সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাবা দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ডিরোজিও সাহেবের স্নেহধন্য প্যারীচাঁদ মিত্রের প্রিয় বন্ধু। দুর্গাচরণ ছিলেন মেডিক্যাল কলেজের পড়ুয়া। ডেভিড হেয়ারের প্রিয় ছাত্র হলেও, সেই সময়কার ‘ইয়ং বেঙ্গল' গোষ্ঠীর সমর্থক ছিলেন তিনি। গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে হয়েও দুর্গাচরণের প্রশ্রয়ে সুরেন আধুনিক মনস্কতায় বেড়ে উঠেছিলেন।
ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম নিজেদের দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য একটি সংগঠন গঠিত হয়েছিল যার নাম, ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ (Indian Association)। ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম পাবলিক মিটিংয়ে (First Public Meeting of Indian Association) মঞ্চে ছিলেন কেশব সেন, বিদ্যাসাগর, দ্বারকানাথ ঠাকুরের মত দিকপাল ব্যক্তিত্ব। ১৮৮৬ সালে ‘কলকাতার কংগ্রেস অধিবেশনে’ সুরেন্দ্রনাথের ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন যুক্ত হয়েছিল ‘কংগ্রেসে’। কুড়ি বছর বয়সে সুরেন্দ্রনাথ ‘আইসিএস’ হওয়ার উদ্দেশে বিলেত পাড়ি দেন। জাহাজঘাটে ছাড়তে এসেছিলেন মধুসূদন দত্ত। লিখছেন- অনিরুদ্ধ সরকার
ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম পাবলিক মিটিং (First Public Meeting of Indian Association) চলছে। শয়ে শয়ে লোক। সভামঞ্চে বসে রয়েছেন কেশব সেন, বিদ্যাসাগর, দ্বারকানাথ ঠাকুরের মত দিকপাল ব্যক্তিত্ব। সেদিনের সভার সভাপতি কেশব সেন। সম্পাদক আনন্দমোহন বোস। সহ সম্পাদক অক্ষয় কুমার সরকার। সভার প্রধান অতিথি, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও বিশেষ অতিথি, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। ভারতবর্ষে প্রথম নিজেদের দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য একটি সংগঠন গঠিত হয়েছিল। নাম ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ (Indian Association)। যা তৈরি করেছিলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (Surendranath Banerjee)। ১৮৭৬ এর ২৬ জুলাই। টাউন হলে সেদিন ছাত্রদের ভিড় উপচে পড়েছিল।ভলান্টিয়াররা সামলাতে সেই ভিড় সামলাতে হিমশিম খেয়েছিলেন। ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ এর প্রথম অধিবেশন বসেছিল কলকাতায়। ১৮৮৩ সালের ডিসেম্বর মাসে। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছিলেন প্রতিনিধিরা। ১৮৮৫ সালে বসেছিল ‘দ্বিতীয় অধিবেশন’। আর এই দ্বিতীয় অধিবেশনে আত্মপ্রকাশ’ ঘটেছিল 'কংগ্রেসের'। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে প্রস্তাব এসেছিল ‘কংগ্রেসে’ যোগ দেওয়ার। ১৮৮৬ সালে ‘কলকাতার কংগ্রেস অধিবেশনে’ সুরেন্দ্রনাথ তাঁর দল নিয়ে যোগ দিয়েছিলেন ‘কংগ্রেসে’ (Congress)। এরপর সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (Surendranath Banerjee) সর্বভারতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন- Deshbandhu Chittaranjan : এক চিরদাতা, নিজেকে নিঃস্ব করে দিতে ভালোবাসতেন দেশবন্ধু
১৮৯৫ এবং ১৯০২ সালে তিনি ‘জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি’ নির্বাচিত হয়েছিলেন। ভারতবর্ষের রাজনীতি (Indian Politics) তখন দ্রুত বদলাচ্ছিল। বাংলায় একদিকে তখন অরবিন্দ ঘোষের (Arbinda Ghosh) নেতৃত্বে বিপ্লবী গুপ্ত সমিতি গড়ে উঠছে। গড়ে উঠছে ‘অনুশীলন সমিতি’, ‘যুগান্তর’ দলের মত বিপ্লবী সংগঠন। যারা সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা চাইছিলেন। ঠিক এইসময়েই কংগ্রেসে গান্ধীজির (Gandhiji) উত্থান হচ্ছে। আসছেন একের পর এক অহিংসপন্থী নেতা। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন দেখতে দেখতে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ল।সেখানে সুরেন্দ্রনাথের মত ভাববাদী নেতা গুরুত্ব হারাচ্ছিলেন।১৯১৮ সালে অত্যন্ত ‘তিক্ত অভিজ্ঞতা’ নিয়ে ‘কংগ্রেস’ ত্যাগ করলেন সুরেন্দ্রনাথ।
যাওয়া যাক বেশ কিছুটা সময় আগে, ১৮৬৮ সাল। ৩ ডিসেম্বর। সুরেন্দ্রনাথ রমেশচন্দ্র দত্ত ও বিহারীলাল গুপ্তকে সঙ্গে নিয়ে জাহাজে চেপে পাড়ি দিয়েছিলেন ইংল্যান্ড। তার আগের দিনই বারাকপুরের পিতৃগৃহ থেকে মাইকেল মধূসুদন দত্তের (Madhusudan Dutta) কাশীপুরের বাড়িতে চলে গেছিলেন সুরেন্দ্র। রাতে ছিলেন সেখানেই। মধূসুদন দত্ত (Madhusudan Dutta) ছিলেন সুরেনের বাবার বিশেষ বন্ধু। পরের দিন স্টিমারে করে খিদিরপুরে জাহাজঘাটে তাঁকে উঠিয়ে দিতে গেলেন খোদ মধুসূদন। বারাকপুর থেকে সাতসকালে বাবাও হাজির হলেন জাহাজঘাটে।কেন সুরেনকে এত কসরৎ করতে হল, কারণ সেযুগে বিলাত যাওয়া মানেই জাতিচ্যুত হওয়া। সমাজে সে পরিত্যজ্য। তাই পিতা লুকিয়ে পুত্রেকে পাঠালেন বিলেত আইসিএস (ICS) হতে। ঠিক ছ’বছর আগে কলকাতায় তৈরি হয়েছিল ‘হাইকোর্ট’ (Highcourt)। ‘ব্যারিস্টার’ বা ‘আইসিএস’ (ICS) হওয়ার জন্য উচ্চবিত্ত বাঙালি ভদ্রলোকেরা তাঁদের ছেলেদের বিলেতমুখো করছিলেন। বছর কুড়ির সুরেন্দ্রনাথও ‘আইসিএস’ হওয়ার উদ্দেশে জাহাজে চেপেছিলেন। পরের বছর ‘আইসিএস’ (ICS) পরীক্ষা দিয়েছিলেন। পাসও করেছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের ফের ডিসকোয়ালিফায়েড কারণ, বয়সের গণ্ডগোলে ! তখন ‘আইসিএস পরীক্ষার বয়সসীমা ছিল’ ১৬ থেকে ২১ বছর বয়সের মধ্যে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের (Calcutta University) সার্টিফিকেটে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Surendranath Banerjee) বয়স উল্লেখ করা ছিল ১৬। ব্যাস! পাস করা সত্যেও নাম বাদ পড়ায় সুরেন্দ্রনাথ আপিল করেছিলেন কোর্টে। আর তার সঙ্গে প্রশ্ন তুলেছিলেন ভারতীয়দের প্রতি ব্রিটিশ অবহেলার দিকটিকেও। সুরেনের সঙ্গে সঙ্গে সেদিন প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন , ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মহারাজ রমানাথ ঠাকুর, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র প্রমুখেরা। ভারতবর্ষের একাধিক কাগজে লেখা হয়েছিল এই ঘটনার বিরুদ্ধে একাধিক প্রতিবাদী লেখা। সুরেন্দ্রনাথ শেষ অবধি মামলা জিতেছিলেন কিন্তু ততদিনে পিতা দেহত্যাগ করেছেন। সুরেন্দ্রনাথ তাঁর আত্মজীবনী, ‘A Nation on Making’ বইয়ের এক জায়গায় লিখছেন, ‘‘I won the case but my father died on 20th Feb, 1870’’। সুরেন পিতার মৃত্যুর খবর পেয়েছিলেন বিদেশেই। ইংরেজরা সুরেনকে আবার পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি দিলে ১৮৭১ সালে সুরেন সসম্মানে পাশ করেছিলেন। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Surendranath Banerjee) বাবা দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ডিরোজিও সাহেবের স্নেহধন্য প্যারীচাঁদ মিত্রের প্রিয় বন্ধু। দুর্গাচরণ ছিলেন মেডিক্যাল কলেজের পড়ুয়া। ডেভিড হেয়ারের প্রিয় ছাত্র হলেও, সেই সময়কার ‘ইয়ং বেঙ্গল' গোষ্ঠীর সমর্থক ছিলেন তিনি। গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে হয়েও দুর্গাচরণের প্রশ্রয়ে সুরেন আধুনিক মনস্কতায় বেড়ে উঠেছিলেন।
কলকাতা টাউন হলে (Calcutta Town Hall) সুরেন্দ্রনাথকে ঘটা করে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। বাঙালি আইসিএসের (ICS) সেই সংবর্ধনা সভায় উপস্থিত ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র, কেশব সেন, সত্যেন ঠাকুরের মত মানুষ । সিলেটে প্রথম পোস্টিং পেয়েছিলেন সুরেন্দ্রনাথ (Surendranath Banerjee)। অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যাজিস্ট্রেট পদে। সেখানেও আবার বিতর্ক বেধেছিল। ‘জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এসসিসাথারল্যান্ড তাঁর বিরুদ্ধে ‘ডিপার্টমেন্টাল পরীক্ষা’ না পাশ করতে পারা ও ‘কাজে গাফিলতির' অভিযোগ এনেছিলেন। ফলে আবার তাঁকে বিলেত যাত্রা করতে হল। আবার আপিল। আবার কেস। কিন্তু সেবারে সুরেনকে ফিরতে হল একজন পরাজিত নায়কের মত। ফিরে আসার পার ভেঙে পড়লেন সুরেন। তখন বিদ্যাসাগর এলেন পরিত্রাতা হয়ে। সুরেনকে মেট্রোপলিটন স্কুলে দু’শো টাকার মাস-মাইনের ইংরাজি অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন বিদ্যাসাগর। ১৮৭৫ সাল সুরেন বিদ্যাসাগরের প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। তারপর ‘সিটি কলেজ’ (City College), ‘চার্চ কলেজ’ (Church College), ‘প্রেসিডেন্সি ইনস্টিটিউশন’ (Presidency Institution) হয়ে একাধিক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করলেন সুরেন্দ্রনাথ। দিনে দিনে ‘বাগ্মী’ হিসেবে সুরেন্দ্রনাথের নাম ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। সুরেন দেশভ্রমণ শুরু করেন। ভারতীয়দের অভাব অভিযোগ অসুবিধা দেখে একটি সংগঠন তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। জন্ম নিল ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন (Indian Association)। আর সেই অ্যাসোসিয়েশন একদিন গিয়ে মিশল কংগ্রেসের সাথে। আর সেই কংগ্রেসের দায়িত্ব নেওয়া সুরেন একদিন তিক্ততার জেরে কংগ্রেস (Congress) ছাড়লেন। কংগ্রেস ছাড়ার ৭ বছর পর মারা যান সুরেন্দ্রনাথ। রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে নিজেকে অনেকটা দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন সুরেন্দ্রনাথ। ১৯২৫ সালের ৬ আগস্ট ৭৭ বছর বয়সে বারাকপুরের বাড়িতেই জীবনাবসান হয় এই দিকপাল ব্যক্তিত্বের।