কৃষকদের নয়া দিল্লির অভিযান আপাতত স্থগিত, এমএসপি নিয়ে মোদী সরকার নিলেন ৫ বড় সিন্ধান্ত

এমএসপি নিয়ে কেন্দ্র একটি প্রস্তাবনা দিয়েছে। সেই প্রস্তাবনা পড়া ও তা নিয়ে আলোচনা করার জন্য কিছু সময় চেয়েছে কৃষকরা। এরপর আপাতত দিল্লি চলো অভিযান স্থগিত বলেই জানানো হয়েছে।

 

deblina dey | Published : Feb 19, 2024 3:48 AM IST

১৬ ফেব্রুয়ারি ছিল পাঞ্জাবের কৃষকদের নয়া দিল্লিতে কিষান আন্দোলনের চতুর্থ দিন। শম্ভু সীমান্তে এখনও দাঁড়িয়ে আছে কৃষকরা। এবার ন্যূনতম এমএসপি-এর দাবিতে রাস্তায় নেমেছে কৃষকরা। কৃষকদের দাবি, সরকারকে এমএসপিতে কেনার নিশ্চয়তা দিতে আইন করা উচিত। সরকার এমএসপি-তে আইনি গ্যারান্টি দেবে কিনা তা নিয়ে জাতীয় বিতর্ক শুরু হয়েছে। বৃহস্পতিবার ১৫ ফেব্রুয়ারি চণ্ডীগড়ে কৃষক নেতা এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের মধ্যে তৃতীয় দফা আলোচনাও নিষ্ফল ছিল। এতে, সরকার এমএসপি নিয়ে একটি আইন প্রণয়নের জন্য একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেছে, যেখানে কৃষক এবং সরকার উভয়ের প্রতিনিধি থাকবেন। কিন্তু কৃষক নেতারা এমএসপিতে ক্রয়ের নিশ্চয়তা দেওয়ার বিষয়ে অনড় ছিলেন। এখন চতুর্থ দফা বৈঠক হবে ১৮ ফেব্রুয়ারি রবিবার সন্ধ্যা ৬টায়। ততক্ষণ পর্যন্ত শান্তি বজায় রাখার আশ্বাস দিয়েছিলেন উভয় পক্ষ।

অশান্তি বন্ধ রাখতে কৃষকদের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনায় কেন্দ্র। রবিবার চতুর্থ দফায় কৃষকদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিল কেন্দ্র। সূত্রের খবর অনুসারে, এমএসপি নিয়ে কেন্দ্র একটি প্রস্তাবনা দিয়েছে। সেই প্রস্তাবনা পড়া ও তা নিয়ে আলোচনা করার জন্য কিছু সময় চেয়েছে কৃষকরা। এরপর আপাতত দিল্লি চলো অভিযান স্থগিত বলেই জানানো হয়েছে।

কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পীযূষ গয়াল জানান, কেন্দ্রের তরফে পাঁচ বছরের জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের সাহায্যে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দিয়ে ডাল, ভুট্টা ও তুলা ফসল কেনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। মুগ, মসুর ও মাসকলাই ডাল উৎপাদনকারী কৃষকদের সঙ্গে ন্য়াশনাল কোঅপারেটিভ কনজিউমার ফেডারেশন, ন্যাশনাল এগ্রিকালচার কোঅপারেটিভ মার্কেটিং ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ার মতো সরকারি সংস্থাগুলি চুক্তিবদ্ধ থাকবে।

পাঁচ বছরের জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে কৃষকদোর থেকে এই ফসল কেনা হবে। কত পরিমাণ ফসল কেনা হবে, এখনও কোনও উর্ধ্বসীমা স্থির করা হয়নি। এই ফসল কেনা-বেচার জন্য একটি ভিন্ন পোর্টালও তৈরি করা হবে। সরকারের এই সিদ্ধান্তে কৃষকরা উপকৃত হবেন বলে জানানো হয়েছে। এছাড়া কৃষকদের ঋণে ছাড় সহ অন্যান্য দাবিগুলি নিয়ে এখনও আলোচনা হয়নি। পরবর্তী বৈঠকে এই সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা হওয়ার কথা।

এমএসপি ছাড়াও কৃষকদের মূল দাবি কী?

- MNREGA-তে প্রতি বছর ২০০ দিনের কাজ দেওয়া উচিত। এর জন্য দৈনিক মজুরি নির্ধারণ করতে হবে ৭০০ টাকা।

- ডঃ স্বামীনাথন কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী এমএসপি-এর মূল্য নির্ধারণ করা উচিত।

-কৃষক ও কৃষি শ্রমিকদের ঋণ মওকুফ করে পেনশন দিতে হবে।

- ভূমি অধিগ্রহণ আইন ২০১৩ পুনরায় কার্যকর করা উচিত।

-লখিমপুর খেরি ঘটনার দোষীদের শাস্তি হওয়া উচিত।

-মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিষিদ্ধ করা উচিত।

- বিদ্যুৎ সংশোধনী বিল ২০২০ বাতিল করা উচিত।

- কৃষক আন্দোলনে নিহত কৃষকদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ এবং পরিবারের একজন সদস্যকে সরকারি চাকরি দিতে হবে।

নকল বীজ, কীটনাশক, ওষুধ ও সার বিক্রিকারী কোম্পানির বিরুদ্ধে কঠোর আইন করতে হবে।

লঙ্কা, হলুদ ও অন্যান্য মসলার জন্য জাতীয় কমিশন গঠন করতে হবে।

সংবিধানের ৫ নং তালিকা আলাদা করে আদিবাসীদের জমি লুটপাট বন্ধ করতে হবে।
 

এমএসপি নিয়ে সমস্যা কেন?

কৃষক এবং সরকারের মধ্যে আলোচনার বিষয়টি কেবল এমএসপিতে আটকে রয়েছে। একটি অনুমান অনুযায়ী, সরকার যদি কৃষকদের দাবি মেনে নেয়, তাহলে নয়াদিল্লির কোষাগারে প্রায় ১০ লক্ষ কোটি টাকার বোঝা চাপাবে। কিন্তু কৃষকদের যুক্তি ভিন্ন। তারা মনে করেন তাদের কৃষিকাজ কর্পোরেটদের হাতে চলে যেতে পারে। সাধারণত এমএসপি ফসল উৎপাদনের খরচের তুলনায় ৩০ শতাংশ বেশি, কিন্তু কৃষকদের চাহিদা এর চেয়ে অনেক বেশি।

২০২১ সালে, কেন্দ্রীয় সরকার তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করেছিল। এর পরে, এমএসপি ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর এবং স্বচ্ছ করতে, সরকার ১৮ জুলাই, ২০২২-এ প্রাক্তন কৃষি সচিব সঞ্জয় আগরওয়ালের সভাপতিত্বে ২৬ জন সদস্যের একটি উচ্চ স্তরের কমিটি গঠন করেছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিষয়টির সমাধান হয়নি কারণ কৃষকদের এমএসপির সংজ্ঞা সরকারের সঙ্গে মেলেনি।

ফসলের উপর এমএসপির সমীকরণটি ৫৭ বছরের পুরনো-

এমএসপির বিষয়টি ৫৭ বছরের পুরনো। ১৯৬৫ সালে, কেন্দ্রীয় সরকার কৃষি খরচ ও মূল্য কমিশন (CACP) তৈরি করে, যা এমএসপি নির্ধারণ করে। ১৯৬৬-৬৭ সালে সরকার প্রথমবারের মতো কৃষকদের থেকে এমএসপি-তে ফসল কিনেছিল। বর্তমানে সরকার এমএসপিতে ২৩টি ফসল কেনে। এর মধ্যে রয়েছে ৭টি শষ্য, ৬টি তৈলবীজ, ৫টি ডাল এবং ৪টি অন্যান্য ফসল।

প্রশ্ন হচ্ছে সবকিছু ঠিক থাকলে কৃষকরা আন্দোলন করছেন কেন? আসলে এই আন্দোলনের পেছনে রয়েছে পুরনো ব্যবস্থার প্রতি আস্থা আরও জোরদার করার দাবি। কৃষকদের দাবি, সরকার যে এমএসপি দিচ্ছে তা স্বামীনাথন কমিশন অনুযায়ী দেওয়া উচিত। সরকারের উচিত এমএসপি গ্যারান্টি অর্থাৎ এটিকে একটি আইন করা। এর মাধ্যমে সব ফসলই এমএসপির আওতায় আনা যাবে। যদি কোনও ব্যবসায়ী এমএসপির চেয়ে কম দামে শস্য ক্রয় করেন তবে তাকে ফৌজদারি অভিযোগের মুখোমুখি হতে হবে।

আসলে, এখনও পর্যন্ত এমএসপি নিয়ে কোনও আইন নেই। সরকার চাইলে এমএসপির হার বাড়াতে বা কমাতে পারে। সেই কারণে কৃষকরা এমএসপির আইনি গ্যারান্টি চান, তবে এই গ্যারান্টি নিয়েও কিছু প্রশ্ন উঠছে।

স্বামীনাথন কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে যুদ্ধ শুরু হয়-

স্বামীনাথন কমিশন ২০০৪ সালে তৈরি হয়েছিল। এতে, খরচের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি এমএসপি সুপারিশ করা হয়েছে। তবে এই প্রতিবেদন নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। ১৯৬৫ সালে, দুর্ভিক্ষ এবং যুদ্ধের মধ্যে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ভারতকে খাদ্য বিষয়ে স্বনির্ভর করার দায়িত্ব কৃষি বিজ্ঞানী এমএস স্বামীনাথনকে দিয়েছিলেন। স্বামীনাথনের প্রচেষ্টায় যে সবুজ বিপ্লব এসেছিল তাতে ভারতের পেট ভরতে থাকে। সরকার এই বছর এমএস স্বামীনাথনকে ভারতরত্ন (মরণোত্তর) প্রদান করেছে।

স্বামীনাথন কমিশন ২০০৪ সালে গঠিত হয়-

২০০৪ সালে, স্বামীনাথনের নেতৃত্বে মনমোহন সিং সরকার জাতীয় কৃষক কমিশন গঠন করে, যা স্বামীনাথন কমিশন নামেও পরিচিত। একই কমিশনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সরকার জাতীয় কৃষিনীতি প্রণয়ন করে। এতে কৃষকদের আয় বাড়ানোর প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি উন্নতমানের বীজ দেওয়ার ব্যবস্থাও ছিল।

ফসলের খরচ কিভাবে নির্ধারণ করবেন?

এখন প্রশ্ন হলো একটি ফসলের মূল্য কীভাবে নির্ধারণ করবেন? এর জন্য একটি সূত্র আছে যে কৃষকের সরাসরি খরচ যেমন বীজ, সার, কীটনাশক, শ্রম, খামার ভাড়া, সেচ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। দ্বিতীয় সূত্রে প্রত্যক্ষ খরচের সঙ্গে কৃষকের পরিবারের কঠোর পরিশ্রমও অন্তর্ভুক্ত। স্পষ্টতই এমএসপি ইস্যুটি একটি জাতীয় বিতর্কে পরিণত হয়েছে। শিগগিরই শেষ হওয়ার কোনও লক্ষণ নেই।

Share this article
click me!