প্রতিটি গল্পের আবহে খুঁটিনাটি বিষয়বস্তু, অপরাধীর অপরাধপ্রবণ মনের প্রেক্ষিতে ঘটানো পারিপার্শ্বিক কাজকর্ম এবং গোয়েন্দার যুক্তির সাহায্য অপরাধীকে চিহ্নিত করায় লেখিকার লেখনী এতটাই আকর্ষক যে, প্রায় প্রতিটি গল্পই শেষ করার পর পাঠক ভাবতে বাধ্য হন— গল্পটি আরেকটু বড়ো হল না কেন? আহা!
গোয়েন্দা কাহিনি কি আদপেও সাহিত্য পদবাচ্য? এ প্রশ্ন আজ অপ্রাসঙ্গিক, কারণ বহুদিন আগেই মীমাংসা করে দিয়েছেন স্বয়ং সুকুমার সেন। সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি অলিন্দে স্বচ্ছন্দে বিচরণকারী লেখিকা ঋতুপর্ণা রুদ্রের একটি বই হাতে পেয়ে মনে পড়ে গেল শরদিন্দুবাবুর একটি উক্তি; তাঁর মতে— গোয়েন্দা গল্প যদি সাহিত্য পদবাচ্য না-ও হয়, তবু যা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, তা লিখতে আমারও লজ্জাবোধ নেই। মনে পড়ে গেল আরেকটি কথা। শরদিন্দুবাবু যখন খ্যাতির মধ্যগগনে তরুণ সমরেশ বসু অত্যন্ত কুণ্ঠার সঙ্গে ব্যোমকেশ স্রষ্টাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন— গোয়েন্দা গল্প লিখলে কি হাত খারাপ হয়ে যায়? শরদিন্দুবাবু না-কি অট্টহাস্য করে বলেছিলেন— যার লেখার হাত খারাপ, সে গোয়েন্দা গল্প না-লিখলেও তার হাতে ভালো লেখা আসে না, আর যার হাত ভালো সে হাজার চেষ্টা করেও হাত খারাপ করতে পারে না।
মাত্র কয়েক বছর আগে অপরাধ জগতে যুক্ত হয়েছে এক নতুন গোয়েন্দার নাম। গোয়েন্দার নাম প্রণব গড়াই। মাস আটেক আগে আমি হাতে পাই “গোয়েন্দা গড়াই” বইটি। আমাদের পড়া বাংলা সাহিত্যের অধিকাংশ প্রথিতযশা গোয়েন্দাদের প্রায় প্রত্যেকেই শখের গোয়েন্দা। প্রয়োজনে তাঁরা কখনো সাহায্য নেন পুলিশের। সাহিত্যগুণে তাঁরা আমাদের যতই প্রিয় হন বাস্তবটা কিন্তু আদতে সম্পূর্ণই আলাদা। দুঃখজনক হলেও বাস্তবে শখের গোয়েন্দাদের অস্তিত্ব বড়োই ম্রিয়মান। তাঁদের কাছে মক্কেলরা যান বড়ো জোর বিবাহের পূর্বে পাত্র-পাত্রীর খোঁজ নেওয়ার মতো খুচরো কাজের জন্য। কোনও কোনও ক্ষেত্রে পুলিশ তদন্তের স্বার্থে কোনো বিশেষ বিষয়ে আংশিক তথ্য সংগ্রহ বা অনান্য গৌণ কিছু অংশ তাঁদের ওপর ছাড়লেও খুন-জখম-চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই-রাহাজানি-অপরহণ-জোচ্চুরি-জালিয়াতিতে রহস্য উদ্বঘাটনের প্রথমিক এবং প্রধান দায়িত্ব বর্তায় পুলিশেরই ওপর। খারাপ লাগলেও এটাই বাস্তব এবং সত্য— শখের গোয়েন্দারা অপরাধজগতে অবাঞ্চিত এবং রবাহূত।
এ-কথাটি যেমন বাস্তবসম্মত, ঠিক তেমনই বাস্তবসম্মত তিনটি চরিত্র হল— পুলিশ অফিসার প্রণব গড়াই, ইন্সপেক্টর কবীর সান্যাল এবং সাব ইন্সপেক্টর কল্পনা চৌধুরী। এঁদের নিয়ে দশটি গল্প একত্রে স্থান পেয়েছে “গোয়েন্দা গড়াই” বইটিতে।
প্রথম দুটি গল্প শেষ করে শুরু করেছিলাম তৃতীয় গল্প ‘তবু অনন্ত জাগে’। চমকে উঠলাম তৃতীয় গল্পটির পরিণতিতে। পরিচিত হলাম প্রণব গড়াইয়ের মানবিকতার সঙ্গে। মনে পড়ে গেল ব্যোমকেশও মাফ করে দিয়েছিলেন খুনিকে, কেবলমাত্র মানবিকতার খাতিরেই।
আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম, প্রাথমিকভাবে অত্যন্ত নিষ্পৃহভাবে পড়া শুরু করলেও চতুর্থ গল্পে নিজেরই অজান্তে ভালোবেসে ফেলেছি প্রণব গড়াইকে এবং তাঁর তদন্ত পদ্ধতিকে।
‘খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি’— সপ্তম গল্পটির উপস্থাপনা এককথায় অনবদ্য।
প্রতিটি গল্পের আবহে খুঁটিনাটি বিষয়বস্তু, অপরাধীর অপরাধপ্রবণ মনের প্রেক্ষিতে ঘটানো পারিপার্শ্বিক কাজকর্ম এবং গোয়েন্দার যুক্তির সাহায্য অপরাধীকে চিহ্নিত করায় লেখিকার লেখনী এতটাই আকর্ষক যে, প্রায় প্রতিটি গল্পই শেষ করার পর পাঠক ভাবতে বাধ্য হন— গল্পটি আরেকটু বড়ো হল না কেন? আহা! ছোটো গল্পের বদলে পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস পেলাম না কেন? না-হয় আরও কিছুটা বেশিই সময় কাটানো যেতো অফিসার গড়াই, ইন্সপেক্টর সান্যাল এবং এস. আই. চৌধুরীর সঙ্গে, কিই-বা ক্ষতি হতো তাতে?
আশ্চর্য দক্ষতায় লেখিকা তাঁর কলমের জোরে পাঠকদের খুবই সহজে একাত্ম করান অফিসার প্রণব গড়াইয়ের সঙ্গে। ‘অমৃত চাই না’— গল্পটির প্রথম লাইনেই পাঠক একটু নড়ে চড়ে বসবেন অফিসার গড়াইয়ের পারিবারিক জীবনের খবরের আশায়। কিন্তু মাত্র দু’লাইনেই লেখিকা পাঠকদের পৌঁছে দেন পুলিশ অফিসারটির ব্যক্তি জীবনের গল্প থেকে তাঁর কর্মজীবনে; এবং এই একটি ব্যাপারেই সম্ভবত পাঠক অনুযোগ জানাবেন লেখিকাকে।
গল্পগুলিতে রহস্যের দানা বাঁধা ওঠা এবং তার সমাধানের সঙ্গে সঙ্গে প্রণব গড়াই আমাদের প্রিয় হয়ে উঠলেও তাঁর সম্পর্কে কিন্তু তেমন কোনো ব্যক্তিগত তথ্যই পাই না আমরা কোনো গল্পে। কেবল জানতে পারি স্ত্রী এবং একমাত্র কন্যাকে নিয়ে তাঁর সংসার।
প্রণব গড়াইয়ের ব্যক্তি জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ট হওয়ার ইচ্ছা থাকা স্বত্ত্বেও পাঠক সে-অর্থে ঘনিষ্ট হতে পারে না; কেবলমাত্র ব্যক্তি প্রণব গড়াইয়ের পছন্দ-অপছন্দ ও দৈনন্দিন খুঁটিনাটির বদলে নৈর্ব্যক্তিকভাবে অপরাধ বিশ্লেষণ করে যাওয়ার জন্য।
অবশ্য এভাবেও ভাবা যায়— সম্ভবত গোয়েন্দা প্রণবের ছবিটা লেখিকা সচেতনভাবেই আবছা রেখেছেন। হয়তো তাঁর মতে চরিত্রটির স্পষ্ট ছবি না-থাকলেই বরং প্রত্যেকটি পাঠক তার নিজের মনোমতো ছবি আঁকতে পারবে।
বাস্তবতার নিরিখে সাম্প্রতিকালের কয়েকজন শখের গোয়েন্দাদের চেয়ে প্রণববাবু নিজেই এগিয়ে আছেন বেশ কয়েক কদম। কিন্তু কাহিনির বাস্তবতার চেয়েও বড়ো আকর্ষণ লেখিকার বাস্তবানুগ কলম এবং ঘটনার বিন্যাস। লেখিকার নিপুন কলম বারবার জিতিয়ে দেন প্রণববাবুকে, এগিয়ে রাখেন তাঁর সমসাময়িক গোয়েন্দাদের চেয়ে।
প্রতিটি ঘটনা এতটাই বাস্তবঘেঁসা এবং জীবন্ত যে পাঠক হয়তো কখনও কোনও গল্পে গোয়েন্দা বা রহস্যের সমাধানে ছেড়ে ঢুকে যাবে কলকাতা পুলিশ বা বেঙ্গল পুলিশের মেরিট বেসিস ট্রান্সফার, ডিউটি-রেস্পন্সিবিলিটি অথবা প্রফেশনাল বিহেভিয়ারের মধ্যে। লেখিকার বাস্তবজ্ঞান এবং প্রতিটি বিষয়ে বর্তমানের অণুপুঙখ খবর আহরণ সত্যিই তারিফযোগ্য।
ঠিক যেমন যে-কোনো ঘটনার মধ্যে যেনতেন প্রকারেণ কয়েকটা মার্ডার কিডন্যাপ অবৈধ বসম্পর্ক অথবা বিডিএসএম ঢোকানোটাই কেবলমাত্র একটি সার্থক গোয়েন্দা গল্পের সংজ্ঞা হতে পারে না, ঠিক সে-কারণেই সার্থক গোয়েন্দা গল্প হয়ে ওঠে প্রণব গড়াইয়ের গল্পগুলি।
তিনি সহিষ্ণু সহানুভূতিশীল এবং মানবিক। রহস্যভেদে তাঁর পর্যবেক্ষণ এবং যুক্তি বিন্যাসের পাশাপাশি ফুটে ওঠে দায়িত্ববান কর্তব্যনিষ্ঠ পুলিশ অফিসারের দরদি মনের ছাপ। আমরা জানতে পারি ইনফর্মারের থেকে খবর জোগাড় করেই তিনি হাত ধুয়ে ফেলন না, পাশাপাশি তাকে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতেও সচেষ্ট হন।
“গোয়েন্দা গড়াই” বইটির গল্পগুলির পরিপ্রেক্ষিতে অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলি, আমরা জানি— গত লকডাউনে কলকাতা পুলিশের রাস্তায় নেমে মাইক নিয়ে গান গেয়ে জনগণকে সচেতন করার প্রচেষ্টাতে সামিল হয়েছিলেন প্রণব গড়াইও।
না, তিনি গান গাইতে পারেন না। লেখিকা জানেন, মানুষ হিসেবে সম্ভবত তিনি ঈষৎ লাজুক প্রকৃতিরও। তবু, তিনিও ছিলেন সহকর্মীদের সঙ্গে। একটু পিছনে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছিলেন বেলা বোস বা গুপিবাঘার গানের সুরে।
গোয়েন্দা গড়াই নামটিতে শ্রুত্যনুপ্রাসের একটু ছোঁয়া থাকলেও এবং গড়াই পদবিটিতে একটু হলেও হাস্যরস্যের ছোঁয়া থাকলেও প্রণব গড়াই কিন্তু আদপেই বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী গোয়েন্দাদের বন্ধু বা শত্রুরূপী পুলিশ অফিসারদের ন্যায় হাস্যকর আচরণযুক্ত দারোগা নন। তিনি যেমন তাঁর এসপি’র প্রিয় অফিসার, তেমনই তাঁর কাহিনিকারের পাঠককূলেরও প্রিয় এক গোয়েন্দা।
এককালের তাবড় গোয়েন্দারা এখন আর অপরাধীদের পিছনে ছোটেন না। তবু অপরাধ কি থেমে থাকে? এখন থেকে না-হয় তাদের পিছনে ছুটুন কলকাতা পুলিশ ডিপার্টমেন্টের দুঁদে এই অফিসারটি। কামনা করি তিনি সফল হোন প্রতিটি কেসে। তদন্ত করে রিপোর্ট দিন, দোষীকে শাস্তি দিন, লেখিকাও লিপিবদ্ধ করুন সে-সমস্ত ঘটনা আমাদের জন্য।
অপেক্ষায় থাকলাম ছোটো গল্প ছাড়াও প্রণব গড়াইয়ের অপেক্ষাকৃত বড়ো কেসগুলি বড়োগল্প বা উপন্যাসের আকারে সংগ্রহ করতে। আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই অফিসার প্রণব গড়াই, ইন্সপেক্টর কবীর সান্যাল, সাব ইন্সপেক্টর কল্পনা চৌধুরী এবং তাঁদের স্রষ্টা ঋতুপর্ণা রূদ্রকে।
শুভেচ্ছা জানাই প্রচ্ছদ শিল্পী ধীমান পালকে। এবং একই সঙ্গে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই “ঘরে বাইরে” পাবলিকেশনকে একটি অত্যন্ত সুন্দর এবং দৃষ্টিনন্দন পেপার ব্যাক উপহার দেওয়ার জন্য। একশো বারো পাতার একটি বইয়ে, পনেরো নম্বর পৃষ্ঠায় কেবল মাত্র দু’টি প্রিন্টিং মিসটেক ছাড়া একটি ভুলও চোখে পড়েনি। এ উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়।
বইয়ের নাম: গোয়েন্দা গড়াই
লেখকের নাম: ঋতুপর্ণা রুদ্র
প্রকাশনের নাম: ঘরে বাইরে পাবলিকেশন
সমালোচক- ঋষেণ ভট্টাচার্য- বেসরকারী সংস্থায় কর্মরত। লেখালেখির সাথে সাথে শখ ভ্রমণ এবং গানবাজনা।
সংকলনা- জয় ভদ্র, "হরপ্পা", "হাজার শতাব্দীর রূপকথা অথবা রাজনৈতিক বিষণ্ণতা", "ইডিকেস"-এর মতো বইয়ের লেখক তিনি, নয়ের দশকের শেষ লগ্ন থেকে লেখালেখি শুরু। "হরপ্পা" অনূদিত হয়েছে হিন্দি ভাষায়। এছাড়াও তার ছোটগল্পগুলো একসময় হিন্দি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ছিলেন এক বিশেষ পত্রিকার কার্যকরী সম্পাদক। একটা সময় মূলত সাংবাদিকতার সঙ্গে সঙ্গে চালিয়ে গিয়েছিলেন সাহিত্যকর্ম। এই মুহূর্তে পুরোপুরি সাহিত্যেই মনোনিবেশ করেছেন। গল্প, উপন্যাস যেমন তাঁর অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র তেমনি পুস্তক সমালোচনা এবং নাট্য-সমালোচক হিসাবেও সমাদৃত হয়েছেন।