ইংরাজি শিক্ষার অন্ধভক্ত তখন বাঙালিরা, কিন্তু বিদ্যাসাগরের ছাত্রবৃত্তিতে সংস্কৃত টোল খুললেন ঠাকুরদাস

মাত্র ন'বছর বয়সে সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হয়েছিল ঈশ্বর। বড়বাজারের বাড়ি থেকে সে পিতা ঠাকুরদাসের সাথে পটলডাঙার কলেজ যেত। ছুটির পর বেলা চারটার সময় আবার তাঁর সাথেই বাড়ি ফিরত। প্রথমে কিছুদিন সে পিতার সাথে গেলেও কিছুদিন পর থেকে সে একা একাই কলেজ যাতায়াত শুরু করে।

Asianet News Bangla | Published : Sep 26, 2021 7:00 AM IST / Updated: Apr 26 2022, 10:09 AM IST

ঈশ্বরচন্দ্রের ছাত্রবৃত্তির টাকায় পিতা ঠাকুরদাস গ্রামে 'টোল' খুলেছিলেন, ১৮২০ সালে মেদিনীপুরের বীরসিংহ গ্রামে জন্মেছিলেন তিনি, ২০২১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১ বছর পূর্ণ হল বাংলার নবজাগরণের প্রাণপুরুষের--- লিখছেন- অনিরুদ্ধ সরকার---  ছোটোখাটো দেখতে একটি ছেলেটি রাস্তা দিয়ে হাঁটছে কিন্তু ছেলেটির মাথা দেহের তুলনায় বেশ বড়। ছেলেটির সহপাঠীরা তাই ঠাট্টা করে বলছে, ‘যশুরে কৈ, কসুরে জৈ।’ আর তাতেই রেগে যাচ্ছে ছেলেটি। আর আমরা সবাই জানি যে যত বেশি রাগে, তাকে সবাই তত বেশি রাগাতে ভালোবাসে। এখানেও তার ব্যতিক্রম হল না। সহপাঠীরা রাগাতে লাগল একরোখা ছেলেটিকে। এই ছেলেটি যে একদিন বাংলার দিকপাল ব্যক্তিত্ব হবে তা অবশ্য তার সহপাঠীরা তখন জানত না। এতক্ষণ রেগে যাওয়া যে ছেলেটির কথা হচ্ছিল সে আর কেউ নয়, ঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মা। যিনি তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য পেয়েছিলেন 'বিদ্যাসাগর' উপাধি আর দানধ্যানের জন্য পেয়েছিলেন 'দয়ারসাগর' খ্যাতি।


ঈশ্বরের বয়স তখন ন'বছর। সংস্কৃত কলেজে ‘অলঙ্কার শ্রেণি’তে সে ভর্তি হয়েছে। প্রতিদিন কলেজ ছুটির পর বিকেল চারটে নাগাদ ঠনঠনিয়া চৌরাস্তার কাছে তারানাথ তর্কবাচস্পতি ও মধুসূদন বাচস্পতির বাড়ি যায় সে পড়াশোনার জন্য। তারা তাঁকে খুব  স্নেহ করেন। দুই সংস্কৃত পণ্ডিতের বাড়িতে ঈশ্বর সন্ধ্যা পর্যন্ত সাহিত্যদর্পণ পড়ত। কোথাও কিছু প্রশ্ন থাকলে সে দুই পণ্ডিতের কাছ থেকে তা জেনে নিত। একদিন কি হয়েছে দুই পণ্ডিতের বাড়িতে হঠাৎ হাজির তৎকালীন সময়ের দিকপাল সংস্কৃত পণ্ডিত জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চানন। তিনি বাড়িতে প্রবেশ করেই দেখলেন একটি অল্পবয়সী বালক  সাহিত্যদর্পণ পড়ছে। জয়নারায়ণ তো দেখে অবাক। তারানাথ তর্কবাচস্পতির কাছে গিয়ে বললেন, "এত অল্পবয়সী বালক সাহিত্যদর্পণ পড়ছে! ওর পক্ষে কি এটা বোঝা সম্ভব?" 
আরও পড়ুন- Sekaler Galpo- শেঠ বৈষ্ণবচরণের ছিল গঙ্গাজলের ব্যবসা, আর সেই সূত্রেই উত্থান জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির
তারানাথ বাচস্পতি মৃদু হেসে বললেন, "মহাশয়, ও কী রকম শিখেছে তা আপনি জিজ্ঞেস করে দেখুন।"
জয়নারায়ণের কি মনে হল,  সে ঈশ্বরের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, "আচ্ছা বাবা তুমি যে সাহিত্যদর্পণ পড়ছো তার রস কি তুমি অনুধাবন করতে পারছো? তুমি কি এর রস বিচার করতে পারবে?" 

ঈশ্বর পাঠে মগ্ন ছিল। জয়নারায়ণের প্রশ্নে চমক ভাঙল। সে জয়নারায়ণকে প্রণাম জানাল তারপর বলল, 'পারি'। ঈশ্বর ব্যাখ্যা শুরু করল। জয়নারায়ণ ঈশ্বরের ব্যাখ্যা শুনছেন একমনে। আর যত শুনছেন ততই আশ্চর্য হচ্ছেন। এই অল্প বয়সে এত নিষ্ঠা, এত জ্ঞান। ঈশ্বরের ব্যাখ্যা শেষ হল। জয়নারায়ণ ঈশ্বরকে আশীর্বাদ করলেন। আর উপস্থিত দুই পণ্ডিতকে বললেন, " এই বালক বড় হয়ে বাংলাদেশের এক অদ্বিতীয় পণ্ডিত হবে। এত অল্পবয়সে এই পাণ্ডিত্য আমি আগে কখনও দেখিনি।"

মাত্র ন'বছর বয়সে সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হয়েছিল ঈশ্বর। বড়বাজারের বাড়ি থেকে সে পিতা ঠাকুরদাসের সাথে পটলডাঙার কলেজ যেত। ছুটির পর বেলা চারটার সময় আবার তাঁর সাথেই বাড়ি ফিরত। প্রথমে কিছুদিন সে পিতার সাথে গেলেও কিছুদিন পর থেকে সে একা একাই কলেজ যাতায়াত শুরু করে। 

কলকাতায় আসার পথে মাইলস্টোন দেখে যে ছেলে সহজে ইংরেজি আর অঙ্ক শিখে ফেলেছিল তাকে ঠাকুরদাস খামোখা সংস্কৃত কলেজে কেন ভর্তি করতে গেলেন। সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের যেতে হবে কয়েকবছর পেছনে।

কলকাতার বিত্তশালী ভাগবতচরণ সিংহের মৃত্যু হলে পরিবার ও ব্যবসার হাল ধরেন তাঁর একমাত্র ছেলের জগদ্দুর্লভ। তাঁর বাড়িতেই থাকতেন ঠাকুরদাস। বাড়ির কাছে বসত শিবচরণ মল্লিকের পাঠশালা। গুরুমশায়ের নাম স্বরূপচন্দ্র দাস। পিতা ঠাকুরদাস ঈশ্বরকে ভর্তি করে দিলেন সেখানে। অঘ্রাণ, পৌষ, মাঘ তিন মাস পড়াশোনার পাঠ নিতে নিতেই ফাল্গুনের গোড়ার দিকে অসুখ করল ঈশ্বরের। কলকাতার কবিরাজি চিকিৎসায় অসুখ ভালো হল না। নাতির অসুখের খবর পেয়ে ঠাকুমা হাজির হলেন কলকাতায়। দু-তিন দিন কলকাতায় থেকে সেবা যত্ন করে যখন দেখলেন শরীরের কোনও উন্নতি হচ্ছে না তখন ঈশ্বরকে নিয়ে চলে গেলেন বীরসিংহে। সেখানে বিনা ওষুধেই এক সপ্তাহের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠল ঈশ্বর। জ্যৈষ্ঠ মাসের শুরুতে সে আবার ফিরল কলকাতায়।
আরও পড়ুন- বরানগর খেয়া ঘাটে দাঁড়িয়ে গঙ্গার ওপারে বেলুড়কে দেখলেন স্বামীজি, বেলুড় মঠ তৈরির ইতিহাস যেন এক রূপকথা

ঠাকুরদাসের রোজগার বেশি ছিল না। টেনেটুনে কোনোরকমে সংসার চলত। রোজ ঠিকমতো দু'বেলা ভাতও জুটত না। কোনও কোনও দিন শুধু লবণ দিয়ে ভাত খেতে হত। যেদিন মাছ-তরকারি জুটত সেদিনও ঘটা করে মাছ-ভাত খাওয়ার উপায় ছিল না। একবেলা মাছের ঝোল দিয়ে খেতে হত তো  আরেকবেলা শুধু ভাত। বাকী মাছটুকু বাঁচিয়ে রাখতে হত পরের দিনের জন্য। রান্নাঘরটিও ছিল অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে। রোদ ঢোকার কোনও অবকাশ ছিল না। তার ওপর ছিল আরশোলা, ইঁদুরের উৎপাত।একদিন ঈশ্বর খেতে বসে দেখল, তরকারির মধ্যে একটা আরশোলা। সে কাউকে কিছু না বলে তরকারির সঙ্গে আরশোলাটাও খেয়ে ফেলল এই ভেবে পাছে পিতা দুঃখ পান।অন্যদের খেতে অসুবিধা হয়।


ঠাকুরদাসের কাছ থেকে কলকাতার পাড়া প্রতিবেশীরা যখন শুনল কলকাতায় আসার পথে মাইলস্টোন দেখে মেধাবী ঈশ্বর সহজেই অঙ্ক আর ইংরেজি শিখে ফেলেছে তখন তারা সবাই বলল, ঈশ্বরকে অবশ্যই ইংরেজি পড়ানো উচিত। হেয়ার সাহেবের স্কুলে বেতন লাগে না। ঠাকুরদাস  চাইলেই ভর্তির বন্দোবস্ত  হয়ে যাবে।। কেউ কেউ বলল ইংরেজিটা যদি ভালো শিখতে পারে, হিন্দু কলেজেও বিনা বেতনে পড়তে পারবে। আর ইংরেজি জানলে অনায়াসে সাহেবদের অফিসে ছেলে চাকরি পেয়ে যাবে।
কিন্তু ঠাকুরদাস তাদের মুখের ওপর বলে দিলেন তিনি ছেলেকে ইংরেজি পড়াবেন না। ইংরেজদের কাছে চাকরি করে সংসারের অভাব ঘোচানোর জন্য তিনি ছেলেকে কলকাতায় আনেননি। তিনি ছেলেকে সংস্কৃত শেখাবেন। আর তাঁর ইচ্ছে ছেলে সংস্কৃত শাস্ত্রে  পণ্ডিত হয়ে গ্রামে গিয়ে একটা টোল খুলবে। বংশের মুখ উজ্জ্বল করবে। ঠাকুরদাস এই ভেবে ছেলেকে ভর্তি করে দিলেন সংস্কৃত কলেজে।
আরও পড়ুন- প্রযুক্তিকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া এবং সস্তা করাতে তিনি ছিলেন জাদুকর, চলে গেলেন হোম কমপিউটারের জনক

হাজারো ব্যস্ততার মাঝে রোজ রাতে ঠাকুরদাস ঈশ্বরকে পড়াতে বসেন। পড়া ধরেন।পড়া বোঝান। পড়ায় ভুল হলে বকেন। অন্যদিকে লেখাপড়া ছাড়াও কাজের শেষ নেই ঈশ্বরের। ওইটুকু ছেলে সকালবেলা গঙ্গা স্নান সেরে বাড়ি ফেরার পথে বাজার করে আনে। তারপর মশলা বাটা, মাছ-তরকারি কাটা। এমনকি রান্নাও অবধি  করতে হয় তাকে। চার-পাঁচজনের রান্না সে একাই করে। সবার খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে তারপরে সে খেতে বসে। শুধু তাই নয় ঠাকুরদাসের শিক্ষা, 'খাদ্য হল অন্ন'। তা ফেলে কিম্বা ছড়িয়ে ছিটিয়ে খাওয়া চলবে না । একটি ভাতও যদি পাতের পাশে পড়ে থাকে তো ঠাকুরদাস রেগে যেতেন। এখানেই শেষ না, খাওয়া শেষে সবার থালা-বাসন মেজে, রান্নাঘর পরিষ্কার করে ঈশ্বর যেত কলেজে। ভাবা যায়!
ঈশ্বর বাড়ির কাজে অনেকটা সময় ব্যস্ত থাকার জন্য পিতাকে বলত, " রাত দশটার সময় খেয়ে শুয়ে পড়ব। বারোটা বাজলে আমাকে জাগিয়ে দেবেন, নইলে পড়া হবে না।" খাওয়া শেষ করে তাই ঠাকুরদাস দু'ঘণ্টা বসে থাকতেন। আর্মানি গির্জায় রাত বারোটার ঘণ্টা শুনে ছেলেকে জাগিয়ে দিতেন। ঈশ্বর সারারাত জেগে পড়ত। কোনও কোনও দিন ঘুম আসার সম্ভাবনা থাকলে সে টিকি বেঁধে রাখত কোনও কিছুর সঙ্গে যাতে টান পড়লেই সে জেগে ওঠে। কখনও চোখে সরষের তেল দিয়ে রাখত ঘুম কাটানোর জন্য। 

আরও পড়ুন- চিকাগো ধর্মসভায় বিবেকানন্দের বক্তৃতা আজও এক প্রেরণা, কিন্তু স্বামীজির ক্রিকেটের কথা ক'জন জানে
সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হওয়ার দেড় বছর পর থেকে ঈশ্বর মাসিক পাঁচ টাকা বৃত্তি পেতে শুরু করল। কলকাতার বাইরে অন্য জায়গা থেকে আগত কৃতী ছাত্ররা কলকাতায় থেকে পড়াশোনা করার জন্য এই বৃত্তি পেত। যারা বৃত্তি পেত তাদের বলা হতো পে-স্টুডেন্ট। সহজ কথায় স্কলারশিপ। মাসিক বৃত্তির টাকা হাতে পেতেই ঈশ্বর খুব খুশি হল। পিতার স্বপ্ন সে পূরণ করতে পেরেছে। তার চোখে জল। বৃত্তির টাকা সে তুলে দিল ঠাকুরদাসের হাতে। ঠাকুরদাস হাতে টাকা নিয়ে ঈশ্বরকে বললেন, " তোমার বৃত্তির এই টাকায় জমি কিনব। দেশে একটা টোল করে দেব। দেশের লোক যাতে লেখাপড়া শিখতে পারে তুমি সেই ব্যবস্থা করবে।" 
ঠাকুরদাস ছেলেকে যে কথা দিয়েছিলেন তা তিনি রাখলেন। কাঁচিয়াগ্রাম অঞ্চলে কয়েক বিঘা জমি কিনলেন। তৈরি করলেন টোল। বছরখানেক পর একদিন ঈশ্বরের কাছে গিয়ে ঠাকুরদাস বললেন, " এবার থেকে বৃত্তির টাকায় প্রয়োজনীয় বইপুস্তক কিনো।"
ঠাকুরদাসের কথামতো ঈশ্বর তাই করল।

তথ্য ঋণ: 
বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ- বিনয় ঘোষ
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর - এস কে বোস
করুণাসাগর বিদ্যাসাগর - ইন্দ্র মিত্র
বিদ্যাসাগর - বিহারীলাল সরকার
Pic courtesy: University of Calcutta archive 

Share this article
click me!