স্বাস্থ্যজনিত কারণে আর জামিন পাওয়া আর হল না
তার আগেই চলে গেলেন ফাদার স্ট্যান স্বামী
গত বছর এলগার পরিষদ মামলায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গ্রেফতার করা হয়েছিল
দেশে-বিদেশে প্রবল সমালোচনায় চাপে মোদী সরকার
স্বাস্থ্যজনিত কারণে জামিন পাওয়া আর হল না তাঁর। সোমবার এই মামলার শুনানিতে হাজির হয়ে তাঁর আইনজীবী জানান, গত বছর এলগার পরিষদ মামলায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গ্রেফতার হওয়া ৮৪ বছর বয়সী পাদ্রী তথা মানবাধিকার কর্মী ফাদার স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু হয়েছে। রবিবার, থেকেই তাঁকে ভেন্টিলেটরের সহায়তা দেওয়া হয়েছিল। তিনি পার্কিনসনস রোগে ভুগছিলেন,কারাগারে কোভিড-১৯ আক্রান্তও হয়েছিলেন। এদিকে, তাঁর মৃত্যুতে দেশে বিদেশে নতুন করে চাপে পড়ল মোদী সরকার। স্ট্যান স্বামীর মৃত্যুতে একদিকে যেমন দেশের বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা একযোগে কেন্দ্রীয় সরকারে সমালোচনা করেছেন, তেমনই রাষ্ট্রসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
২০২০ সালে গ্রেফতারের আগেই তাঁর স্নায়ুর রোগ 'পার্কিনসনস ডিজিজ' ধরা পড়েছিল।তারপরও, গত অক্টোবরে গভীর রাতে তাঁকে বাড়ি থেকে গ্রেফতার করেছিল জাতীয় তদন্ত সংস্থা বা এনআইএ। তারপর থেকে বারেবারে, পার্কিনসন রোগের কারণে জল খাওয়ার জন্য একটি স্ট্র এবং সিপার-এর প্রয়োজন থেকে শুরু করে তাঁর রোগের চিকিৎসার মতো কারণে তাঁকে আইনি লড়াই লড়তে হয়েছে। একাধিকবার তিনি স্বাস্থ্যগত কারণে অন্তর্বর্তীকালীন জামিনের আবেদন করেছিলেন। কিন্তু, এনআইএ তার বিরোধিতা করে বলেছে, তাঁর অসুস্থতার কোনও 'সিদ্ধান্তমূলক' প্রমাণ নেই। দাবি করেছিল স্ট্যান স্বামী একজন মাওবাদী, দেশে অশান্তি সৃষ্টির ষড়যন্ত্র করেছিলেন।
গত ২৮ মে আদালতের নির্দেশে স্টান স্বামীকে মুম্বই-এর এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। এনআইএ যদিও চেয়েছিল কোনও সরকারি হাসপাতালে তাঁকে রাখা হোক। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে হাইকোর্টকে স্ট্যান স্বামী বলেছিলেন, নবি মুম্বইয়ের তালোজা কারাগারে তাঁর স্বাস্থ্যের ধারাবাহিক অবনতি হয়েছে। যদি অন্তর্বর্তীকালীন জামিন না মঞ্জুর করা হয় তবে তিনি শীঘ্রই মারা যাবেন। গত সপ্তাহে, স্টান স্বামী আবার তাঁর বিরুদ্ধে হওয়া বেআইনি কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ আইন বা ইউএপিএ (UAPA)-এর আওতায় হওয়া মামলায় জামিনের জন্য দেওয়া কঠোর শর্তকে চ্যালেঞ্জ করে বম্বে হাইকোর্টে জামিনের জন্য নতুন আবেদন করেছিলেন। তারই শুনানি ছিল আজ। কিন্তু তা শুরু হওয়ার আগেই, দুপুর দেড়টা নাগাদ তাঁর মৃত্যু হয়।
স্টান স্বামীর মৃত্যুর পর ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন, কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন, কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী, প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্র, আইনজীবী মানবাধিকার কর্মী প্রশান্ত ভূষণ, সাংবাদিক রানা আয়ুব, কণ্ঠশিল্পী টিএম কৃষ্ণ, অভিনেত্রী রিচা চাড্ডা-সহ অন্তত কয়েকশ রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবী শোক প্রকাশ করেছেন। বিরোধী দল ও নেতা-কর্মীরা এই প্রবীণ মানবাধিকার কর্মীকে হেনস্থা করার অভিযোগ এনেছে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে।
হেমন্ত সোরেন বলেছেন, 'উদাসীনতা এবং সময়মতো চিকিৎসা পরিষেবা না দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের জবাবদিহি করা উচিত'। পিনারাই বিজয়ন বলেছেন, 'যে ব্যক্তি সমাজের নিপীড়িত মানুষগুলির জন্য সারা জীবন লড়লেন, বন্দি অবস্থায় তাঁর মৃত্যু ঘটবে এটা ন্যায়বিচার নয়'। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী এবং প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্রও টুইট করে 'ফাদার স্টান স্বামীর জন্য ন্যায় বিচার চেয়েছেন। মৃত্যুর কয়েক ঘন্টার আগেও তাঁকে মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, বলে অভিযোগ করেছেন।
অন্যদিকে, সাংবাদিক রানা আইয়ুব টুইট করে বলেছেন, ফাদার স্ট্যান স্বামীর এই মৃত্যুতে দেশবাসী হিসাবে লজ্জায় তাঁর মাথা হেট হয়ে আছে। আইনজীবী-মানবাধিকারকর্মী প্রশান্ত ভূষণ বলেছেন, এই অত্যন্ত ভদ্র ও বিনয়ী মানুষের এই মৃত্যু রাষ্ট্র পরিচালিত হত্যার থেকে কম কিছু নয়। কণ্ঠশিল্পী টিএম কৃষ্ণ বলেছেন, ফাদার স্ট্যান স্বামীর জীবনের শেষ দিকে যা যা ঘটেছে তার জন্য 'ভারত সরকার এবং আমাদের অসংবেদনশীল বিচার বিভাগ দায়বদ্ধ'। পার্কিনসনের কারণে জল না খেতে পারা স্ট্যান স্বামীকে স্ট্র বা সিপার দিতে অস্বীকার করেছিল এনআইএ, সেই কথা উল্লেখ করে অভিনেত্রী রিচা চাড্ডা বলেছেন, 'কী লজ্জা! কী লজ্জা!'
দেশের বাইরেও ফাদার স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মানবাধিকার কর্মীরা। রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার রক্ষাকারী বাহিনীর বিশেষ প্রতিনিধি মেরি লোলা টুইট করে বলেছেন, এই খবর বিধ্বংসী। মানবাধিকার রক্ষী এবং জেসুইট পাদ্রি ফাদার স্টান স্বামীকে 'সন্ত্রাসবাদের মিথ্যা অভিযোগে গ্রেফতার করে নয় মাস আটকে রাখা হয়েছিল বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। মানবাধিকারের রক্ষীদের জেলবন্দি করা একেবারেই সমর্থন করা যায় না বলে সাফ জানিয়েছেন তিনি। টুইটের সঙ্গে তিনি একটি ইউটিউব ভিডিওর সাথে একটি লিঙ্ক জুড়ে দিয়েছেন, যেখানে ফাদার স্ট্যান স্বামী তাঁর কর্মকাণ্ড ব্যাখ্যা করেছিলেন।
মেরি লোলার পোস্টটিকে ফের টুইট করেছেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে মানবাধিকারের জন্য বিশেষ প্রতিনিধি ইমন গিলমোর। তিনি জানিয়েছেন স্টান স্বামীর মৃত্যুর খবরে তিনি গভীর শোকাহত। তাঁকে 'আদিবাসীদের অধিকার রক্ষাকারী' বলে উল্লেখ করে গিলমোর জানিয়েছেন, ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে তাঁর মুক্তির জন্য বারবার আবেদন করেছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। গত জানুয়ারি মাসেই সুইজারল্যান্ডে অবস্থিত রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার পরিষদের পক্ষ থেকে স্টান স্বামী এবং অন্যান্য মানবাধিকার কর্মীদের স্বাস্থ্যের অবস্থা নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল। এই অবস্থায় হেফাজতে থাকাকালীন স্ট্যান স্বামীর মৃত্যুতে, ফের অসহিষ্ণুতার অভিযোগে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে আঙুল উঠছে।