ভারতের সবথেকে জনপ্রিয় কবিতা লেখা থেকে শুরু করে পাকিস্তানের ধারনার শ্রষ্টা-- ইকবালের চিন্তাভাবনার একটি আমূল পরিবর্তন দেখা যায়।
নাজমুল হোডা, প্রতিবেদেক 'সারে জাহান সে আচ্ছা হিন্দুস্তান হামারা' (Sare Jahan Se Achcha)-- আমাদের দেশর সবথেকে জনপ্রিয় দেশাত্মবোধক গানগুলির মধ্যে অন্যতম। দেশের সামরিক বাহিনী বা পুলিশের ব্যান্ডও বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে এই গানটি বাজিয়ে থাকে। কিন্তু পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে যে তিন জনের নাম উঠে আসে তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মহম্মদ ইকবাল (Mohammad Iqbal)। পাকিস্তানের (Pakistan) আধ্যাত্মিক জনকই ছিলেন তিনি।
ভারতের সবথেকে জনপ্রিয় কবিতা লেখা থেকে শুরু করে পাকিস্তানের ধারনার শ্রষ্টা-- ইকবালের চিন্তাভাবনার একটি আমূল পরিবর্তন দেখা যায়। একদিকে তিনি ভারতের সভ্যতা ঐতিহ্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মহত্বকে স্থান দিয়েছেন তাঁর কবিতার মধ্যে অন্যদিকে তিনি জাতীয় ঐক্যে স্বার্থের কথা তুলে ধরে ধর্মীয় বিভাজনকে গুরুত্ব দিয়েছেন।
নয়া শিবালা কবিতায় দেশপ্রেমিক স্বত্ত্বা তুলে ধরে ভারতবাসীতকে উদ্দীপিত করেছেন ইকবাল। বিশ্বসাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ট গ্রন্থের মধ্যে তার রচনা স্থান পেয়েছে। কিন্তু সেই তিনি একটা সময় শিল্পের জন্য শিল্প তৈরি করেননি। বরং নিজেকে ইসলামের আধিপত্য পুনরুদ্ধারের জন্য সহস্রাব্দের বার্তাবাহক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। যা তার নান্দনিক উচ্চতা, গভীর দার্শনিক সত্ত্বা আর রহস্যময় অন্তর্দৃষ্টিকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। তাঁর এই আচরণ এখনও উর্দু সাহিত্যিক ও ভারত-পাকিস্তানের মুসলমানদের মতামতকে প্রভাবিত করে চলেছে। তাঁর চেয়ে অনেক বেশি ধর্মীয় মতাদর্শ বা চরমপন্থার উত্থান হয়েছে। কিন্তু ইকবালের মতাদর্শ অনেক বেশি মানুষকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছে।
ইকবালের দর্শন
ইকবাল তাঁর কবিতাকে বিভক্ত করেন তাঁর প্রাক ও উত্তর ইউরোপীয় প্রবাস, উচ্চ শিক্ষার জন্য লন্ডন ও জার্মানিতে অবস্থানের সময়ের ওপর বিচার করে। এই অবস্থান তাঁকে একটি মতাদর্শ গঠন করতে সাহায্য করেছিল। যা প্রাচ্যবাদের সাদৃশ্য অনুসারে, অক্সিডেন্টালিজম বলা যেতে পারে। আরও অতটি বিষয় হল যা পরবর্তীকালে আদর্শিক অনুভূমিত রেখে দিয়েছিল। তবে এটি একাডেমিক শৃঙ্খলার মাধ্যাকর্ষণ কখনই অর্জন করতে পারে না। ইকবাল পাশ্চাত্যকে নৈতিক অবক্ষয় ও আধ্যাত্মিক শুষ্কতার শেষ অবস্থায় পেয়েছিলেন। কামনা করেছিলেন যে এটি সেই যন্ত্রের সঙ্গে আত্মহত্যা করুক যা তাঁকে ধার দিয়েছে। তাংর ভাষা, আধুনিকতা, যৌতিক্ততা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নামে একটি মিথ্য ধারানা।
মুসলমানদের মধ্যে আধুনিকতা-বিরোধী (পশ্চিম বিরোধী) মনোভাব তৈরিতে তাঁর কবিতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। স্যার সৈয়নের বিজ্ঞান যুক্তিকতার সমর্থনেক সম্পূর্ণ উল্টোদিতে হেঁটেছিলেন ইকবাল। মুলসমানদের সামাজিক ও ধর্মীয় আলোচনায় আধুনিকতার ছোঁয়া লাগাতে রাজি ছিলেন না তিনি। তাঁর মতাদর্শ নাৎসি, ফ্যাসিবাদ, সামরিকবাদ-এই তিনটি ভাবধারা কঠোরভাবেই তিনি তাঁর আদর্শ ও চিন্তাভাবনায় স্থান দিয়েছিলেন। তিনি নাৎসিদের উবেরমেনসাকে ইসলামে রূপান্তর করেছিলেন। জার্মান দার্শনিকের নাম পরিবর্তন করে মর্দ ই মোমিন রাখেন। মর্দ ই মোমিনের এভিয়ান প্রতিরূপ হিসেবে শাহীন - ঈগল বা শিকারী পাখির প্রতীক তৈরি করেছিলেন। শাহীন শব্দটি সেইসময় মুসলিমদের জলপ্রিয় নামগুলির অন্যতম ছিল। কবিতাও এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়। আক্ষরিক অনুবাদে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। কিন্তু ব্যাখ্যায় তিনি আলফা মুলসিল পুরুষ। যুক্তি ও যৌক্তিকতাকে ইকবাল গুরুত্ব কম দিতেন। পাল্টা ধর্মীয় মানসিকতাই তাঁর কাছে বেশি প্রাধান্য পেত। বিজ্ঞানের সঙ্গে তাঁর তীব্র বিরোধিতা ছিল।
Jammu Kashmir: কাশ্মীরি পণ্ডিতের দোকানের মুসলিম কর্মীকে হত্যা, জঙ্গিদের গুলিতে রক্তাক্ত উপত্যকা
আধুনিক শিক্ষা ও ইকবালের দর্শন
লিঙ্গ ইস্যুকে ইকবার কঠোরভাবে সমর্থন করতেন।আধুনিক শিক্ষাকে নারীত্বের জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করতেন। তাঁর ধারনা ছিল কোনও শিক্ষিত মহিলা তাঁর জীবনের অপূর্ণ আশা পুরণ করার জন্য নিজের মেয়েকে কনভেন্ট শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চাইবেন। কিন্তু সেই শিক্ষিত মহিলার এই ভাবাদর্শই পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় বাধা তৈরি করবে। আধিপত্যবাদীদের মতই তিনি তাঁর ফ্যাকাশে গোষ্ঠীর বাইরে ভালো বা উন্নত কিছুই দেখতে চাননি। ভ্রান্ত মুসলমান আচার-আচরণের সঙ্গে হিন্দু ও খ্রিস্টান ও ইহুদিরে সঙ্গে তুলনা করে রীতিমত কটাক্ষ করতেন তিনি।
ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রতি মনোভাব
ইকবালের চিন্তাধারায় সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রতি তাঁর মনোভাবের পরিবর্তনে। যতক্ষণ পর্যন্ত মুসলিম আধিপত্য বজায় রাখা ততক্ষণ পর্।ন্ক জাতীয়তাবাদের ধারনা নিয়ে তাঁর কোনও সমস্যা তৈরি হয়নি। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট দেশে ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ কার্যত অভিন্ন। কিন্তু সংখ্যালঘু দেশগুলিতে একটি একটি সাংস্কৃতিক ইউনিট হিসেবে আত্মনিয়ন্ত্রণ চায়।
Rafale deal: ভারতকে রাফাল যুদ্ধবিমান বিক্রি করতে কোটি কোটি টাকা ঘুষ, ফরাসি রিপোর্টে চাঞ্চল্য
ইকবালের ভারতীয় জাতীয়তবাদ প্রত্য়াক্ষাণের কারণ ছিল গণতন্ত্র ও হিন্দু ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা। ইকবালের কাছে গণতন্ত্র ছিল একটি সরকারি ব্যবস্থা। যা মানুষের সংখ্যা গণনা করে। সেখানে মূল্যের কোনও দাম নেই। তাঁর কথায় রাজনীতি ও ধর্মকে যদি আলাদা করা হয় তাহলে তা বর্বরতার সামিল হবে। ইকবালের ধর্মনিরক্ষেপতা ও গণতন্ত্রের নিন্দা এখনও মুসলিম সমাজের একটি অংশের কাছে রীতিমত গুরুত্বপূর্ণ। মুসলিমদের রাজনৈতিক আধিপত্য ফিরেয়ে আনাই ছিল তাঁর বিশ্ব দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু।
ইকবালের কবিতা
উর্দুতে কথা বলার জন্য তাঁর কবিতা একটা সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। কিন্তু সেই কবিতায় ধর্মীয় উচ্ছ্বাস এক অন্য মাত্রা নিয়েএসেছিল। একটা সময় মুসলিমদের বক্তৃতায় ইকবালের কবিতার লাইন তুলে ধরা হত। গদ্য লেখার সময় ইকবাল যুক্তিযুক্ত যুক্তিবাদী হতে পারেন। যা তার কবিতার বিপরীতে সর্বদা ইংরাজিতে করতেন। তিনি কামাল আতা তুর্কের প্রশংসা করতেন। পাশাপাশি গীর্জা ও রাষ্ট্রের পৃথকীকরণ হিসেবে খিলাফত বিলুপ্তির কথাও বলেছিলেন। তবে ইসলাম ধর্ম ফিরিয়ে এনে পুনপ্রতিষ্ঠিত করার ওপরেই জোর দেন তিনি।
(লেখক একজন আইপিএস অফিসার, নাজমুল হোডা, এই প্রতিবেদনে লেখা লেখকের ব্যক্তিগত মতামত। এর সঙ্গে এশিয়ানেট নিউজ বাংলার কোনও যোগ নেই। )