যেভাবে লাগাতার বিশ্বের বিভিন্ন গ্লোবাল রেটিং চার্টে ভারতের নম্বরকে কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তাকে তীব্রভাবে আক্রমণ করেছেন সঞ্জীব স্যানাল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা কমিটি রয়েছে, তার অন্যতম সদস্য সঞ্জীব স্যানাল।
গণতন্ত্রের স্বার্থ রক্ষা থেকে শুরু করে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ইস্যু- আন্তর্জাতিক স্তরে এই প্রসঙ্গে ভারতের রেটিং-কে বারবার অনেক কম দেখানো হয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইনডেক্সে। স্বাভাবিকভাবেই এই নিয়ে দেশে যেমন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি মোদী সরকারকে তীব্র আক্রমণ করেছে, তেমনি আন্তর্জাতিক স্তরেও মোদী সরকারের উদ্যোগ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। সঞ্জীব স্যানাল যিনি প্রধানমন্ত্রী মোদীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা কমিটির অন্যতম সদস্য তিনি এক টুইট বার্তায় লিখেছেন, 'পশ্চিমি দুনিয়ার থিঙ্ক-ট্যাঙ্কদের কল্পনার উপরে তৈরি বিচার বিবেচনাকে চ্যালেঞ্জ করার সময় এসে গিয়েছে'।
প্রধানমন্ত্রী মোদীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা কমিটি বা ইকোনমিক অ্যাডভাইসারি কাউন্সিলের ডেপুটি ডিরেক্টর আকাঙ্খা আরোরার সঙ্গে সঞ্জীব মিলিতভাবে একটি গবেষণা এবং অনুসন্ধানমূলক পেপার তৈরি করেছেন। যার মূল আধার হল যে কীভাবে আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় বিশেষ করে পশ্চিমী দেশগুলি এই ধরনের ইনডেক্স তৈরি করে এবং এতে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা কীভাবে এক একটি দেশের রেটিং-কে নির্ধারণ করেন।
সঞ্জীব লিখেছেন, 'যেভাবে এই রেটিংকে পশ্চিমী দুনিয়া নির্ধারণ করছে তা আসলে নিও-কলোনিয়ালিজমের ফল। আর এটাকে চ্যালেঞ্জ করার সময় এসেছে।'সঞ্জীব এই প্রসঙ্গে আরও উল্লেখ করেছেন যে, 'মতামত ধর্মী এই ধরনের রেটিং নিয়েই তৈরি হচ্ছে বিশ্ব ব্যাঙ্কের ওয়ার্ল্ড গভর্নেন্স ইন্ডিকেটরস বা ডবলুজিআই। যেখানে স্বাধীনভাবে রেটিং দেওয়ার ক্ষমতা মাত্র ১৮ থেকে ২০ শতাংশ।'
সঞ্জীবদের এই অনুসন্ধানমূলক পেপার-এ দাবি করা হয়েছে যে এমন তিনটি ইনডেক্স রয়েছে যা পুরোপুরি কল্পনা এবং ব্যক্তিগত বোধ-বুদ্ধির উপরে তৈরি করা হচ্ছে। আর এই খান থেকে তথ্য নিচ্ছে ডবলুজিআই। যে তথ্য আবার সরকারিভাবে প্রদর্শিত হচ্ছে ফ্রিডম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড ইনডেক্স, ইকনোমিক ইনটেলিজেন্স ইউনিট(ইআইইউ) ডেমোক্র্যাসি ইনডেক্স এবং ভি-ডিইএম-এ।
সঞ্জীব এবং আকাঙ্খা যে পেপার তৈরি করেছেন তার নাম, 'হোয়াই ইন্ডিয়া ডাজ পুওরলি অন গ্লোবাল পারসেপশন ইনডাইসেস', যার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়- 'কেন বিশ্বের অনুমানভিত্তিক ইনডেক্সে ভারতের নম্বর কম?' এখানে যে মূল বিষয়গুলিকে তুলে ধরা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হল যে এই সমস্ত ইনডেক্সের তথ্য ও পরিসংখ্যান নেওয়া হয়েছে কিছু বিশেষজ্ঞের অনুমানভিত্তিক বিশ্লেষণ এবং মতামতকে আশ্রয় করে।
পেপারে উল্লেখ করা হয়েছে, 'এই সব ইনডেক্সে বিশেষজ্ঞরা কীভাবে রেটিং নেওয়া হচ্ছে তা নিয়ে কোনও স্বচ্ছতা রক্ষা করা হয় না। এমনকী তাদের নাম পরিচয় থেকে শুরু করে দেশ এবং দক্ষতার বিষয়েও কোনও তথ্য দেওয়া হয় না। একমাত্র ভি-ডিইএম- এই ধরনের কোনও বিষয় অনুসরণ করে না। তারা তাদের রেটিং-এ বিশেজ্ঞদের বিষয়ে তথ্য সরবরাহ করে থাকে। কিন্তু, এমনটা অন্যদের ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয় না। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে ফ্রিডম হাউস যে রিপোর্ট দিয়েছে তাতে বলা হয়েছে, এমন একটি দলকে দিয়ে এই রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে, যাদের মধ্যে সংস্থার কর্মী থেকে শুরু করে পরিংসখ্যান বিশ্লেষণকারী, কনসান্ট্যান্ট, বহিরাগত অ্যানালিস্ট এবং বিশেষজ্ঞরা উপদেষ্টা হিসাবে রয়েছেন। এরা হয় কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অথবা থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক অথবা মনবাধিকার সংগঠনের সদস্য। কিন্তু এখানেও বিশেষজ্ঞ বা রিপোর্ট তৈরিকারী কারও দেশ অথবা পুরো পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি।'
কীভাবে কিছু নির্দিষ্ট প্রশ্নের ভিত্তিতে এই ইনডেক্স তৈরি হতে পারে তাকে একহাত নিয়েছেন সঞ্জীব এবং আকাঙ্খা। তাঁরা তাদের তৈরি অনুসন্ধানমূলক এই পেপারে দেখিয়েছেন, এই সব প্রশ্নের অধিকাংশটাই অত্যন্ত বিষয় ভিত্তিক এবং অতি জেনেরিক বা কমন প্রশ্ন। এই ধরনের জেনেরিক বা সাবজেক্টিভ প্রশ্নের কোনও নির্দিষ্ট উত্তর হয় না। ফলে বিশেজ্ঞরা এতে কোনও স্পেসিফিক বিষয়কে তুলে ধরেন না। এক একজন তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গ দিয়ে এই ধরনের প্রশ্নের উত্তরকে ব্য়াখ্যা করেন। একই প্রশ্ন সব দেশের জন্য দিয়ে দিলে হয় না, কারণ এক একটি দেশের ক্ষেত্রে প্রশ্ন ভিন্ন হওয়া উচিত। কারণ প্রশ্ন তৈরি সময় একটি দেশের পরিস্থিতি-র সাযুজ্য থাকাটাও জরুরি। যে প্রশ্ন একটি দেশের ক্ষেত্রে যথার্থ হতে পারে, তা অন্য,সু দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নাও হতে পারে। সব দেশের জন্য একই প্রশ্নের জেরে স্কোর প্রভাবিত হতে পারে। এই প্রসঙ্গে সঞ্জীবরা একটি স্পেসিমেন প্রশ্নও খাড়া করেছেন, যেখানে বলা হয়েছে, যদি কোন দেশের ক্ষেত্রে এই প্রশ্নটা রাখা হয় যে সংবিধানের সর্বোচ্চ প্রধান কি গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত হন? এই ধরনের প্রশ্ন ব্রিটেন, ডেনমার্ক,সুইডেন, নরওয়ে, বেলজিয়ামের ক্ষেত্রে সমস্যাজনক। কারণ এই সব দেশের ক্ষেত্রে সংবিধানের সর্বোচ্চ পদের প্রধান রাজ পরিবার থেকে আসেন। সঞ্জীব এবং আকাঙ্খার মতে, একটি দেশে গণতন্ত্র কতটা কার্যকর সেই দিক থেকে দেখলে এই ধরনের প্রশ্ন ওই সব দেশের পক্ষে নম্বর কমিয়ে দেবে।
ফ্রিডম হাউসের বার্ষিক রিপোর্টে বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছিলেন যে, তারা কিছু বাজার গরম ইস্যুর উপরে নজর দিয়েছিলেন এবং এক্ষেত্রে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হতে কিছু মিডিয়া রিপোর্টকে হাতিয়ার করেছিলেন। সঞ্জীবদের অনুসন্ধানমূলক এই রিপোর্টে এই বিষয়গুলিও উল্লেখ করা হয়েছে।
সঞ্জীব এবং আকাঙ্খা তাদের পেপারে আরও উল্লেখ করেছেন যে, অনুমান ভিত্তিক এই ধরনের ইনডেক্সগুলি তৈরিতে যে মেথডোলজি অথবা পদ্ধতিগত বিষয় অনুসরণে সমস্যা আছে তা স্পষ্ট। এমনকী একটি দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো কতটা মজবুত তা বিচার করতে এমন এমন প্রশ্নের অবতারণা করা হয়েছে, তাতে বলতে হয় যে এই প্রশ্নগুলো দেশে ভেদে সঠিক নয়, আর ইনডেক্স তৈরির ক্ষেত্রেও তা ভুল।
কিন্তু কী করলে এই ধরনের অনুমানভিত্তিক ও ভ্রান্ত ধারনায় তৈরি করা ইনডেক্সকে মোকাবিলা করা যেতে পারে? এমন প্রশ্নের উত্তরে সঞ্জীব এবং আকঙ্খা তাদের তৈরি করা পেপারে পরিষ্কার জানিয়েছেন, বিশ্ব ব্যাঙ্কের কাছে এই রিপোর্ট এবং ইনডেক্সের বৈধতা ও স্বচ্ছতার প্রমাণ চাওয়া উচিত ভারত সরকারের। একই সঙ্গে দিনের পর দিন যেভাবে পশ্চিমী দুনিয়ার কিছু প্রভাবশালী সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান এইসব ইনডেক্স তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে তাকে চ্যালেঞ্জ করার এবং এই চক্রকে ভেঙে দেওয়াটা প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর জন্য ভারতীয় থিঙ্ক ট্যাঙ্কারদের আরও বেশি করে সক্রিয় হতে হবে এবং একই রকমভাবে এই সব পশ্চিমী দেশের সম্পর্কেও অনুমান ভিত্তিক ইনডেক্স তৈরি হওয়া উচিত বলেও মতামত পোষণ করেছেন সঞ্জীব এবং আকাঙ্খা।