্থার জন্য সেবাইতদের অনেক টাকাও দিলেন মহারাজ।
বামাক্ষ্যাপাকে (Great Saint Bamakhyapa) দেখে কালীঘাট মন্দিরে (Kalighat temple) উপচে পড়ল ভিড়। রাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের অনুরোধে তারাপীঠ (Tarapith) থেকে কলকাতা (Kolkata) এসেছিলেন সাধক বামাক্ষ্যাপা কিন্তু কেন? বামাক্ষ্যাপা চেয়েছিলেন কালীঘাটের মাকালীকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে তারপর কি হল? ইতিহাসে হারিয়ে যাওয়া সেই গল্পই শোনাচ্ছেন অনিরুদ্ধ সরকার।
১৮৯৮ সাল। তারাপীঠের মহাসাধক বামাক্ষ্যাপা পদধূলি দিতে এলেন পাথুরিয়াঘাটার মহারাজা যতীন্দ্র মোহন ঠাকুরের রাজপ্রাসাদে (The King Of Pathuriaghata Jatindramohan Thakoor)। রানি ভিক্টোরিয়ার (Queen Elezabeth) কাছ থেকে তিনি পেয়েছিলেন 'মহারাজ' উপাধি। যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের কোনো পুত্রসন্তান ছিল না। আর সেকারণে তিনি ভ্রাতুষ্পুত্র প্রদ্যোৎকুমারকে দত্তক নিয়েছিলেন। যতীন্দ্রমোহনের মনে তাও একটুও শান্তি ছিল না। যতীন্দ্রের ভাগনে সত্যনিরঞ্জনের যাতায়াত ছিল তারাপীঠে। প্রায়শই সে চলে যেত তারাপীঠে। একদিন সে বামাক্ষ্যাপাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিল। সত্যর মুখে বারেবারে বামাক্ষ্যাপার কথা শুনে আকৃষ্ট হয়েছিলেন যতীন্দ্রমোহন। ভাগনেকে দিয়ে তাই বামাক্ষ্যাপাকে নিজের বাড়ি আনানোর চেষ্টা করলেন। বার দুয়েক চেষ্টা করে বিফল হলেন সত্যনিরঞ্জন। তারপর একদিন হঠাৎ বামাক্ষ্যাপার কি খেয়াল হল চলে এলেন যতীন্দ্রের বাড়ি। যতীন্দ্র তো অবাক। তিনি ভাবতেই পারেন নি তাঁর বাড়িতে বামাক্ষ্যাপা আসবেন। বামাক্ষ্যাপা প্রাণভরে আশীর্বাদ করলেন যতীন্দ্রকে।
আরও পড়ুন-Kali Puja 2021- পুরুলিয়ার এই গ্রামে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াতেন মা কালী
সাধক বামাক্ষ্যাপা তারাপীঠ থেকে কলকাতা এসেছেন আর উঠেছেন যতীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাগাননাড়ি মরকতকুঞ্জে এখবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে খুব একটা সময় লাগল না। দেখতে দেখতে শুরু হল জনপ্লাবন। বামাক্ষ্যাপা এত লোকের ভিড় দেখে গেলেন ক্ষেপে। বললেন ‘অনেক হয়েছে, এবার তারাপীঠ ফিরে চল। ভিড় আমার ভালো লাগে না।’। কিন্তু মহারাজ চান আরও দিনকয়েক বাবা মহারাজের কাছে থাকুন। বামাক্ষ্যাপা তাতে একেবারেই রাজি হলেন না। তখন মহারাজ ঠিক করলেন কালীঘাটের নাম করে যদি বামাক্ষাপাকে আটকানো যায়। মহারাজা অনুরোধ করলেন বামক্ষ্যাপাকে। কি খেয়াল হল কালীঘাটের কথা শুনে বামাক্ষ্যাপা একটু থমকে গেলেন। বামাক্ষ্যাপার কাছে তারাপীঠের মা'তারা হলেন 'বড়মা' আর কালীঘাটের কালীমা হলেন 'ছোটমা'। কালীঘাটে মাতৃদর্শনের টানে তারাগতপ্রাণ ক্ষ্যাপাবাবা থেকে গেলেন রাজার কাছে চারটে দিনের জন্য।
কালীঘাটের সেবক হালদারদের সংবাদ পাঠালেন মহারাজা, তারাপীঠের বামাক্ষ্যাপাকে নিয়ে তিনি যাচ্ছেন কালীঘাটে। মহারাজ সেবাইতদের নির্দেশ দিলেন একঘণ্টা যেন মন্দিরে কোনও যাত্রী প্রবেশ করতে না পারে। আর সে ব্যবস্থার জন্য সেবাইতদের অনেক টাকাও দিলেন মহারাজ।
আরও পড়ুন- KaliPuja 2021-মুসলিম জমিদারের হাতে শুরু হয় তিন বোনের বুড়ি কালী পুজো
ভোরের দিকে গাড়ি করে কালীঘাট পৌঁছলেন বামাক্ষ্যাপা। হালদাররা সপরিবারে সবাই মন্দির প্রাঙ্গণে উপস্থিত। সবাই প্রণাম করলেন শ্রদ্ধাভরে। এদিকে উপস্থিত অগুনতি ভক্তরা খবর পেয়ে হাজির হয়েছেন কালীঘাট মন্দির চত্বরে। এমনকি পথ যাত্রীরাও বামাদর্শনে উদগ্রীব। বামাক্ষ্যাপা মন্দিরে প্রবেশ করে দেখলেন গর্ভমন্দির শূন্য। একটি লোকও নেই। আশপাশের লোকজনদের জিজ্ঞেস করে জান তে পারলেনন, তাঁর মন্দির দর্শনের কারণে সাধারণ ভক্তদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। বামাক্ষ্যাপা রেগে গেলেন। আর উচ্চকণ্ঠে বললেন, " যে কোনও তীর্থে সকলেরই সমান অধিকার। এ তোমরা বড় অন্যায় করেছো। আমি সবার সঙ্গে আমার ছোটোমাকে দর্শন করব।" উপস্থিত রাজা যতীন্দ্রমোহন ঘাবড়ে গেলেন। সঙ্গেসঙ্গে মন্দিরের দ্বার অবারিত হল সকলের জন্য।
বামাক্ষ্যাপা গিয়ে দাঁড়ালেন কালীমূর্তির সামনে। আর জয়ধ্বনি তুললেন- জয় তারা..জয় তারা... জয় জয় তারা।" উপস্থিত ভক্তরাও 'জয় তারা'র আওয়াজ তুললেন বামাক্ষ্যাপার সঙ্গে সঙ্গে। ক্ষ্যাপাবাবা তারপরই মায়ের দিকে তাকিয়ে ভাবে বিভোর হয়ে বললেন, "চল না মা, তোকে তারা মা’র কাছে কোলে করে নিয়ে যাই।" আর এই বলে পাষাণময়ী বিগ্রহকে কোলে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন। আর তা দেখে বামদেবকে বাধা দিলেন কালীঘাট মন্দিরের পূজারিরা। বামাকে স্পর্শ করতে দিলেন না বিগ্রহ।
আরও পড়ুন- Kali Puja 2021- একই মন্দিরে কালীর সঙ্গে পূজিত হন পীর বাবা
ব্যাস! দিব্যভাবে ভাবিত বামার ঘোর গেল কেটে। বাধা পেয়ে সাধক বামাক্ষ্যাপা শ্মশানচারী তান্ত্রিকের রুদ্রমূর্তি ধারণ করলেন। চোখ লাল।জটা খুলে ফেলেছেন। বামদেবের ভয়ঙ্কর রূপ দেখে সবাই ভয় পেয়ে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইতে লাগল। রাজা এসে পায়ে ধরলেন বামাক্ষ্যাপার।মন্দিরের পরিবেশ তখন বেশ গম্ভীর। ভক্তরা নীরব। দর্শনার্থী যাত্রীরা ভীত, বিহ্বল। হালদারমশাইরা সমানে ভর্ৎসনা করলে লাগলেন পুরোহিতদের। তারপর বামাক্ষ্যাপার কাছে গিয়ে রাজা অনুরোধ করলেন, ‘ বাবা, আপনি স্পর্শ করতে পারেন মাকে।’
হঠাৎ কি হল কে জানে বামদেব একেবারে শান্ত হয়ে গেলেন। মাকালীর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন।তারপর বললেন, ‘চাই না তোদের এই রাক্ষসী কালীকে, যেমন কেলে রূপ, তেমনি লকলকে, মস্ত জিভ, যেন গিলতে আসছে। আহা, আমার তারা মা’র যেমন ছোট্ট জিভ তেমন রূপের ছটা, মাথায় জটা, পা দু’খানি খুরখুরে। চাই না তোদের কেলে কালী, আমার আকাশ তারাই ভালো’। এই বলে সরে গেলেন কালীমায়ের কাছ থেকে।