একদা দেশের শাসক ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বর্তমান মালিক ভারতীয় ব্যবসায়ী

  • শুরুতে নাম ছিল ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি
  • এসেছিল এ দেশে ব্যবসা করতে
  • সেই ব্যবসায়ীরাই হয়ে গেল দেশের শাসক
  • সামান্য টাকার বিনিময়ে ইস্ট কোম্পানির পেটেন্ট কিনে নেন

Tapan Malik | Published : Sep 29, 2020 7:32 AM IST

কথায় বলে ছুঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরনো।এসেছিল এ দেশে ব্যবসা করতে; একদিন সেই ব্যবসায়ীরাই হয়ে গেল দেশের শাসক। হ্যাঁ ব্রিটেনের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কথাই বলা হচ্ছে। শুরুতে নাম ছিল ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। পরবর্তীতে  নাম বদলে  হয় অনারেবল কোম্পানি অব মার্চেন্টস অব লন্ডন ট্রেডিং ইনটু দ্য ইস্ট ইন্ডিজ। তবে এই উপমহাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামেই বেশি পরিচিত ছিল। এক সময় ভারতীয় উপমহাদেশের খ্যাতি ছিল মশলা, কাপড় এবং দামি রত্নের জন্য। সেই সময়ে স্পেন এবং পর্তুগাল এই উপমহাদেশ থেকে মশলা ও কাপড় নিয়ে পূর্বের দূরবর্তী দেশগুলিতে বিক্রি করত। লোভী ব্রিটিশ বণিকরাও  এ দেশে আসার জন্য মরিয়া হয়ে ছিলেন। কিন্তু নৌবাহিনী না থাকার দরুণ ব্রিটিশরা এখানে আসতে পারে না।

শেষমেষ ব্রিটিশরাও রাস্তা বের করে ফেলে।  স্প্যানিশদের পর্যুদস্ত করে তাদের নৌবহরের দখল নিয়ে নেয় ব্রিটিশরা। সেই নৌবহরই ব্রিটিশদের ভারতে আসার পথ সুগম করে দেয় সেই সঙ্গে তাদের নৌশক্তিও বহুগুণে বেড়ে যায়। ভারতে আসার পথের বাধা কেটে যেতেই ১৬০০ সালে স্যার থমাস স্মাইথের নেতৃত্বে লন্ডনের একদল বণিক ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে। তাঁরা পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যবসা করার জন্য রাণি প্রথম এলিজাবেথের কাছে সম্মতি ও রাজসনদ পাওয়ার অনুরোধ করে। রাণি সম্মতি দিলে ৭০ হাজার পাউন্ড পুঁজি নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যাত্রা শুরু করে। মোগল আমলেও ইস্ট ইন্ডিয়া ছিল শুধুমাত্র একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু মোগল সম্রাটদের প্রতিপত্তি ক্রমেই যখন দুর্বল হটে শুরু করে  ব্রিটিশ বানিজ্য কোম্পানি ধীরে ধীরে ভারতের রাজনীতিতে প্রভাব খাটানো শুরু করে দেয়। ব্রিটেনের রাণি এলিজাবেথও  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে তাদের যেকোনও প্রয়োজনীয় সামরিক সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। একদিকে মোগল সাম্রাজ্যের দাপট যেমন কমছিল, পাশাপাশি দিল্লি থেকে বহু দূরের রাজ্যগুলোতে কেন্দ্রের শাসনও দুর্বল হয়ে পড়ছিল। এই সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে ব্রিটিশ বণিক কোম্পানি ইস্ট ইন্ডিয়া ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের ব্যবসা এবং রাজনৈতিক প্রভাব জোরদার করে ফেলে। 

শুধু ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নয় এই উপমহাদেশে উপস্থিতি বাড়াতে শুরু করে ইউরোপের অন্য কয়েকটি দেশ। বিশেষ করে ব্রিটেনের জাতীয় শত্রু ফ্রান্সের ব্যবসায়ীদের উপস্থিতি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ভাবিয়ে তোলে। এরপরই তারা ভারতের রাজনীতি দখলের পরিকল্পনা ছকতে শুরু করে। ভারতের উপকূলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অবস্থান ছিল যথেস্ট শক্তপোক্ত। গোড়া থেকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এক দক্ষ সেনাবাহিনী গড়ে তোলে। এছাড়া যেকোনও প্রয়োজনে তাদের ডাকে ব্রিটিশ নৌবাহিনী সাড়া দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। সামরিক দিক দিয়ে এগিয়ে থাকার কারণে এদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তথা ব্রিটিশরা ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ এবং ১৭৬৪ সালের বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভ করে। শুধু তাই নয় এরপর কোম্পানি বাংলার কর সংগ্রহের ক্ষমতা হাতে পেয়ে যায়। এ দেশের রাজনীতি দখল করতে গেলে বাংলার যে  গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে তারা সে কথা বুঝে ফেলেছিল।  তবে গোটা ভারতে প্রভাব তৈরির জন্য বাংলাই  যথেষ্ট নয়।

সে কারণে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথমে দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে শুরু করে। তারপর পশ্চিম ভারতের মারাঠা এবং মহীশূরের রাজা টিপু সুলতানকে যুদ্ধে হারিয়ে তারা সারা ভারতই কার্যত তাদের কব্জায় এনে ফেলে৷ ইতিমধ্যে মুঘল সম্রাটরা পুতুল শাসকে পরিণত হয়েছে।  ১৮১৮ সালের হিসেব অনুসারে ভারতের দুই-তৃতীয়াংশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দখলে ছিল। যদিও ১৮১৩ সাল থেকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাঠামোর ভেঙে পড়া শুরু হয়। এরপর ১৮৭৪ সাল নাগাদ ওই কোম্পানি পুরোপুরি বিলীন হয়ে যায়।  জানা গিয়েছে এরও  প্রায় ১৩৫ বছর পর ২০১০ সালের আগস্ট মাসে ফের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সচল হয়েছে।  তবে আগের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে এই কোম্পানির নাম ছাড়া আর কোনও মিল নেই। জানা গিয়েছে ৪৮ বছর বয়সী ভারতীয় ব্যবসায়ী সঞ্জীব মেহতা ২০০৫ সালে খুব সামান্য টাকার বিনিময়ে ইস্ট কোম্পানির পেটেন্ট কিনে নেন। সঞ্জীব কোম্পানিকে বিলাসবহুল চা, কফি ও খাবারের ব্র্যান্ড হিসেবে রূপান্তর করেন। ২০১০ সালে সঞ্জীব লন্ডনে প্রথম দোকানও শুরু করেন। তিনি বলেছেন, একসময় ভারত শাসন করতো এই কোম্পানি এখন সেই কোম্পানির মালিক একজন ভারতীয়, এটা রাজত্ব ফিরে পাওয়ার অনুভূতি। একসময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আগ্রাসনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল, এখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চলে সহমর্মিতার ভিত্তিতে।

Share this article
click me!