দুই কোটি ত্রিশ লক্ষ লোকের দেশ তাইওয়ান। বহির্বিশ্বের সাধারণ মানুষেরা জানে তাইওয়ান এক আলাদা দেশ। অথচ প্রশ্নটা বিশ্ব রাজনীতির এক জটিল অংশ। তাইওয়ান কি চীনের অংশ ? নাকি চীন থেকে আলাদা? এ নিয়ে সংশয় আছে অনেকের মধ্যে। এমনকি তাইওয়ানকে কি নামে ডাকা হবে তা নিয়েও। গত বছর নভেম্বরে দীর্ঘ ছয় দশ পর প্রথমবার চীন আর তাইওয়ানের নেতারা দীর্ঘ ছয় দশক পর এই প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বসার পর এই সব প্রশ্ন আবার সামনে এসেছে। খুব সহজ ভাবে বললে, চীন মনে করে তাইওয়ান তাদের দেশেরই অংশ। এটি চিন থেকে বেরিয়ে যাওয়া একটি প্রদেশ। যেটি ভবিষ্যতে কোন একদিন চিনের সঙ্গে যুক্ত হবে।
তাইওয়ান নিজেকে কিভাবে দেখে সেটার উত্তর অবশ্য এতটা সরল নয়। দীর্ঘ ছয় দশক ধরে চীনের ছত্রছায়া থেকে বেরিয়ে আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রগঠনের আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে তাইওয়ান। কিন্তু দেশটিকে নিজেদের অধিকারের বাইরে ভাবতে নারাজ বেজিং।
চীনের মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন তাইওয়ান মূলত দক্ষিণ চীন সমূদ্রের একটি দ্বীপ। এক সময় এই দেশ ওলন্দাজ কলোনি ছিল। তবে ১৬৮৩ থেকে ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত চীনের রাজারাই শাসন করেছে তাইওয়ান। এরপর জাপানীরা দখল করেছে এই দ্বীপ। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাইওয়ানের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেয়া হয় চিয়াং কাইশেকের নেতৃত্বাধীন চিনা সরকারের হাতে। কিন্তু চিনে মাও জেদং এর নেতৃত্বে কমিউনিষ্ট বাহিনির সঙ্গে যুদ্ধে হারতে থাকে চিয়াং কাইশেকের সরকার। চিনের বেশিরভাগ অংশের নিয়ন্ত্রণ হারায় তারা। এরপর চিয়াং কাইশেক আর তার কুওমিনটাং সরকারের লোকজন তখন পালিয়ে যায় তাইওয়ানে। সেখানে তারা ‘রিপাবলিক অব চায়না’ নামে এক সরকার গঠন করে। নিজেদেরকে সমগ্র চিনের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার বলেও দাবি করে তারা। কোন একদিন কমিউনিষ্টদের কাছ থেকে আবার পুরো চীনের নিয়ন্ত্রণ তারা নেবে, এমনটাই ছিল তাদের পরিকল্পনা।
বহুদিন পর্যন্ত বিশ্বের অনেক দেশ চিয়াং কাইশেকের সরকারকেই চিনের সত্যিকারের সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এমনকি, ১৯৭১ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তাইওয়ানের সরকারই চিনের প্রতিনিধিত্ব করেছে।
কিন্তু ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রসংঘ বেইজিং এর সরকারকেই চীনের আসল সরকার বলে স্বীকৃতি দিল। তারপর থেকে একে একে বিশ্বের প্রায় সব দেশই বেইজিং এর পক্ষ নিল, এবং তাইওয়ানের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি কমতে থাকলো। ১৯৮০র দশক পর্যন্ত চিন আর তাইওয়ানের মধ্যে চলেছে তীব্র বাকযুদ্ধ। কিন্তু এরপর সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে শুরু করে। ‘এক দেশ, দুই পদ্ধতি’ নামে চিন এক প্রস্তাব দেয়। যেখানে তাইওয়ান মূল চিনে অন্তর্ভুক্ত হবে, তবে তাদের স্বায়ত্বশাসন দেওয়া হবে। কিন্তু তাইওয়ান সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। অবশ্য এর মধ্যেও দুই পক্ষের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ থাকেনি।
২০০০ সালে তাইওয়ানের নুতন প্রেসিডেন্ট হন চেন শুই বিয়ান। ২০০৪ সালে তিনি ঘোষণা করেন যে তাইওয়ান চিন থেকে আলাদা হয়ে সম্পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চায়। তার এই অবস্থান চিনকে ভীষণ রুষ্ট করে। ২০০৫ সালে চিন তড়িঘড়ি করে এক আইন পাশ করে। যাতে বলা হয়, তাইওয়ান যদি চিন থেকে আলাদা হওয়ার চেষ্টা করে, সেটা ঠেকাতে চিন প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করবে।
চীনা মূল ভূখণ্ড থেকে স্বাধীন হলে তাইওয়ানের জন্য সেই স্বাধীনতা মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে সতর্ক কেরছেন চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। নতুন করে চিনের ছায়া থেকে বেরিয়ে স্বাধীন তাইওয়ান কখনো 'সহ্য করা হবে না’ বলে জানিয়েছেন বেজিং সরকারের এক মুখপাত্রও। সাই ইং ওয়েন দ্বিতীয়বারের জন্য তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিতেই চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে এমন হুঁশিয়ারি এসেছে।
তাইওয়ানকে স্বশাসিত অঞ্চল হিসেবে মর্যাদা দিলেও স্বাধীনতার প্রশ্নে চিনের অবস্থান ইস্পাত কঠিন। বরং তাইওয়ানকে গ্রাস করার চেষ্টার কমতি নেই চিনা সরকারের। স্বাধীনতাকামীদের নিয়ন্ত্রণে সামরিক পদক্ষেপ নিতেও পিছ পা হয় না তারা। চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, তাইওয়ানকে অবশ্যই চীনের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে মিশে যেতে হবে। তাইওয়ানের উপর চিনের দাদাগিরির বিষয়টি অবশ্য চোখ এড়ায়নি আমেরিকার। করোনা নিয়ে প্রতিদিনই প্রায় চিনকে দুষছনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর মধ্যেই চিনকে শায়েস্ত করতে তাইওয়ান প্রণানীতে যুদ্ধ জাহাজও পাঠিয়ে রেখেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে বেজিংয়ের সীমান্ত উত্তেজনা যখন বাড়ছে তখন তাইওয়ানের ওপর দাদাগিরি দেখানোতেও কসুর করেনি চিন। দিন কয়েক আগেই তাইওয়ানের আকাশ সীমা টপকে ঢুকে পড়ল চিনের যুদ্ধ বিমান। যদিও তাতে বিশেষ লাভ হয়নি। কারণ তাইওয়ানের বায়ুসেনার বিমান চিনের ওই যুদ্ধবিমানকে এলাকা ছাড়া হতে বাধ্য করে। এই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক ভাবেই তাই মিডিয়ায় সমর্থন পাচ্ছে ভারত। তাইওয়ান নিউজ-এর ওয়েবসাইটে সম্প্রতি একটি ছবি প্রকাশিত হয়েছে। সেই ছবি ইতিমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড়ের গতিতে ভাইরাল হয়েছে।
তাইওয়ান নিউজে প্রকাশিত ওই ছবিতে ভগবান রামকে ড্রাগন বধ করছে দেখা যাচ্ছে। ওই ছবি অশুভের বিরুদ্ধে শুভর জয়ের প্রতিক হিসেবে দেখাতে চেয়েছে তাইওয়ান মিডিয়া। চিনের ডাক নাম ড্রাগন এটা সবাই জানে। আর গত ১৫ জুন লাদাখ সীমান্তে হওয়া ভারত চিন উত্তেজনার পরই তাইওয়ান এই ছবি প্রকাশ করেছে। তাইওয়ানের মতে অশুভ চীনের বিরুদ্ধে বড় জয় পেয়েছে ভারত। আর সেই জন্য তাঁরা এই ছবি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করেছে।