স্বাধীনতার জেরে হওয়া দাঙ্গায় হারিয়েছিলেন পরিবার, উড়ন্ত শিখ পরিচয়ে বিশ্ব জয় করেছিলেন মিলখা সিং

ভারতীয় ক্রীড়া (Indian Sports) ক্ষেত্রে ও নিজের ব্যক্তিগত জীবনেও ব্যর্থতা, লড়াই ও সাফল্যের সিঁড়ি যারা ধাপে  ধাপে উঠেছেন এমন ব্যক্তি খুবই কম। তাদের মধ্যে অন্যতম হলনে কিংবদন্তী (Legend) দৌড়বিদ মিলখা সিং (Milkha Sing)। স্বাধীনতার ৭৫ তম  (India 75) র্ষে মিলখা সিংয়ের জীবন সত্যিই অনুপ্রেরণার।
 

Sudip Paul | Published : Aug 13, 2022 10:04 AM IST / Updated: Aug 13 2022, 06:34 PM IST

ব্রিটিশ শাসন ,দেশভাগের যন্ত্রণা, প্রিয়জনদের হারানোর বেদনা সঙ্গে ক্ষুধার তীব্র ও প্রচণ্ড অনুভূতি। এই সবকিছু যদি কোনও মানুষকে একত্রে ভোগ করতে হয় তাহলে  জীবন নির্মম, দুর্বিসহ হয়ে ওঠে। মানুষের দৃষ্টি ও হৃদয় থেকে রূপ-সৌন্দর্য্য ও প্রেমের নান্দনিক বোধগুলিকে ধ্বংস করে দেয়। কিন্তু কঠিন পরীক্ষার পর যখন জীবনে উন্নতি আসে , নিবৃত্তি ঘটে ক্ষুধার তখনও রূপ, রং, প্রেম, সাফল্য জীনকে আন্দোলিত করে তোলে। কিন্তু জীবনের  এই কঠিন লড়াইয়ে সবাই জয়ী হতে পারে না। কারণ সবাই মিলখা সিং নয়। জীবনের এই সব প্রতিকুলতাকে হারাতে গিয়েই মিলখা সিং হয়ে উঠেছিলেন ফ্লাইং শিখ'। তাই তো দেশের ৭৫ তম স্বাধীনতা দিবসে মিলকা সিংকে শ্রদ্ধা জানাতেই হয়। ভারতীয় ক্রীড়া ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য।

১৯২৯ সালের ২০ নভেম্বর অবিভক্ত ভারতের ও  এখনকার পাকিস্তানের মুজফফরগড় জেলার গোবিন্দপুর গ্রামে এক শিখ রাজপুত পরিবারে জন্ম হয় মিলখা সিংয়ের। মিলখারা মোট ১৫ জন ভাইবোন ছিলেন। ১৯৪৭-এর দেশভাগের অশান্তির সময় চোখের সামনে নিজের মা-বাবাকে খুন হতে দেখেছিলেন ছোট্ট মিলখা। প্রাণ হারাতে হয়েছিল ৮ জন ভাই বোনকে। তারপর ভারতে চলে আসেন মিলখা সিং। দিল্লিতে এক দিদির কাছে আশ্রয় পায় মিলখা। দারিদ্র ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী। ক্ষুধার জ্বালা তখন অনুভব করেছিলেন ছোট্ট মিলখা। সেখান থেকেই শুরু হয় জীবনযুদ্ধে ছোট্ট মিলখা থেকে ফ্লাইং শিখ হয়ে ওঠার দৌড়।

১৯৫২ সালে চতুর্থবারে চেষ্টার সেনা বাহিনীতি চাকরি পান মিলখা সিং। সেনায় থাকাকালীন বিভিন্ন স্পোর্টস ইভেন্টে অংশ নেন মিলখা। দৌড়, খেলাধুলার প্রতি বরাবরই আকর্ষণ ছিল মিলখার। দৌড়ে মিলখার ধারেকাছে যে সেনাবাহিনীর অন্য জওয়ানরা কেউ ধারে কাছে আসতে পারত না, এই বিষয়টি সেনা কর্তাদের নজরে আসে। আর সেখান থেকেই শুরু হয় মিলখার দৌড়বিদ হওয়ার যাত্রা। ১৯৫৬ সালের অলিম্পিকে ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন মিলখা সিং। কিন্তু প্রথম রাউন্ড থেকেই ছিটকে যান তিনি। কিন্তু সাফল্য পেতে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি মিলখাকে। ১৯৫৬ এশিয়ান গেমসে ২০০ ও ৪০০ মিটারে সোনা জেতেন। 

১৯৫৮ সালে কার্ডিফে কমনওয়েলথ গেমসে অংশ নেন মিলখা সিংখা। শুধু প্রথম ভারতীয় হিসেবে কমনওয়েলথে সোনা জয় নয়, এমন রেকর্ড গড়েল মিলখা যা অক্ষত ছিল ৫২ বছর। ৪৬.৬ সেকেন্ড দৌড় শেষ করেন  মিলখা সিং। হারান সেই সময়কার তারকা আফ্রিকান স্প্রিনটার ম্যালকম স্পেন্সকে। ১৯৫৬ এশিয়ান গেমস ও ১৯৫৮ কমনওয়েলথ গেমসে সোনা জয়ের সুবাদে ১৯৫৮ সালে অর্জুন পুরস্কারে সম্মানিত করা হয় মিলখা সিংকে। একইসঙ্গে ১৯৬০ অলিম্পিকসে পদক জয়ের স্বপ্নও দেখতে শুরু করে গোটা দেশ। কিন্তু সামান্য ভুলের জন্য ১৯৬০ অলিম্পিকসে পদক হাতছাড়া হয় মিলখা সিংয়ের। চতুর্থ হন ভারতীয় স্প্রিনটার। ২৫মিটারে পৌছে জিতেছেন ধরে নিয়ে স্পিড কমাতেই, পদকের সঙ্গে দূরত্ব বেড়ে যায় মিলখার।

অলিম্পিকে পদক না পাওয়ার যন্ত্রণা ট্র্যাক থেকে দূরত্ব বাড়িয়েছিলেন মিলখা। তবে বেশি দিন পারেননি  নিজের জীবনকে দূরে সরিয়ে রাখতে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী  জহওরলাল নেহেরুর  আবেদনে সেই বছর পাকিস্তানে আয়োজিত ‘ডুয়াল চ্যাম্পিয়নশিপ'-এ নামেন মিলখা সিং। সেদেশের স্প্রিনটার ও চিরপ্রতীদ্বন্দ্বী আয়ূব খানের বিরুদ্ধে দুরন্ত গতিতে দৌড়ে প্রথম হন মিলখা।  পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান মিলখার দৌড় দেখে তাকে  'ফ্লাইং শিখ' তকমা দেন। এছাড়া ১৯৬২-র এশিয়ান গেমসে ৪০০ মিটার দৌড় এবং ৪০০ মিটার রিলে রেসে সোনা পান তিনি। ১৯৬৪ সালের কলকাতা ন্যাশনাল গেমসেও ৪০০ মিটার দৌড় বিভাগে রূপো জয় করেন মিলখা। ১৯৬২ সালেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন মিলখা সিং। বিয়ে করেন ভারতীয় মহিলা ভলিবল দলের প্রাক্তন অধিনায়ক নির্মল কৌরকে। তাদের একটি পুত্র ও দুটি কন্যা সন্তান রয়েছে। 

২০১৩ সালে মিলখা সিংয়ের জীবনীর উপর ছবি তৈরি করেন পরিচালক ওমপ্রকাশ মেহেরা। মিলখার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ফারহান আখতার। ছবিতে তাঁর জীবন দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন মিলখা সিং। ২০১৭ সালে পৃথিবীর বিখ্যাত মিউজিয়াম মাদাম তুসো তার মূর্তি বসানো হয়। সেই মূর্তি দেখতে যান মিলখা সিং। নিজের দৌড়ানোর ভঙ্গিতে ছবিও তোলেন কিংবদন্তী দৌড়বিদ। কিংবদন্তী অ্যাথলিটকে সম্মান জানাতে ২০১৮ সালে 'খেল রত্ন' সম্মানে সম্মানিত করা হয় মিলখা সিংকে। জীবনের অন্যতম স্মরণীয় দিন ছিল তাঁর কাছে।

অবশেষে করোনা অতিমারীর কারণে ৯১ বছর বয়সে থামে মিলখা সিংয়ের দৌড়। ২০২১ সালের ২০ মে বাড়ির এক পরিচারিকার থেকে করোনা সংক্রামিত হন মিলখা সিং ও তাঁর স্ত্রী নির্মল কৌর। ১৩ জুন মৃত্যু হয় নির্মল কৌরের। ৩০মে মিলখা সিং কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেও ফের অক্সিজেনের অভাব হওয়ায় ফের তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবশষে চিকিৎসকজের যাবতীয় প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে ক্রীড়া বিশ্বকে শোকস্তব্ধ করে ১৮ জুন ২০২১ সালে প্রয়াত হন কিংবদন্তী মিলখা সিং। শোক প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে ক্রীড়া, রাজনৈতিক, বিনোদন জগৎ সহ সর্বস্তরের মানুষ।  ভারতীয় স্পোর্টসের ভবিষ্যৎকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন কিংবদন্তী দৌড়বিদ। 'ফ্লাইং শিখ' মিলখা সিংয়ের জীবনযুদ্ধ সত্যিই আগামির অনুপ্রেরণার।

আরও পড়ুনঃলালা অমরনাথ স্বাধীন ভারতের প্রথম ক্রিকেট ক্যাপ্টেন, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ছিলেন ভারতের গর্ব

আরও পড়ুনঃভারতীয় মহিলা ক্রিকেটের পথ প্রদর্শক, আগামি প্রজন্মের অনুপ্রেরণা 'লেডি সচিন' মিতালি রাজ

Read more Articles on
Share this article
click me!