Unknown Facts Sukumar Ray- ননসেন্স ছড়ার জনক সুকুমার রায়, বহু অজানা কথায় বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি-র কাহিনি

সুকুমার রায়। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর পুত্র। ছেলেবেলা থেকেই বেশ ফুর্তিবাজ। স্বভাবে চঞ্চল হলে কি হবে সব কিছুতে তার প্রবল উৎসাহ। বিভিন্ন খেলাধুলোর দলনেতা সে। ছোটো বয়স থেকেই কলের খেলনার কলকব্জা খুলে সে দেখত ভেতরে কি আছে। কী করে খেলনা চলে। আবার বাজনার প্রতিও তার আগ্রহ ছিল সমানভাবে।
 

Asianet News Bangla | Published : Oct 30, 2021 11:45 AM IST / Updated: Apr 25 2022, 08:19 PM IST

পুত্র সত্যজিতের (Satyajit Roy) জন্ম হয় যে বছর সেই বছরই শেষের দিকেই অসুস্থ হন সুকুমার (Sukumar Roy)। ভয়ঙ্কর কালাজ্বর। মৃত্যুশয্যায় রবি ঠাকুরকে শুনিয়েছিলেন ন'টি গান। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর পুত্র সুকুমার ছেলেবেলা থেকেই বানিয়ে বানিয়ে চমৎকার গল্প বলতে পারত। অনেক বড় বড় ওস্তাদও একমনে ওর গল্প শুনত। সুকুমার রায়ের জীবনের এমনই কিছু অজানা কথা শোনাচ্ছেন অনিরুদ্ধ সরকার।।মাস্টারমশাই বড় ভাল মানুষ কিন্তু স্বভাব তাঁর বেশ কড়া। আর একবার যদি কোনো বিষয় সম্বন্ধে খারাপ ধারণা হয়ে যায় তো আর রক্ষে নেই। যেমনটা হয়েছিল উনার বায়োস্কোপ নিয়ে।  কোনোজায়গা থেকে মাস্টারমশাই খবর পেয়েছিলেন বায়োস্কোপের নানান খারাপ দিক রয়েছে। এর জেরে ছেলেরা বখে যাচ্ছে তো এর থেকে মাস্টারমশাই হয়ে উঠলেন বায়োস্কোপের ঘোর বিরোধী।  

তা একদিন হল কি ক্লাসে বায়োস্কোপের (Bioscope) বিভিন্ন খারাপ দিক নিয়ে ছাত্রদের বোঝাচ্ছেন। অনেক বুঝিয়ে ছাত্রদের সামনে নিজের একটি যুক্তি খাড়া করলেন ও বায়োস্কোপ যে খারাপ তার একটি ধারণা দিলেন। মাস্টারমশাই  নিজের বক্তব্য শেষ করার পর তাঁর কি খেয়াল হল তিনি তাঁর প্রিয় ছাত্র সুকুমারকে কিছু বলতে অনুরোধ করলেন। মাস্টারমশাইয়ের প্রিয় ছাত্র বলল, " সব বায়োস্কোপ (Bioscope)  খারাপ হয় না। কিছু ছবি অবশ্যই খারাপ। সেগুলো না দেখাই ভালো কিন্তু কিছু ভালো ছবিও তো আছে, আর সে সব দেখলে অনেক কিছু শেখা যায়।" মাস্টারমশাই প্রিয় ছাত্রের মুখে এধরণের কথা শুনে একটু দমে গেলেন।  সুকুমার মাস্টারমশাইয়ের কাছে জানতে চাইলেন, তিনি বায়োস্কোপ দেখেছেন কিনা উত্তরে মাস্টারমশাই জানালেন তিনি ওসব দেখেন না।  সুকুমার কিন্তু দমে যাওয়ার ছেলে নয়। সে ঠিক করল মাস্টারমশাইয়ের বায়োস্কোপের প্রতি যে ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে তা সে বদলাবে। জোর করে মাস্টারমশাইকে নিয়ে একটা ভাল ছবি দেখতে গেলেন সুকুমার (Sukumar Roy)। আর  ছবিশেষে কি ঘটল জানেন!  মাস্টারমশাই সুকুমারের মাথায় হাত রেখে বললেন, “তুমি আমার একটা মস্ত ভুল ভাঙিয়ে দিলে বাবা।”

আরও পড়ুন- Mahalaya-বাঙালির এক অবহেলিত কিংবদন্তি, শেষজীবনে আকাশবাণীর প্রবেশ দ্বারে তাঁকে আটকেছিল দারোয়ান

সুকুমার রায় (Sukumar Roy) উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর (Upendra Kishore Roychowdhury) পুত্র। ছেলেবেলা থেকেই বেশ ফুর্তিবাজ। স্বভাবে চঞ্চল হলে কি হবে সব কিছুতে তার প্রবল উৎসাহ। বিভিন্ন খেলাধুলোর দলনেতা সে। ছোটো বয়স থেকেই কলের খেলনার কলকব্জা খুলে সে দেখত ভেতরে কি আছে। কী করে খেলনা চলে। আবার বাজনার প্রতিও তার আগ্রহ ছিল সমানভাবে কিন্তু তা বাজানোর চেয়ে খুলে দেখাতেই আগ্রহ ছিল বেশ। পিতা কাছে এলেই সে বলত, "দেখছি আওয়াজটা বের হচ্ছে কোথা থেকে!" সব বিষয়েই তার অসীম কৌতূহল। ওই অতটুকু বয়সেই সে চমৎকার গল্প বলতে পারত। অনেক বড় বড় লোক ও হাঁ করে ওর গল্প শুনত। কারণ সুকুমারের বলার এক বিশেষ দক্ষতা ছিল। আর ছিল ভাষার উপরে অসামান্য দখল।  সুকুমারের ডাক নাম ছিল 'তাতা'। এই  তাতা নামের নেপথ্যে আছে এক মজার গল্প। রবীন্দ্রনাথ (Rabindranath Tagore) রাজর্ষি’ নামে একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখেন। ওই উপন্যাসে রবি ঠাকুর 'হাসি' ও 'তাতা' নামে দুই চরিত্র এঁকেছিলেন। নামগুলি বড় পছন্দ হয় উপেন্দ্রকিশোরের আর সেই অনুসারে উপেন্দ্রকিশোর বড় মেয়ে সুখলতার ডাকনাম দেন 'হাসি' আর বড় ছেলে সুকুমারের ডাকনাম ঠিক হয় 'তাতা'।

আরও পড়ুন- Sekaler Galpo- বিধবা বিয়ে করলে বরকে দিতেন অর্থ, তাঁর জমিতেই মেডিক্যাল কলেজ, বাঙালি কি ভুলেছে মতিলালকে 

উত্তরাধিকার সূত্রে সুকুমারের রক্তে মিশে ছিল  সাহিত্য। পিতা উপেন্দ্রকিশোর ছাড়াও তাঁর মাতামহী ছিলেন প্রথম মহিলা বাঙালি ডাক্তার কাদম্বিনী বসু গঙ্গোপাধ্যায় (Kadambini Basu Gangopadhyay)। পিসেমশাই ছিলেন হেমেন্দ্রমোহন বসু। যিনি ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসুর (Jagadish Chandra Bose) ভাগিনেয়। এই হেমেন বসু ছিলেন ‘ফনোগ্রাফ’ ও ‘কুন্তলীন’-এর আবিষ্কর্তা। সুকুমারের ফোটোগ্রাফি ছিল প্রিয় বিষয়। আর ফটোগ্রাফি নিয়ে গভীর লেখাপড়াও ছিল তাঁর। এসব ছাড়াও সুকুমার ছিলেন একজন দক্ষ পত্রিকা সম্পাদক। জীবনের শেষ লগ্নে যখন তিনি দু’বছর রোগশয্যায়। তখন সেই অবস্থাতেও তিনি ‘সন্দেশ’-পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। ওই শারীরিক অবস্থাতেও পত্রিকা যাতে সময়মত বের হয় তার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন সুকুমার। 


ছাত্রাবস্থায় বন্ধুবান্ধব নিয়ে তৈরি করেছিলেন ‘ননসেন্স ক্লাব’ (Nonsense Club) । ক্লাবের একটি হাতে লেখা পত্রিকাও প্রকাশ করেছিলেন। নাম দিয়েছিলেন ‘সাড়ে-বত্রিশ ভাজা’। সিটি স্কুল পাশ করে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন সুকুমার। ধীরেধীরে লেখালেখিতে পুরোদমে হাত পাকাতে শুরু করেন সুকুমার। এর পাশাপাশি দেশপ্রেমের কিছু গানও লিখলেন। ১৯১০ সালে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম যুবসমিতির মুখপত্র ‘আলোক’ প্রকাশ করলেন। কিন্তু এর মধ্যে জীবন অন্য দিকে বাঁক নিল। লীলা মজুমদার (Lila Majumder) লিখছেন, “একটা প্রবাদ আছে যে যারা সবচাইতে বেশি কাজ করে, তাদেরই হাতে বাড়তি ফালতু কাজ করার সবচাইতে বেশি সময়ও থাকে। এ-কথাটি যে কত সত্যি, সুকুমারের জীবনই তার প্রমাণ।” প্রবোধচন্দ্র সেনের মত, “কবি মধুসূদনের পর বাংলার প্রধান ছন্দশিল্পী তিনজন— রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল এবং সত্যেন্দ্রনাথ।  এই তিন ছন্দ শিল্পী কবির পরেই উল্লেখ করতে হয় কবি সুকুমার রায়ের (Sukumar Roy) নাম।” 

আরও পড়ুন- Sekaler Galpo- শেঠ বৈষ্ণবচরণের ছিল গঙ্গাজলের ব্যবসা, আর সেই সূত্রেই উত্থান জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির

ফিজ়িক্স ও কেমিস্ট্রিতে ডাবল অনার্স নিয়ে বিএ পাশ করার পরের বছর গুরুপ্রসন্ন বৃত্তি পেলেন সুকুমার (Sukumar Roy)। তারপর ফোটোগ্রাফি ও ছাপাখানার প্রযুক্তিবিদ্যায় উচ্চশিক্ষার জন্য লণ্ডন পাড়ি দিলেন সুকুমার। উপেন্দ্রকিশোরের ফোটোগ্রাফি ও ছাপাখানার প্রযুক্তি নিয়ে উৎসাহ ছিল বহুদিনের। তিনিই বাংলায় প্রথম হাফটোন প্রযুক্তিতে ছবি ছাপার ব্যবস্থা করেন। বিলেতে গিয়ে ছাপার প্রযুক্তি বিষয়ে বিশেষজ্ঞতা অর্জন করতে পাঠান পুত্র সুকুমারকে (Sukumar Roy)। ১৯১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ‘ফেলো অব দ্য রয়্যাল ফোটোগ্রাফিক সোসাইটি’ উপাধি নিয়ে দেশে ফিরলেন সুকুমার। এমনটাই চেয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। ছেলে ফিরে এলে বুকে জড়িয়ে ধরলন  পিতা। পিতার চোখে জল। সুকুমার বাংলা সাহিত্য জগৎকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি  বাংলা মুদ্রণ জগৎকেও অনেকখানি এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। বিলেত থেকে তাঁর অর্জিত পাঠ সহায়তা করেছিল ভারতীয়দের

বিলেত থেকে ফেরার পরে ১৯১৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর ঢাকা নিবাসী সুপ্রভা দেবীর সঙ্গে বিয়ে হয় সুকুমারের (Sukumar Roy)। কলকাতা ফেরার পর সুকুমারের পাকাপাকিভাবে  ঠিকানা হয় ১০০ নম্বর গড়পার রোড। সেই বাড়িতে আসর জমতে থাকে সুকুমারকে ঘিরে। দেখতে দেখতে সেই বাড়ি হয়ে ওঠে বিভিন্ন দিকপালদের আড্ডার ঠেক। বিলেত থেকে ফেরার পর সুকুমার আর মাত্র দশ বছর বেঁচেছিলেন। ১৯২১ সাল ছিল সুকুমারের জীবনে বড় আনন্দের বছর। কারণ ওই বছর ২ মে পুত্র সত্যজিতের জন্ম হয়। আর সেই মাসের শেষের দিকেই অসুস্থ হন সুকুমার (Sukumar Roy)। কালাজ্বর। চিকিৎসার জন্য সুকুমারকে নিয়ে যাওয়া হল দার্জিলিংয়ের লুইস জুবিলি স্যানাটোরিয়ামে। কিন্তু এই দুরারোগ্য অসুখের ওষুধ তখনও আবিষ্কৃত হয়নি। ক্রমশ স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকল সুকুমারের। কিন্তু ওই অবস্থাতেই সুকুমার দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে চলেছেন লেখালেখি ক রছেন। পত্রিকা সম্পাদনার কাজ করছেন।

১৯২৩ সালের ২৯ অগাস্ট। অসুস্থ সুকুমার পুরোপুরি শয্যাশায়ী।  গান শুনতে বড় ভালবাসতেন সুকুমার। ২৯ অগাস্ট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (Rabindranath Tagore) এলেন সুকুমারকে দেখতে। রায় পরিবারের সাথে ঠাকুরবাড়ির সখ্যতা দীর্ঘদিনের। রবীন্দ্রনাথকে সুকুমার অনুরোধ করলেন গান শোনাতে। রবি ঠাকুরও এক এক করে শোনালেন ন’টি গান। সুকুমারের চোখ তখন ছলছল করছে। দেখতে দেখতে শরীর সাথ ছাড়তে লাগলো সুকুমারের। ১০ সেপ্টেম্বর চলে গেলেন সুকুমার (Sukumar Roy)।

 

Share this article
click me!