Sekaler Galpo- অশোক ও কিশোর কুমারের প্রপিতামহ ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রের সহপাঠী

'দাদামণি' অশোক কুমারের প্রপিতামহ মানে মায়ের ঠাকুরদা ছিলেন ভাগলপুরের রাজা শিবচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।ভাগলপুরের বিখ্যাত জমিদার ছিলেন শিবচন্দ্রের পিতা। জেনে নিন সেকালের এই অজানা গল্প

Asianet News Bangla | Published : Nov 15, 2021 8:59 AM IST

অশোক কুমারের প্রপিতামহ জমিদার শিবচন্দ্র ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রের সহপাঠী। শিবচন্দ্র ও বঙ্কিমচন্দ্র দুই সহপাঠী একসঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন। বঙ্কিম ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি নিয়েছিলেন আর পিতার নির্দেশ শিবচন্দ্র ভাগলপুর ফিরে জমিদারির হাল ধরেন।
শিবচন্দ্রের বাড়ির বৈঠকখানায় নিত্য আনাগোনা ছিল ঔপন্যাসিক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, সাহিত্যিক বনফুল থেকে রহস্য গল্প লেখক হেমেন রায়দের। লিখছেন অনিরুদ্ধ সরকার 
'দাদামণি' অশোক কুমারের প্রপিতামহ মানে মায়ের ঠাকুরদা ছিলেন ভাগলপুরের রাজা শিবচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।ভাগলপুরের বিখ্যাত জমিদার ছিলেন শিবচন্দ্রের পিতা। তাঁর আমল শেষ হলে জমিদারির হাল ধরেন জমিদার শিবচন্দ্র। 'জমিদার শিবচন্দ্র' অল্পদিনেই হয়ে উঠেছিলেন 'রাজা শিবচন্দ্র'। শিবচন্দ্র জমিদারি চালাতেন রবিনহুড ধাঁচে। এলাকায় তাঁর নামে বাঘে গোরুতে একঘাটে জল খেত। এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন শিবচন্দ্র। 
জমিদারি সামলানোর পাশাপাশি এলাকার সার্বিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা ছিল ভাগলপুরের এই রাজপরিবারটির। শিবচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাবার ইচ্ছে ছিল ছেলে আইন পড়ে জমিদারি তদারকি করুক। বংশ পরম্পরায় আইন  পড়েছিলেন তাঁরা। পিতার কথামতো শিবচন্দ্র চলে যান কলকাতা। 


কলকাতায় শিবচন্দ্র বন্ধু হিসেবে পেলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে। দুজনে ভারি দোস্তি হল। শিবচন্দ্র ও বঙ্কিমচন্দ্র দুই সহপাঠী একসঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন। বঙ্কিম ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি নিয়েছিলেন, তবে শিবচন্দ্রের রকমসকম অন্য ছিল কিনা, তাই তিনি সে দিকে যাননি।
পিতার নির্দেশ ভাগলপুর ফিরে গেছিলেন শিব। শিব ভাগলপুর ফিরে পিতার নির্দেশে লোকাল বারে প্র্যাকটিস শুরু করেন। আর তারসঙ্গে চলতে থাকে জমিদারি দেখাশোনার কাজ।
শিবের আইন ব্যবসায় অল্পদিনেই বেশ নামডাক হল। দেখতে দেখতে অগাধ টাকার মালিক হয়ে উঠলেন শিবচন্দ্র। শিব সেই টাকায় ভাগলপুরে একের পর এক উন্নয়নমূলক কাজ শুরু করলেন। নদীতে বাঁধ দিলেন। চাষের উন্নতি করলেন। একাধিক ঘাট নির্মাণ করালেন। প্রাচীন মন্দির সংস্কার করলেন। নির্মাণ করালেন নতুন মন্দির। শিক্ষার উন্নতির জন্য স্কুল বানিয়ে দিলেন। মানুষের কাছে মুখে মুখে ফিরতে লাগলো শিবচন্দ্রের নাম। সবাই শিবের নামে ধন্য ধন্য করতে লাগলো। খুব অল্প সময়েই স্থানীয়দের কাছে 'আকবর বাদশা' গোছের এক প্রভাবশালী রাজা হয়ে উঠলেন শিবচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। 
কিন্তু বাদ সধল ইংরেজ। ইংরেজ রাজকর্মচারীদের চোখে লাগলো শিবচন্দ্রের সম্পত্তি বৃদ্ধি হতে দেখে। ইংরেজরা দেখলেন শিব থাকলে এলাকায় তাঁদের প্রভাব খাটবে না। ইংরেজশাসনের সেই সূচনালগ্নের সময়কাল। অতএব শিবকে রাজি করাতে হবেই। ইংরেজ রাজকর্মচারীরা তাঁকে প্রস্তাব দিলেন যে ইংরেজ সরকার নিজেদের অর্থে শিবকে রাজবাড়ি গড়ে দেবেন। শিবচন্দ্রকে ‘রাজবাহাদুর’ খেতাব দেবেন। আরও বিবিধ সুযোগ সুবিধা দেবেন কিন্তু শর্ত একটাই – "আইন প্র্যাকটিস করা যাবে না"।
শিবচন্দ্রের কি খেয়াল হল ইংরেজদের সব শর্ত মেনে নিলেন, আর 'হ্যাঁ' বলে দিলেন। আর একথা মানতেই রটে গেল শিবচন্দ্রের মাথাখারাপ হয়ে গেছে। সারা বঙ্গ জুড়ে রটল শিবের মাথায় দোষ আছে। একধাক্কায় শিবের জনপ্রিয়তা তলানিতে নেমে এল। লোকজন তাঁকে নিয়ে গান বাঁধল, ‘অংরেজি বাজা/ রাজ না পাট/শিবচন্দ্র রাজা।’
লোকে শিবচন্দ্রকে ‘পাগলা রাজা’ বলতে শুরু করল। শিব কিন্তু  নির্বিকার। শিবচন্দ্র দরিয়া দিল, উদার, খামখেয়ালি জীবন। জমিদারির পাঠ চুকিয়ে তিনি তখন এখন সাংস্কৃতিক মানুষ। বাড়িতে নিয়মিত তখন বসছে গানের আসর। সংস্কৃতি চর্চায় বিশেষ আগ্রহ তৈরি হয় শিবের। মেতে উঠলেন নাচ গান নাটক নিয়ে। শিবচন্দ্র নিয়মিত নাটক লিখতেন, করতেন। নাটকের দল ছিল তাঁর। 


'দাদামণি' মানে  অশোক কুমারের জন্ম হয়েছিল এই ভাগলপুরেই । অশোক কুমারের পারিবারিক নাম ছিল কুমুদলাল গঙ্গোপাধ্যায় । ডাক নাম ছিল 'দাদামণি'। অশোকের  বাবা কুঞ্জলাল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন ভাগলপুরের নামকরা আইনজীবী। ঠাকুরদা শিবচন্দ্রের বাড়িতে ছোটবেলা কাটে অশোক কুমারের। অশোকের ডাকনাম ছিল ‘কুমুদ’। 


শিবচন্দ্রের বাড়িতে একটা সাহিত্যের পরিবেশ ছিল। শিবচন্দ্রের বাড়ির বৈঠকখানায় তখন নিত্য আনাগোনা ছিল ঔপন্যাসিক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, সাহিত্যিক বনফুল থেকে রহস্য গল্প লেখক হেমেন রায়দের। 


মাঝেমধ্যেই শিবচন্দ্রের বৈঠকখানায় সাহিত্যসভা বসত।শিবচন্দ্র আগত সাহিত্যিকদের সঙ্গে সঙ্গে কুমুদের আলাপ করিয়ে বলতেন, ‘‘আচ্ছা, খোকা ওই গল্পটা বলো তো দেখি, যেখানে তোমার কাঁধে ডানা গজালো।’’ আর তা শুনে কুমুদ বলতে শুরু করত কিছু না কিছু মজার কথা। আর তা শুনে সবাই হাসত।মাঝে মাঝে কেউ কেউ কুমুদের কথা শুনে বলত, ‘‘ খোকা, ডানা গজিয়ে দেখাও তো।’’ একদিন হয়েছে কি কুমুদকে কেউ একজন মজা করে বলেছে, "ডানা গজিয়ে দেখাও তো"। একথা বলতেই কুমুদ বলে, ‘‘তুমি বাঘ হয়ে দেখাও তো, তবেই আমি ডানা বার করব।’’ উত্তর শুনে প্রশ্নকর্তা গম্ভীর হয়ে গেল। 


রাজা শিবচন্দ্র তখন নাতির পিঠ চাপড়ে বললেন, "শুনলে তো তোমরা আমার প্রপৌত্রের কথা।" নাতির পিঠে হাত দিয়ে শিবচন্দ্র সাহিত্যসভায় এক শ্যামবর্ণ তরুণের সামনে দাঁড় করিয়ে বললেন, ‘‘তুমি কী লিখবে হে, আমার এই প্রপৌত্রটি তোমার চাইতেও সরস গল্প বলে। শুনিয়ে দাও তো খোকা।’’ সেই তরুণ ছিলেন সম্পর্কে সাহিত্যিই উপেন্দ্রনাথের ভাগ্নে। ওই যুবক তখন সবে লেখালেখি শুরু করেছিলেন। ছোটো কুমুদও মজা কম নিত না। ঠাকুরদার আস্কারা পেয়ে নিজের বয়সের তিনগুন চারগুন বড় সাহিত্যিকদের সাথে মজা করতেন। সেই শ্যামবর্ণ তরুণকে একদিন হেসে বললেন‘‘তুমি কখনও রুপোর ভাত খেয়েছ? তার সঙ্গে রুপোর পটোল ভাজা?’’ কুমুদের সেই গল্প আরও এগোত কিন্তু সে সময়েই অন্দরমহল থেকে এসে তাঁর কান পাকড়ে নিয়ে গেলেন মা গৌরীরানি। কারণ তখন তার শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নেওয়ার সময়। মায়ের কাছেই সে সঙ্গীত রেওয়াজ করত। সঙ্গীতে তাঁর খুব মন ছিল।তবে সেই মনোযোগের নেপথ্যে কুমুদের একটি আবদার পূরণ ক রতে হত তাঁর মাকে। সেটি হল যতক্ষণ গানের রেওয়াজ চলবে ততক্ষণ হাত খুলে তাকে তবলা বাজাতে দিতে হত বাবার টাকে! নইলে নাকি তাঁর গানের ছন্দ ধরতে সমস্যা হয়। এই ছিল কুমুদ। ঠাকুরদার আস্কারা কুমুদকে বেপরোয়া করে তুলছিল। 


বহু বছর বাদে ঠাকুরদা শিবচন্দ্রের বাড়ির বৈঠকখানার সেই শ্যামবর্ণ যুবকের সঙ্গে কুমুদের আবার দেখা নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়োয়। কুমুদ তখন অশোক কুমার নাম নিয়েছে। সেদিন বীরেন্দ্র সরকারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন নায়ক অশোককুমার। অফিসঘরে গিয়ে দেখলেন, শ্যামবর্ণ সৌম্যদর্শন সেই প্রৌঢ় বসে। সেদিনের যুবক পৌঢ় হয়েছেন।দেশজোড়া তাঁর নাম। একডাকে সাহিত্যজগতে সবাই তাঁকে চেনে তখন। নাম, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। 


সেদিন সামনে সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে দেখে নায়ক অশোককুমার একটু জড়সড় হয়ে পড়েছিলেন। কথাসাহিত্যিক তাঁকে দেখেই উদাস ভাবে বলেছিলেন, ‘‘রুপোর ভাত আর রুপোর পটোল আজও পেলাম না। জানো তো!’’ শুনে অশোককুমার আর পালাতে পথ পান না। শরৎচন্দ্র তখন স্নেহের স্বরে তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘তোমার ফিল্মের স্টোরি ডেভেলপিংয়ের সময় তুমি থেকো কিন্তু। তাতে সকলের উপকার হবে।’’ তাঁর পরামর্শ সে দিন অভিনেতা অশোককুমার শুনেছিলেন।

অভিনেত্রী ছায়াদেবীর পিসিমার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল রাজা শিবচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের একমাত্র ছেলে কুমার সতীশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে।এই পিসি ছিলেন অভিনেতা অশোককুমারের দিদিমা। আর অশোককুমার ছিলেন ছায়াদেবীর সমবয়সি। ছোটোবেলায় ছায়াদেবীর খেলার সঙ্গীও ছিলেন অশোক, কিশোর। সতীশচন্দ্রের দুই ছেলে শ্রীশচন্দ্র আর শৈলেশচন্দ্র সম্পর্কে ছিলেন অশোককুমারের মামা। ভাগলপুরের জন্য মাঝেমাঝেই তাই ছায়াদেবীর মন কেমন করে উঠত। অশোককুমারের মামিমা কনকের নাম রাখেন 'ছায়া দেবী। ‘


শিবচন্দ্র দেখতে দেখতে একদিন চোখ বুজলেন কিন্তু রেখে গেলেন এমন এক পরিবার যারা সারা ভারতজুড়ে এক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে তুলেছিলেন।  


তথ্যসূত্র:


১|| Ashok kumar : his Life and Times- Nabendu Ghosh

২|| চলচ্চিত্র প্রবেশিকা- শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়।


৩|| কিছু ছায়া কিছু ছবি- তপন সিনহা।

আরও পড়ুন- কিভাবে হল রসগোল্লার জন্ম, জেনে নিন এর জন্মবৃত্তান্ত

আরও পড়ুন- গয়না বা পোশাক নয়, জন্মদিনে স্ত্রীকে উপহার 'চাঁদের জমি'

আরও পড়ুন- ১৩ মানেই কি অশুভ সংখ্যা, জেনে নিন সংখ্যাতত্ত্ববিদদের ব্যাখা

"

Share this article
click me!