রেনেসাঁ চক্রবর্তী, কনট্রিবিউটর সাংবাদিক- সালটা ১৯৮৪।৩১ অক্টোবর। পানাগড়ের কাছে একটি গ্রামের আল-পথ ধরে ছুট মারছেন বছর চল্লিশের এক সুদর্শন লোক। শরীরে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবী। ফরসা পায়ে নেই কোনও জুতো। এদিকে তাঁর পিছন পিছন ছুটছে সেনা উর্দি পরা বেশকিছু জওয়ান। মাঠে-ঘাটে কাজ করা লোকজনেরও বোঝার ক্ষমতা নেই হচ্ছেটা কী। খানিক পরে একটি গ্রামে দাওয়াতে গিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বসে পড়েছিল সেই সুদর্শন পুরুষ। আদিবাসী গ্রামে তখন তাঁকে দেখতে ভীড় জমে গিয়েছে। জুতোহীন ফরসা পায়ে মাঠ ডিঙিয়ে আসা কাদা ভর্তি। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবী-তেও কাদা ভর্তি। জল চাইতে-ই গ্রামের লোকজন তাঁকে জলও খাওয়ায়। বাংলায় অনেকে জিঞ্জেসও করেন, তাঁর নাম কি। চুপচাপ থম মেরে বসে থাকার পর লোকটি জানিয়েছিলেন তাঁর নাম রাজীব গান্ধী। এর বেশি আর কিছুই তিনি উত্তর করতে পারেননি। কারণ, মেঠোয়ালি বাাংলা ভাষা বোঝার মতো ক্ষমতা ছিল না রাজীবের। খানিক পরেই প্রণব মুখোপাধ্যায় এবং সেনা জওয়ানরা এসে কঠোর নিরাপত্তায় তাঁকে নিয়ে চলে যান। এই কাহিনি আজও অনেকেরই অজানা। কিন্তু, সেদিন রাজীবের সঙ্গে যারা পানাগড়ে সেনা বিমানবন্দরের উদ্দেশে যাচ্ছিলেন তাঁরা সকলেই জানেন।
পরবর্তীকালে সেদিন রাজীবের গাড়ি চালক-ও এই ঘটনা অনেকের কাছেই বলেছিলেন। জানিয়েছিলেন মা-এর হত্যায় ভীত-সন্ত্রস্ত রাজীব কীভাবে আতঙ্কে গাড়ি থেকে নেমে পানাগড়ের কাছে নয়ানজুলি ভেঙে, গ্রামের আলপথ দিয়ে দৌঁড় দিয়েছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী-র হত্যার দিন দক্ষিণবঙ্গে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দলীয় কাজে সফর করছিলেন রাজীব। মাঝপথেই ইন্দিরা হত্যার খবর পৌঁছয় প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছে। জানা যায়, তিনি রাজীবকে নিয়ে দিল্লির পথে রওনা হতে পানাগড় এয়ারবেসের দিকে চলে যান। রাজীব জানতেন না তাঁর মা অর্থাৎ ইন্দিরা গান্ধী-র হত্যার কথা। গাড়ি-তে থাকা বিবিসি রেডিও থেকে রাজীব জানতে পারেন ইন্দিরা গান্ধী-কে গুলি করে হত্যা করেছে তাঁর দুই দেহরক্ষী।
আরও পড়ুন-৭৫ তম জন্মবার্ষিকীতে রাজীব-স্মরণে গান্ধী পরিবার, শ্রদ্ধাজ্ঞাপনে নরেন্দ্র মোদী
ইন্দিরা উত্তরযুগে রাজীবের হাতেই বর্তেছিল দেশের শাসনভার। মাত্র ৪০ বছর বয়সে দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন রাজীব। এখনও পর্যন্ত তিনি দেশের সবচেয়ে কণিষ্ট প্রধানমন্ত্রী। ১৯৮৪ সালে সাধারণ নির্বাচনেও রেকর্ড গড়ে রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস। ৫১৪টি আসনের মধ্যে ৪০৪টি আসনে জয়ী হয় কংগ্রেস। যা আজ পর্যন্ত কোনও একক রাজনৈতিক দল সাধারণ নির্বাচনে এত সংখ্যক আসন পায়নি।
রাজীব গান্ধী ছিলেন ভারতের সপ্তম প্রধানমন্ত্রী। ইন্দিরা নেহেরু ও ফিরোজ গান্ধীর জ্যৈষ্ঠ পুত্র ছিলেন তিনি। রাজনীতিতে আসার আগে রাজীব ছিলেন ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের এক পেশাদার বিমানচালক। ১৯৮৮ সালে রাজীব গান্ধী পিপলস লিবারেশন অর্গ্যানাইজেশন অফ তামিল ইলম (পিএলওটিই)-এর মতো জঙ্গি তামিল গোষ্ঠীগুলির বিরোধিতা করে মালদ্বীপের সামরিক অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দেন। ১৯৯১ সালে একটি নির্বাচনী জনসভায় এই এলটিটিই জঙ্গিদের আত্মঘাতী বিস্ফোরণ হামলায় তিনি নিহত হন। বলতে গেলে মা-এর মতোই তাঁকে নিহত হতে হয়।
জওহরলাল নেহরুর নাতি রাজীব গান্ধী প্রথমে একটি ছেলেদের বেসরকারী আবাসিক স্কুল ও পরে দুন স্কুলে পড়াশোনা করেন। উচ্চশিক্ষার জন্য তাঁকে লন্ডনে পাঠানো হয়। লন্ডনেই ১৯৬৫ সালে কেমব্রিজের ভার্সিটি রেস্তোরায় সনিয়া মাইনের সঙ্গে পরিচয় হয় রাজীবের। সনিয়া ইংরেজি নিয়ে পড়াশোনা করছিলেন এবং ভার্সিটি রেস্তোরায় একজন সহকারীনির কাজ করতেন সে সময়। ১৯৬৮ সালে রাজীব ও সনিয়া বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৭০ সালে তাদের প্রথম সন্তান রাহুল গান্ধীর জন্ম হয়। ১৯৭২ সালে তাঁদের দ্বিতীয় সন্তান প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর জন্ম হয়।
প্রথমে রাজনীতিতে উৎসাহী না হলেও, তাঁর ভাই সঞ্জয়ের মৃত্যুর পর ১৯৮০ সালে আমেঠি লোকসভা কেন্দ্র থেকে প্রথম নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করেন রাজীব। সেই উপ-নির্বাচনে তিনি প্রতিদ্বন্দী লোকদল নেতা শরদ যাদবকে ২০০,০০০ এর ও বেশি ভোটে পরাজিত করেছিলেন।
দীর্ঘ সংকটাদীর্ণ ভারত-মার্কিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতি এবং অর্থনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক সহযোগিতার দৃষ্টান্তমূলক অগ্রগতি তাঁর সময়েই হয়। তিনি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা এবং সমগোত্রীয় শিল্পে সরকারী সহায়তা বৃদ্ধির মতো সিদ্ধান্ত নেন। বৈদেশিক আমদানির পরিমাণ হ্রাস, প্রযুক্তি-নির্ভর শিল্প, বিশেষত কম্পিউটার, এয়ারলাইনস, সামরিক ও টেলিযোগাযোগ প্রভৃতি ক্ষেত্রে কর ও শুল্ক হ্রাসের মত সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
ব্যবসায়ীদের মূলধন সংগ্রহ, ব্যক্তি বিশেষের ভোগ্য পণ্য ক্রয় এবং আমদানির ওপর আমলাতান্ত্রিক বিধি-নিষেধ সৃষ্টিকারী লাইসেন্স রাজ এর হ্রাসের জন্য কিছু কঠিন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তাঁর আমলেই নেওয়া হয়। সারা ভারতব্যাপী উচ্চ-শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে তিনি ১৯৮৬ সালে জাতীয় শিক্ষা নীতি ঘোষণা করেছিলেন।
তাঁরই প্রচেষ্টায় ১৯৮৬ সালে এমটিএনএল -এর সৃষ্টি হয় এবং পাবলিক কল অফিস যা পিসিও নামেই বিখ্যাত, গ্রামে গ্রামে টেলিফোনের সুবিধা পৌছে দেয় মানুষের কাছে।
রাজীব গান্ধীর অনুমোদনেই জঙ্গি কার্যকলাপের রাশ টানতে পঞ্জাবে এক বিস্তীর্ণ পুলিশী ও সামরিক অভিযান চালানো হয়। ১৯৮৭ সালের ২৯শে জুলাই কলম্বোতে রাজীব গান্ধী ও শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি জে আর জয়াবর্ধনের মধ্যে ইন্দো-শ্রীলঙ্কা শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয় এলটিটিই। এই জঙ্গি সংগঠনের প্রধান প্রভাকরণ ভারতের অবস্থাচনের তীব্র বিরোধিতা করে এবং রাজীব গান্ধী-র বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারিও দেয়।
১৯৮৯ সালের ২ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে পরাজয়ের পর প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন রাজীব গান্ধী। সে বছর বিজেপি ও বামেদের সমর্থন নিয়ে সরকার গড়ে জনতা দল নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট। যার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং। কিন্তু, দলীয় স্বার্থ ও রাজনৈতিক নেতাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষায় পরিচালিত সেই সরকারের আয়ু বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। যার জেরে ১৯৯১ সালে ফের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৯১ সালের ২১শে মে রাজীব গান্ধী তামিলনাডুর, মাদ্রাজ থেকে ৩০ মাইল দুরে শ্রীপেরুম্বুদুরে লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থীর হয়ে রাতে জনসভা করছিলেন। সে সময় এক আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন রাজীব গান্ধী। এই হত্যাকান্ডের পিছনে ছিল লিবারেশন টাইগার্স অফ তামিল ইলম বা এলটিটিই। জানা যায় বিস্ফোরণে ব্যবহৃত হয়েছিল ৭০০ গ্রাম ওজনের আরডিএক্স।
একজন স্থানীয় চিত্রগ্রাহকের ক্যামেরায় আত্মঘাতী বিস্ফোরণের পুরো ছবি ধরা ছিল। বিস্ফোরণে ক্যামেরাম্যান প্রাণ হারালেও তাঁর ক্যামেরাটি ছিল অক্ষত। শ্রীপেরুম্বুদুরে রাজীব গান্ধী স্মৃতি-স্তম্ভ গড়ে তোলা হয়েছে।