সংক্ষিপ্ত

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের যে ধরনের চণ্ডীপাঠ আমরা এখন শুনি, প্রথম দিকে কিন্তু উনি ওই ভাবে উচ্চারণ করতেন না। পুরো দলটিকে যথাযথ পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেছিলেন অধ্যাপক অশোকনাথ শাস্ত্রী বেদান্ততীর্থ মহাশয়। এই অনুষ্ঠানটি আবার ষষ্ঠীর সকালে ফিরে এসেছিল ১৯৩৬ সালে। নাম ছিল ‘মহিষাসুর বধ’।

বাঙালির মহালয়া (Mahalaya 2021) মানে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের (Birendrakrishna Bhadra) কন্ঠে চণ্ডীপাঠ  কিন্তু একসময় গোঁড়া রক্ষণশীল ব্রাহ্মণসমাজ এর বিরোধিতা করে বলেছিল, "পুণ্য মহালয়ার ভোরে অব্রাহ্মণের কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ শোনা মহাপাপ!" (Mahalaya 2021) রবীন্দ্রনাথ, বিধান রায়ের মৃত্যু থেকে ক্রিকেট ফুটবল এমনকি দুর্গাপুজোর (Durga Puja 2021) বিসর্জনের প্রথম ধারাবিবরণীর সূত্রপাত তাঁর হাত ধরেই  কিংবদন্তী এই 'রেডিও পুরুষ' অপমানিত হয়েছেন নিজের রেডিও স্টেশনেই। লিখছেন - অনিরুদ্ধ সরকার

পরিষ্কার ধবধবে ধুতি-পাঞ্জাবি, কাঁধে একটা উড়নি, চোখে চশমা। হাতে খুব ছোট একটা থলে, পাঞ্জাবির দু’পকেটে দু’রকমের রুমাল— একটি নস্যিরঞ্জিত এবং আর একটি পরিষ্কার- এই ছিলেন বাঙালির বেতার পুরুষ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।

বাঙালির দুর্গাপুজোর সূচনা হয় মহালয়ায়। আর সেই মহালয়ার সাথে জড়িয়ে রয়েছে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের নাম! বীরেন্দ্রকৃষ্ণের  জনপ্রিয়তার কারণে বেতারের অনুষ্ঠানকে অনেকেই ‘মহালয়া’ বলে ভুল করেন অনেকে। আসলে ‘মহালয়া’ একটি তিথি। আর অনুষ্ঠানটির নাম ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। 

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের যে ধরনের চণ্ডীপাঠ আমরা এখন শুনি, প্রথম দিকে কিন্তু উনি ওই ভাবে উচ্চারণ করতেন না। পুরো দলটিকে যথাযথ পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেছিলেন অধ্যাপক অশোকনাথ শাস্ত্রী বেদান্ততীর্থ মহাশয়। এই অনুষ্ঠানটি আবার ষষ্ঠীর সকালে ফিরে এসেছিল ১৯৩৬ সালে। নাম ছিল ‘মহিষাসুর বধ’। ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে থাকে এই অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানটি জনপ্রিয় যেমন হয়েছিল তেমনি এটিকে ঘিরে একটি বিতর্ক তুলেছিলেন তৎকালীন গোঁড়া ব্রাহ্মণসমাজ। তাঁরা বলেছিলেন, পুণ্য মহালয়ার ভোরে অব্রাহ্মণের কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ শোনানোর কোনও যৌক্তিকতা নেই। 

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বিএ’ পাশ করার পর বাবার এক বন্ধুর সুপারিশে যোগ দিয়েছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ের ফেয়ারলি প্লেসের অফিসে। দুপুরে টিফিন বিরতি কিম্বা বিকেলে একটু অবসর পেলেই বীরেন পৌঁছে যেত রেডিও স্টেশনে। অল্প সময়েই আসর জমিয়ে দিতে পারত বীরেন। তাঁর এই গুণেই মোহিত হয়ে কলকাতা বেতার কেন্দ্রের নৃপেন মজুমদার তাঁকে রেডিওতে যোগ দেবার আহ্বান জানিয়েছিলেন। আর একদিন চাকরি ছেড়ে বীরেন যোগ দিল রেডিওতে।

বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কণ্ঠস্বর ছিল একদম স্বতন্ত্র। গবেষকরা বলছেন তার নেপথ্যে কারণ ডিপথেরিয়া। সাহেব ডাক্তার বীরেনকে প্রাণে বাঁচালেও কণ্ঠস্বর ‘নষ্ট’ হয়ে যায় তাঁর। প্রথমজীবনে রেডিয়োতে যখন অডিশন দিতে গেছিলেন তখন এই ভাঙা কন্ঠের জন্যই তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। শুনলে অবাক লাগতে পারে, ওই ‘অদ্ভুত’ গলার জন্যই রেডিও থেকে খোঁজ পড়েছিল তাঁর। একটি বেতার-নাটকে ‘রাক্ষসে'র কন্ঠস্বর প্রয়োজন ছিল। প্রযোজকের কাউকে মনে ধরছিল না। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ সেই অডিশনে পাশ হলেন। আর ‘রাক্ষসে'র কন্ঠ নিয়ে প্রবেশ করলেন বেতারকেন্দ্রে।

১৯৪১ সালের ৭ই অগস্ট। অসুস্থ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। স্বাস্থ্য ক্রমশ অবনতির দিকে। রেডিও স্টেশন ডিরেক্টরের নির্দেশ’ ছিল, সকাল থেকে প্রতি পনেরো মিনিট অন্তর কবির খবর শ্রোতাদের কাছে জানাতে হবে। সাংবাদিক নলিনীকান্ত সরকার ছিলেন শান্তিনিকেতনে। জোড়াসাঁকো থেকে প্রতি ১৫ মিনিট অন্তর ফোন করে রবি ঠাকুরের খবর পাঠাচ্ছিলেন। আর রেডিও অফিস থেকে সেই খবর পড়ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। বেলা বারোটা তেরো মিনিট নাগাদ ‘বিশ্বকবি’ মারা যান। বেতার কর্তৃপক্ষ ঠিক করেন, শ্মশানক্ষেত্র থেকে অনুষ্ঠানাটির ধারাবিবরণী হবে। কোনও বিশিষ্ট ব্যক্তির শেষযাত্রার ধারাবিবরণী রেডিওতে সেই প্রথম। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দক্ষতার সঙ্গে সেকাজ করলেন। তারপরে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের মত বিখ্যাত মানুষদের অন্তিমযাত্রার ধারাবিবরণী দিয়েছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। 

জানা যায়, এক সময় ‘নিমতলা ঘাট’ থেকে প্রতিমা বিসর্জনের প্রথম ধারাবিবরণীও সূত্রপাত বীরেন্দ্রকৃষ্ণের হাত ধরে।  বেতারে ক্রিকেট হোক আর ফুটবল মাঠ থেকে সেই খেলার ধারাবিবরণীও প্রথম শোনা গেছিল বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কণ্ঠে।

১৯৫৮ সালে বীরেন ভদ্রের পরিচালনায় 'মায়ামৃগ' নাটকে প্রথম বার মঞ্চে অভিনয় করেছিলেন অভিনেতা বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়’। তিনি একজায়গায় স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলছেন, " তখন আমি প্রায়শই মৃত্যুঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি যেতাম। উনি আমাকে আকাশবাণীর বীরেনদার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। কী জানি, আমাকে দেখে ওঁর কী মনে হয়েছিল! বলেছিলেন, তুমি পারবে। মঞ্চে অভিনয়, বেতারে কণ্ঠস্বর মডিউলেশন সব কিছুই ওঁর কাছে শেখা।আমাকে বলতেন, নিজে মেকআপ করবে। কারও ওপরে নির্ভর করে থাকবে না। অভিনয় জগতে চলতে হলে কার সঙ্গে কী ভাবে মিশতে হবে, সেটাও উনি বলে দিয়েছিলেন।’’ বিশ্বজিৎ একজায়গায়  আক্ষেপ করে বলছেন, ‘‘উনি যখন মারা যান, কেউ আমাকে জানায়নি। আমি তখন বম্বেতে কাজ করছি। জানার পরে খুব কেঁদেছিলাম।’’ 

অভিনেতা বিকাশ রায় চলচ্চিত্র জগতে আসার আগে দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলেন আকাশবাণীর সাথে। তিনি একজায়গায় লিখছেন,  "রেডিওতে  ‘সবিনয় নিবেদন’ অনুষ্ঠানটি শুনতে শুনতে মনে হত শ্যামবাজারে রকের আড্ডায় বীরেনদা আসর জমিয়ে বসেছেন আর আমরা শ্রোতারা ওঁকে ঘিরে বসেছি।" 

বেতারকেন্দ্রের ক্যান্টিনে বসে ছোটো-বড় সকলের সঙ্গেই গল্প জমিয়ে দিতে পারতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। সেখানে বয়সের কোনও ভেদাভেদ ছিল না। আবার এই মানুষটাই কাজের সময় গল্প জুড়লে যত রথী-মহারথীই হোক না কেন, তাঁকে নিষেধ করতেও পিছপা হতেন না। এমনই ছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব। বেতারে আক্ষরিক অর্থে ‘জুতো সেলাই’ থেকে ‘চণ্ডীপাঠ’ পর্যন্ত করেছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। 

বীরেন্দ্র কৃষ্ণের একটা সর্বজনগ্রাহ্য গ্রহণ যোগ্যতা ছিল। নাট্যকার জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায় তখন প্রায়শই রেডিওতে অনুষ্ঠান করতেন। তখন রেডিওর অনুষ্ঠানে পারিশ্রমিক ছিল বেশ কম। জ্ঞানেশ স্থির করলেন এত অল্প টাকা পারিশ্রমিকে তিনি আর রেডিওতে অনুষ্ঠান করবেন না। একথা শুনে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ তাঁকে ডেকে ধমকে বললেন, “তুমি কি রেডিওতে টাকা রোজগার করতে এসেছো জ্ঞানেশ?” 

১৯৭৬ সালে আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় 'মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠানটি বাতিল করে একটি অন্য অনুষ্ঠান বাজানো হবে মহালয়া তিথিতে। যে অনুষ্ঠানটির নাম ‘দেবীদুর্গতিহারিণীম্’। যেটি লিখেছিলেন ধ্যানেশনারায়ণ চক্রবর্তী। সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। গান লিখেছিলেন শ্যামল গুপ্ত। নির্বাচিত কিছু ভাষ্যপাঠ করেছিলেন উত্তমকুমার। অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারিত হল । আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ তখন আত্মতুষ্টিতে ভুগছিলেন যে তাঁরা একটা বিরাট পরিবর্তন এনেছেন কিন্তু সাধারণ দর্শক এই অনুষ্ঠান একেবারেই গ্রহণ করলেন না। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’কে বাদ দেওয়ার জন্য ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল সাধারণ মানুষ। শোন যায় বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ অবধি হয়েছিল।

একবার বাংলাদেশে গিয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দেখলেন সেখানকার মুসলমান শ্রোতাদের ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র প্রতি আবেগ। আর তা দেখে বিস্মিত হয়ে গেলেন। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ একজায়গায় লিখছেন: “আমি কায়েতের ছেলে হয়ে মাতৃবন্দনার সুযোগ পেয়েছি। আর ওই অনুষ্ঠানে বাদ্যযন্ত্র বাজায় খুশী মহম্মদ, আলী, মুন্সী এঁরা। এর থেকে সম্প্রীতির পূজার্চনা আর কী হতে পারে!”

অবসর নেওয়ার পর একদিন রেডিও স্টেশনে একটা কাজে গেছেন বীরেন্দ্র কৃষ্ণ। ঢুকতে গিয়ে হঠাৎ  বাধা পেলেন। এক সিকিউরিটি গার্ড তাঁর কাছে ‘পাস’ চেয়ে বসলেন। বীরেন্দ্র অবাক হলেন। নিজের পরিচয় দেওয়ার পরও যখন তাঁকে সিকিউরিটি অফিসার তাঁকে ভেতরে যেতে দিল না তখন রাগে গর্জে উঠে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বলেছিলেন, “জন্ম দিয়েছি আমি এই রেডিয়োকে! জন্ম দিয়েছি বুঝেছো। আর আমার কাছে পাস চাইছো?” 

যে স্মৃতিশক্তি ছিল বীরেন্দ্রর গর্ব, আশির দশকের প্রথম থেকেই তা লুপ্ত হওয়ার নানা উপসর্গ দেখা দিতে শুরু করে। স্ত্রী মারা যাওয়ার মাস সাতেকের মধ্যে তাঁর শরীরের আরও অবনতি হয়। এক গবেষক তাঁর লেখায় লিখছেন, "বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র কোনও 'সরকারি খেতাব’ কিম্বা পুরষ্কার পান নি। কেবল পেয়েছিলেন কিছু গুচ্ছের চাদর আর উত্তরীয়! শেষে বুকভরা অভিমান নিয়েই ১৯৯১ সালে পৃথিবীকে বিদায় জানিয়েছিলেন বাঙালির 'রেডিও পুরুষ'।" 

১৯৯১ সালের ৩ নভেম্বর মারা যান ‘বেতার পুরুষ' বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। শেষ বয়সের অনেক সাক্ষাৎকারে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কন্ঠে ধরা পড়েছিল অভিমানের সুর। তিনি বলেছিলেন – "ভাবতেই পারিনি সবাই আমাকে ভুলে যাবে …কিন্তু আমাকে ভুলে গেলেও বছরে একবার সেই দিনটিতে মানুষ আমাকে স্মরণ করবেই করবে। তাতেই আমার তৃপ্তি।’’ 

বাঙালির অবহেলিত কিংবদন্তি- যার চণ্ডীপাঠ নিয়ে এক সময় আপত্তি ছিল ব্রাহ্মণ সমাজের, মহালয়ার ভোরে তাঁরই চন্ডীপাঠ চলে ঘরে ঘরে- দেখুন ভিডিও


তথ্য ঋণ:

১| আমার ছেলেবেলা- বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র

২| কলকাতা বেতার, সম্পাদনা: ভবেশ দাশ ও প্রভাতকুমার দাস।

৩| বিরূপাক্ষ রচনা সমগ্র- বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।

৪| মনে পড়ে- বিকাশ রায়

৫|  Voice from the sky, The Telegraph