Khudiram Bose: গোয়েন্দা গল্পের প্রেমী থেকে বিপ্লবী হয়ে ওঠার অধ্যায়টা কেমন ছিল ক্ষুদিরাম বসুর জেনে নিন

'ক্ষুদ দিয়ে কেনা’ হয়েছিল বলে ছেলের নাম রাখা হয়েছিল ‘ক্ষুদিরাম। ভালো বাঁশি বাজাতে পারতেন। ডিটেকটিভ বই পড়ার নেশা ছিল ক্ষুদিরামের। তখনকার দিনের বিখ্যাত গোয়েন্দা গল্পের লেখক পাঁচকড়ি দে’র গল্প ছিল তাঁর খুব প্রিয়।  ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনের সর্বকনিষ্ঠ শহীদ বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর জীবনের অজানা কথা শোনাচ্ছেন অনিরুদ্ধ সরকার।। 

Web Desk - ANB | Published : Dec 3, 2021 10:32 AM IST / Updated: Aug 07 2022, 06:57 PM IST

মেদিনীপুর শহরের প্রসিদ্ধ সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরে রোজ লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী (Laxmipriya devi) পুজো দেন একটি পুত্র  সন্তানের জন্য। লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবীর (Laxmipriya devi) তিনটিই কন্যা সন্তান – অপরূপা, সরোজিনী ও ননীবালা। লক্ষ্মীপ্রিয়ার কোনো পুত্রসন্তানই বাঁচত না। দু’দুটি পুত্র জন্মানোর অল্পদিনের মধ্যেই মারা যায় সেকারণে একটি পুত্রের জন্য  লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী (Laxmipriya devi) রোজ মন্দির যেতেন। লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবীর স্বামী ত্রৈলোক্যনাথ বসু (Laxmipriya devi's husband Trailokyanath Basu) ছিলেন নাড়াজোল রাজ এস্টেটের কর্মচারী’। 

দেবী একদিন শুনলেন লক্ষ্মীপ্রিয়ার (Laxmipriya devi) কাতর আর্জি। আর ১৮৮৯ সালের ৩ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার লক্ষ্মীপ্রিয়ার (Laxmipriya devi) কোল আলো করে এল একটি ফুটফুটে পুত্রসন্তান।  যে নারীর সন্তান বাঁচে না, তাঁর কাছ থেকে অন্য লোকে সন্তান কিনে নিলে সে সন্তানের নাকি গোত্রন্তর ঘটে, তাঁর মৃত্যুভয়ও নাকি কেটে যায়, সে সন্তান দীর্ঘজীবন লাভ করে এই প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী জন্মমুহূর্তেই তিন মুষ্টি ক্ষুদ দিয়ে মায়ের কাছ থেকে সসদ্যোজাত ছেলেকে কিনে নেন তাঁর বড়দিদি অপরূপা। ‘ক্ষুদ দিয়ে কেনা’ হল বলে ছেলের নাম রাখা হয়েছিল ‘ক্ষুদিরাম (Khudiram Bose)।

ক্ষুদিরাম (Khudiram Bose) যে স্কুলে পড়তেন সেই স্কুলের এক শিক্ষক একবার ছাত্রদের হাতের জোর পরীক্ষা করবেন বলে ঠিক করলেন। শিক্ষকমহাশাই ছাত্রদেরকে ক্লাসের একটি  টেবিল দেখিয়ে বললেন, "দেখি তোমরা কে কত জোরে এই টেবিলে ঘুষি মারতে পারো।" শিক্ষকমহাশয়ের নির্দেশে ছাত্ররা টেবিলে ঘুষি মারতে শুরু করে। ছাত্ররা সাত-আটটা ঘুষি মেরে হাতের ব্যাথায় কাতর হয়ে পড়লে। এগিয়ে এল ক্ষুদিরাম (Khudiram Bose)। টেবিল কাঁপিয়ে ঘুষি মারতে শুরু করে। মারছে তো মারছেই – থামার নাম নেই। ক্লাসের শিক্ষক থেকে ছাত্র, সবাই বিস্ময়ে হতবাক। একে একে তিরিশ-চল্লিশটি ঘুষি মেরে ফেলেছে তখন ক্ষুদিরাম। হাতের মুঠো ফেটে তার রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। শিক্ষক এগিয়ে এসে ক্ষুদিরামের হাত আগলে ধরে তাঁকে ক্ষান্ত করলেন।

টিফিনের সময়ে স্কুলের গেটে খাবার বিক্রি করতে আসত এক ফেরিওয়ালা। স্কুলের ছাত্ররা তাঁর কাছ থেকে ভীড় করে খাবার কিনত – চালভাজা, মটরভাজা, ছোলাভাজা এইসব। একদিন স্কুলের একটি ছাত্র তাঁর কাছ থেকে খাবার কেনার পরে ফাউ হিসেবে একটু বেশি চেয়েছিল। এই ছিল তার অপরাধ। ফেরিওয়ালা তাঁকে ফাউ না দিয়ে গাল দিয়ে ফেলল। অপমানও করল ছেলেটিকে। ক্ষুদিরামের (Khudiram Bose) কানে গেল সেকথা। টিফিন সময় শেষ হলে সেই ফেরিওয়ালা ঝাঁকা তুলতে গেলে ক্ষুদিরাম এসে সেই ঝাঁকাওয়ালার ঝাঁকায় মারল সজোরে এক লাথি। সব খাবার গেল মাটিতে পড়ে। ফেরিওয়ালা নালিশ জানালো স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে। ক্ষুদিরামের (Khudiram Bose) ডাক পড়ল। ক্ষুদিরাম (Khudiram Bose) একটুও ভয় না পেয়ে সব সত্যি ঘটনা জানালেন প্রধান শিক্ষক মহাশয়কে। শিক্ষক মশাই একটু বকাবকি করলেও অবাক হয়েছিলেন ওইটুকু বালকের সততা ও স্পষ্টবাদিতায়। বন্ধুরা স্কুল ছুটির পরে চাঁদা তুলে ক্ষুদিরামকে মিষ্টি খাইয়েছিল।

মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র যখন ক্ষুদিরাম (Khudiram Bose), তখন সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন রাজনারায়ণ বসু (Rajnarayan Basu)। যিনি ছিলেন বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের মাতামহ। রাজনারায়ণ বসুর (Rajnarayan Basu) এক ভাইপো জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন সেই স্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক। এঁরা দুইজনেই ছাত্রদের মনে দেশপ্রেমের ভাবনা জাগিয়ে তুলতেন। মেদিনীপুর বিপ্লবী গুপ্ত সমিতির দায়িত্বে তখন জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু (Ganendranath Basu), তাঁর ভাই সত্যেন্দ্রনাথ বসু (Satyendranath Basu) ও হেমচন্দ্র কানুনগো (Hemchandra Kanungo)। জ্ঞানেন্দ্রনাথ ক্ষুদিরামকে একদিন নিয়ে গেলেন বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথের কাছে। সত্যেন্দ্রনাথের তত্বাবধানে বিপ্লবী সমিতির গোপন আখড়ায় শরীরচর্চা শুরু করেল ক্ষুদিরাম (Khudiram Bose)।এছাড়া বন্দুক-রিভলবার চালানোর গোপন শিক্ষাও  নিতে লাগলো সে।

নানা কারণে বাড়ি ফিরতে রোজই অনেক রাত হত ক্ষুদিরামের (Khudiram Bose)। দিদি-জামাইবাবুর যাতে অসুবিধা না হয় বা ঘুম না ভাঙে তারজন্য একটি অদ্ভুত কৌশল বের করেছিল ক্ষুদিরাম (Khudiram Bose)। তাঁর শাগরেদ-ভাগ্নে ললিতমোহন পায়ে একটা দড়ি বেঁধে বাইরের ঘরে শুত। দড়ির অন্যপ্রান্ত থাকত জানলার বাইরে। ক্ষুদিরাম (Khudiram Bose) দরজার কড়া না নেড়ে সেই দড়ি ধরে টানত। পায়ে দড়ির টান লাগলে ঘুম ভেঙে যেত ললিতমোহনের। সে উঠে দরজা খুলে দিত। তা একদিন এভাবে বাড়ি ঢুকতে বেশ দেরি হয়ে গেছে ক্ষুদিরামের (Khudiram Bose)। রাতের খাবার নেই। ক্ষিধের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে, ক্ষুদিরাম (Khudiram Bose) ভাগ্নে ললিতকে নিয়ে বের হল। তাঁদের বাড়ির পাশেই থাকতেন কুসুমকুমারী নামে এক দরিদ্র মহিলা। তিনি কলাইয়ের বড়ি বাজারে বিক্রি করে কোনমতে পেট চালাতেন। সেই রাতে কুসুমকুমারী তখনও কলাইয়ের ডাল বাটছিলেন বড়ি দেওয়ার জন্য। অত রাতে দু’জনকে রাস্তায় দেখে কুসুমকুমারী বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে? ক্ষুদিরাম (Khudiram Bose) এগিয়ে গিয়ে বলল ক্ষিধে পেয়েছে। একটু খাবার পেলে ভালো হয়।

সব শুনে কুসুমকুমারী নিজের বাড়িতে থাকা সামান্য খাবার দিলেন ক্ষুদিরাম ও ললিতকে। কুসুমকুমারী দেখলেন ললিত খাবার নিলেও ক্ষুদিরাম (Khudiram Bose) খাবার নিচ্ছে না। কুসুমকুমারী কারণ জিজ্ঞেস করলে ক্ষুদিরাম কুসুমকুমারীর হাতের বিলাতি কাঁচের চুড়ির দিকে নির্দেশ করে বলল, "এর জন্য! তখন স্বদেশী আন্দোলনের সময়। বিলাতি জিনিষ বর্জনের জোর হওয়া বইছে চারিদিকে। বিলাতী চুড়ি পড়া হাতের খাবার কিভাবে খাবে ক্ষুদিরাম? কুসুমকুমারী ক্ষুদিরামের (Khudiram Bose) কথা বুঝলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঘরের ভেতর গেলেন আর একটা লোহার যাঁতি এনে ক্ষুদিরামের (Khudiram Bose) সামনেই ভেঙে ফেললেন দু’হাতের বিলাতী কাঁচের চুড়ি। হাত কেটে রক্ত ঝরতে লাগল কুসুমকুমারীর। ক্ষুদিরামের (Khudiram Bose) চোখে জল। খাবার গ্রহণ করল ক্ষুদিরাম। 

১৯০৮ সালের ২৫ এপ্রিল ক্ষুদিরাম কলকাতায় (Khudiram Bose) এসে পৌছল। কলকাতায় গোপীমোহন দত্তের ১৫ নম্বর বাড়িটি ছিল তখন বিপ্লবীদের তীর্থক্ষেত্র। সেখানে বসেই হেমচন্দ্র ও উল্লাসকর শক্তিশালী তৈরী করতেন। তাঁরা বই বোম বানিয়েছিলেন। বই বোম অর্থাৎ যে বোমা বইয়ের ভাঁজে রাখা যেত। সেই বোমই ব্যবহার করা হল অত্যাচারী কিংসফোর্ডকে হত্যায়। কৌশলে একটি বই কিংসফোর্ডের কাছে পাঠানো হল। কিন্তু কিংসফোর্ড বই না খোলার কারণে সে যাত্রায় বেঁচে গেলন। তারপর কিংসফোর্ডকে হত্যার দায়িত্ব নিল ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকী Khudiram Bose & Prafulla Chaki)। ১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল, রাত ৮টায় বোম ছুঁড়ল দুই বিপ্লবী। ভুলবশত সেই বোমা গিয়ে যে গাড়িতে পড়ল সেই ফিটন গাড়িতে কিংসফোর্ড ছিলেন না। ছিলেন দু’জন বিদেশিনী। এই ঘটনায় নিহত হলেন মিসেস কেনেডি আর তাঁর কন্যা ও এক চাকর। এরপরের ঘটনা আজ ইতিহাস। ১৯০৮ সালের ১১ অগষ্ট হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চে জীবন উৎসর্গ করলেন ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনের সর্বকনিষ্ঠ শহীদ বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু (Khudiram Bose)। 

আরও পড়ুন- Sekaler Golpo: বঙ্গ পুত্র অধ্যাপক জগদীশ চন্দ্র বসুর জীবনের এক অজানা অধ্যায়ের সন্ধান

আরও পড়ুন- Kanailal Dutta- স্বাধীনতার দাবিতে ২০ বছরে ফাঁসি বরণ, কানাইলালের চিতাভষ্ম কিনতে মানুষ দর হেকেছিল

আরও পড়ুন- Deshbandhu Chittaranjan : এক চিরদাতা, নিজেকে নিঃস্ব করে দিতে ভালোবাসতেন দেশবন্ধু

Share this article
click me!