দেশ পত্রিকায় মনোনীত হয়নি, প্রথম রবীন্দ্র পুরস্কার পায় ‘জাগরী’

  • ঘাড়ের পাশে পুলিশের রুলের মোটা দাগ
  • সেখানে আলো বাতাস ঢোকে না বললেই চলে
  • বাতাসহীন টি-সেলে বসেই লিখে ফেললেন উপন্যাস
  • জেলে বসে লেখা তার উপন্যাস ‘জাগরী’ 

সময়টা গেল শতকের চারের দশক। গোটা দেশ ভারত ছাড় আন্দোলনে উত্তাল।ভাগলপুর সেন্ট্রাল জেলের টি-সেলের ঠান্ডা মেঝেতে বসে ঘাড় গুঁজে একমনে কী যেন লিখে চলেছেন এক রাজবন্দি। এর আগে একবার দলবল নিয়ে জেল ভেঙে পালাবার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু পারেননি। ঘাড়ের পাশে পুলিশের রুলের মোটা দাগটা এখনও জেগে আছে।থাকেন কড়া নজরদারিতে। টি সেলগুলিতে রাখা হয় বিপজ্জনক বন্দিদের। সেখানে কেউ সাধ করে থাকতে চায় না। তবে তিনি সুপারিন্টেন্ডেন্টকে আবেদন জানিয়েই ছোট্ট খুপরি চেয়ে নিয়েছেন। সেখানে আলো বাতাস ঢোকে না বললেই চলে। তাই সুপারিন্টেন্ডেন্ট জানতে চেয়েছিলেন, ওখানে কেন? বন্দি জানিয়েছিলেন, একা থাকা যাবে আর লেখাপড়ার কাজটা ভাল হবে। 

ওই আলো বাতাসহীন টি-সেলে বসেই রুল টানা খাতায় লেড পেন্সিলে বন্দি লিখে ফেললেন আস্ত একতি এক উপন্যাস। জেলে বসেই সেই উপন্যাস পড়ে ফেললেন তাঁরই এক অনুগত শিষ্য, তিনিও রাজবন্দি। পড়ে এতটাই মুগ্ধ হলেন যে কেঁদে ফেললেন। লেখকের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে জানিয়েছিলেন যে তিনি ধন্য ওই অসামান্য উপন্যাসের প্রথম পাঠক হতে পেরে। এরপর জেল থেকে ছাড়া পেলেন সেই উপন্যাস লেখক। কিন্তু সেই উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি বাক্সবন্দি হয়ে পড়েই রইল। এই লেখকের নাম সতীনাথ ভাদুড়ী। জেলে বসে লেখা তার ‘জাগরী’ উপন্যাসের প্রথম পাঠক হলেন ‘ময়লা আচল’-এর লেখক ফণীশ্বরনাথ রেণু। 

Latest Videos

জেলে যাওয়ার আগেও মানুষটি ছিলেন ছাপোষা এবং অতি শান্ত। বন্ধুকে চিঠিতে লিখেছিলেন, সকাল ৭টা থেকে ৯টা গুড বয়— আইন পাঠ। ন’টা থেকে বারোটা কেদার বাঁড়ুজ্যে সাহিত্যিকের বাড়ীতে আড্ডা। খাওয়া দাওয়ার পর ছোট্ট একটা ঘণ্টা তিনেকের ঘুম। ঘুম থেকে উঠে চা পানের সঙ্গে খবরের কাগজ পাঠ।  তারপর সান্ধ্যভ্রমণ। তারপর নটা পর্যন্ত বাজি রেখে ব্রিজ খেলা।
আচমকাই একদিন বদলে গেল জীবনটা। গান্ধীজির ডাকে তখন দেশের সর্বত্র চলছে পিকেটিং। একদিন বন্ধুদের ডাকে গেলেন মদের দোকানে পিকেটিং করতে। তেড়ে এল পুলিশ। বন্ধুরা পালাল লাঠির ভয়ে। একা বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন একরোখা জেদি সতীনাথ।যে কিনা পরিচিত মানুষের সামনে কথা বলতে সংকোচ করত, সেই মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ল স্বাধীনতা সংগ্রামে। পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালাতে হত পায়ে হেঁটে, চুপিসাড়ে, রাতবিরেতে ট্রেনে চেপে। অন্ধকারে মাইলের পর মাইল বিনা টর্চে জল কাদা মাড়িয়ে গিয়ে মিটিং ছিল যখন তখন। 

বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় ছিলেন সতীনাথের পরম বন্ধু। তাঁর বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল সতীনাথের। একদিন গেলেন বনফুলের বাড়ি। কথায় কথায় সংকোচে বলেই ফেললেন তাঁর উপন্যাসের কথা। বলাইচাঁদ তো বন্ধুর উপন্যাস পড়ে মুগ্ধ! ‘কী লিখেছ তুমি! অসামান্য! এক্ষুনি এই উপন্যাস ছাপানোর ব্যবস্থা করতে হবে’। কিন্তু সতীনাথের যে সে যোগাযোগ নেই, সে কথা বলেই ফেললেন। ‘দাঁড়াও, আমি ব্যবস্থা করছি। আমার ভাই ঢুলু-র (অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, সিনেমা পরিচালক) সঙ্গে সাগরময় ঘোষের ভাল পরিচয় আছে। ওঁর কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি’। সাগরময় তখন দেশের সহ সম্পাদক। অরবিন্দ কলকাতায় এসে নিজে গেলেন পত্রিকার দফতরে। সাগরময় ঘোষের সঙ্গে দেখা করে ‘জাগরী’র পাণ্ডুলিপি হাতে জমা দিলেন। সাগরবাবু বললেন, ‘একমাস পর এসে খোঁজ নিতে’। 

একমাস পর আবার গেলেন অরবিন্দ। সাগরবাবু পাণ্ডুলিপি ফেরত দিয়ে বললেন,  ‘না মনোনীত নয়’। অরবিন্দ শুনে অবাক হয়েছিলন, ‘সাগরদা আপনি নিজে পড়েছেন?’ ‘না আমি পড়িনি, তবে যিনি পড়েছেন তিনিও সাহিত্যের মস্ত সমঝদার’। আসলে সাগরবাবু পড়তে দিয়েছিলেন গৌরকিশোর ঘোষকে। যাইহোক ‘জাগরী’-র পাণ্ডুলিপি ফেরত চলে এল।তাহলে এখন উপায়?  হাল ছাড়তে রাজি নয় অরবিন্দ। সোজা গেলেন ‘শনিবারের চিঠি’র সম্পাদক সজনীকান্ত দাসের বাড়ি। ‘দাদা এই উপন্যাসটা একবার পড়ে দেখবেন? একজন নতুন লেখক’। দু’দিন পর কাকভোরে অরবিন্দবাবুর বাগবাজারের বাড়ির নীচে সজনীকান্তর ডাকাডাকি। ‘এক্ষুনি নীচে এস। আরে এ কে? কী সাংঘাতিক লেখা! এ লেখা এক্ষুনি ছাপাতে হবে’। ‘কিন্তু ছাপবে কে?’

আমি ছাপতে পারলে ধন্য হতাম। কিন্তু আমার পত্রিকায় এখন তারাশংকর আর বনফুলের ধারাবাহিক উপন্যাস চলছে, কবে শেষ হবে জানি না। কিন্তু তত দিন এই লেখা ফেলে রাখলে চলবে না। এখনই পাঠকদের কাছে পৌঁছানো দরকার। আমি একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি। তুমি চিঠি আর এই পাণ্ডুলিপি নিয়ে এখনই যোগাযোগ কর’। সজনীকান্তের চিঠি নিয়ে অরবিন্দ পউছে গেলেন। নিউজপ্রিন্টে বই হয়ে জাগরী ছেপে বেরল। আর প্রকাশিত হওয়া মাত্র বাংলার পাঠক মহলে পড়ে গেল হইচই। নতুন লেখকের প্রথম উপন্যাস ‘জাগরী’ পেল প্রথম রবীন্দ্র পুরস্কার। কিন্তু এরপরও সাগরময় ঘোষকে সতীনাথ ভাদুড়ী ফিরিয়ে দেন নি। দেশ পত্রিকার জন্য লিখেছেন ধারাবাহিক। তাঁর আরেক কালজয়ী উপন্যাস ঢোঁড়াই চরিত মানস প্রকাশিত হয়েছে দেশ পত্রিকায়। 

Share this article
click me!

Latest Videos

‘Bangladesh-কে মারতে হবে না চোখ দেখালেই যথেষ্ঠ’ বাংলাদেশকে ধুয়ে দিলেন Dilip Ghosh | Bangladesh News
Narendra Modi : 'কুয়েত যেন মিনি হিন্দুস্তান', কুয়েত সফরে এসে কেন বললেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী?
Suvendu Adhikari Live: এগরায় জনসভা শুভেন্দুর, কী বার্তা, দেখুন সরাসরি
Dev Adhikari : এবার কী আসছে খাদান ২? খাদান সাফল্য পেতেই বড়সড় ঘোষণা দেব-যীশুদের
'একটা আস্ত অশিক্ষিত...গোটা রাজ্যটাই জঙ্গিদের হাতে' কড়া বার্তা শুভেন্দুর | Suvendu Adhikari