বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য নিয়োগকে কেন্দ্র করেও রাজ্যপালের সঙ্গে বিরোধ রাজ্য সরকারের
মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় বলছেন রাজ্যপালের পদটা আলঙ্কারিক
একই রকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল ১৯৮৩ সালে জ্যোতি বসুর আমলেও
সেদিন যুব কংগ্রেস নেত্রী মমতা রাজ্যপালের পক্ষেই ছিলেন
গত সোম-মঙ্গলবার অদ্ভূত এক নাটক হয়ে গেল বাংলার শিক্ষা মহলে। বিষয়টা ছিল বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য নিয়োগ। সেই ক্ষেত্রেও রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে সংঘাত বেধেছে রাজ্যপালের। মঙ্গলবার এক সাংবাদিক সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন 'রাজ্যপালের পদটা আলঙ্কারিক'। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এর আগে অনেকবারই এই কথা বলেছেন। অদ্ভূত বিষয় হল একই কথা শোনা গিয়েছিল বাংলার প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর গলাতেও, ১৯৮৩ সালে। সেদিন কিন্তু যুব কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যপালের পক্ষেই ছিলেন।
গত সোমবার পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য পদে নিয়োগ করেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রাণীবিদ্যার অধ্যাপক গৌতম চন্দকে। রাজ্যসরকারের পক্ষ থেকে সহ-উপাচার্য হিসাবে যে তিনজন শিক্ষাবিদের নাম পাঠানো হয়েছিল, তারমধ্যে অধ্যাপত গৌতম চন্দের নাম ছিল না। এরপর মঙ্গলবার শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় 'বিজেপি-র লোককে মাথায় বসাচ্ছেন', বলে, অধ্যাপক আশিস পাণিগ্রাহীকে সহ-উপাচার্য নিয়োগ করেছেন। তিনি মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দায়িত্বও গ্রহণ করেছেন। কিন্তু এই নিয়ে বিতর্ক এখনও অব্যাহত।
প্রায় একইরকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল ১৯৮৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার আগের চার বছর এই পদে ছিলেন অধ্যাপক রমেন কুমার পোদ্দার। বিশ্ববিদ্য়ালয়ের নিয়ম অনুযায়ী সেনেট কমিটিতে উপাচার্য বাছাই-এর জন্য নির্বাচন হয়। সেই ভোটাভুটিতে রমেন পোদ্দারের থেকে ৫টি ভোট বেশি পেয়েছিলেন আরেক প্রার্থী অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য। তবে সহ-উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে এই ভোটাভুটির খুব একটা গুরুত্ব নেই। শুধুমাত্র এই ভোটাভুটি অনুযায়ী তালিকা তৈরি করে তিনজনের নাম প্রস্তাব করা হয় রাজ্য সরকারের কাছে।
দুজনেই বাম ঘনিষ্ঠ হলেও রমেন পোদ্দারই ছিলেন জ্যোতি বসু সরকারের পছন্দের প্রার্থী। তাঁকেই পুনর্নিযুক্ত করতে চেয়েছিল বাম সরকার। অনেকে বলেন, সন্তোষ ভট্টাচার্য সরকারের ইয়েসম্যান হতে চাননি। তার উপর রাজ্য সরকারের অনেক নীতিরই খোলামেলা সমালোচনা করতেন। রাজ্যপাল অনন্ত প্রসাদ শর্মা বা এপি শর্মার কাছে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী শম্ভু ঘোষ যে তালিকা পাঠিয়েছিলেন তাতে প্রথম নামটি ছিল রমেন পোদ্দার। তারপর ছিল সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়-এর নাম। আর তিন নম্বরে ছিল সন্তোষ ভট্টাচার্যের নাম।
রাজ্যপাল পদাধিকার বলে রাজ্য সরকারি সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। তিনিই সহ-উপাচার্য নিয়োগে শেষ কথা বলেন। কিন্তু, ওই জ্যোতি বসু যেমন বলেছিলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজ যেমন বলছেন, আলঙ্কারিক। রাজ্য সরকার যে নাম প্রস্তাব করবে, তাতেই ঘাড় নাড়বেন তিনি, এমনটাই হওয়ার কথা। কিন্তু বর্তমান রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের মতোই, তৎকালীন রাজ্যপাল আদ্যন্ত কংগ্রেসি এপি শর্মাও তা করেননি। তিনি বেছে নিয়েছিলেন সেনেটে বেশি ভোট পাওয়া সন্তোষ ভট্টাচার্যকেই।
বস্তুত, বিভিন্ন বিষয়েই তাঁর সঙ্গে জ্যোতি বসুর নেতৃত্বাধীন বাম সরকারের বিরোধ ছিল। বিভিন্ন বিষয়েই এপি শর্মা অতিসক্রিয়তা এবং পার্টিজান মনোবৃত্তি প্রকাশ করে ফেলতেন। শোনা যায় ইন্দিরা গান্ধী মন্ত্রিসভায় যোগাযোগ, সড়ক পরিবহন, অসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রকের মতো একাধিক মন্ত্রকের দায়িত্ব সামলানোর পর রাজনীতি ছেড়ে রাজ্যপাল হয়ে যাওয়াটা তাঁর পছন্দ ছিল না। এমনকী পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হওয়ার পর সরকারের পয়সায় বিহারে গিয়ে তিনি কংগ্রেসের হয়ে প্রচারও করেছিলেন।
সেই সময় যুব কংগ্রেস নেত্রী ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সময় কিন্তু রাজ্যপালের অতি সক্রিয়তা নিয়ে সরব হয়নি রাজ্য কংগ্রেস। মমতা বন্দোপাধ্যায়, অজিত পাঁজাদের মতো কংগ্রেস নেতা-নেত্রীরা এপি শর্মার সিদ্ধান্তকেই সমর্থন করেছিলেন। তাঁর সাংবিধানিক ক্ষমতার দোহাই দিয়েছিলেন। এখন রাজ্য বিজেপি-র নেতারা যেমন বলছেন। এপি শর্মার সমর্থনে সভা-সমিতি-মিছিলও হয়েছিল কলকাতায়। বর্তমানে অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চোখে রাজ্যপালের পদটিকে আলঙ্কারিক মনে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর আঘাত মনে হচ্ছে।
তবে তৃণমূল কংগ্রেস যেমন রাজ্যপালের নিয়োগকে পাত্তা না দিয়ে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকেই বর্ধমান বিশ্ববিদ্য়ালয়ের মাথায় বসিয়েছে, রাজ্যপালের সঙ্গে ততটা সংঘাতের রাস্তায় যায়নি তখনকার বাম সরকার। সন্তোষ ভট্টাচার্ষই পরের চার বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। তবে তাঁর কাজে প্রতিপদে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছিল।
আর রাজ্যপালের ভূমিকা নিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন জ্যোতি বসু। ১৯৮৪ সালের ১৫ অগাস্ট স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের পরই আচমকা জ্যোতি বসুকে নিজের পদত্যাগের খবর দিয়েছিলেন এপি শর্মা। তারপর আবার ফিরে যান রাজনীতিতে। বিহার থেকে কংগ্রেস মনোনীত রাজ্যসভার সাংসদ হয়েছিলেন।
তাই, শিক্ষাঙ্গনকে কেন্দ্র করে রাজ্যপালের বিরুদ্ধে রাজনীতি করার অভিযোগ বাংলায় এই প্রথম উঠছে না। ইতিহাসেরেই পুনরাবৃত্তি হচ্ছে শুধু অবস্থান বদলেছেন মমতা বন্দোপাধ্যায়।