
আজকের দ্রুতগতির জীবনে, ফাস্টফুড, কম শারীরিক পরিশ্রম এবং অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার কারণে শরীরে অতিরিক্ত চর্বি জমা হওয়া একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা। এই চর্বি, রক্তনালীতে জমা হয়ে হৃদরোগ, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ, টাইপ 2 ডায়াবেটিসের মতো বিভিন্ন রোগের কারণ হতে পারে। এই ক্ষতিকারক চর্বি কমাতে এবং সুস্থ থাকতে সাবজা বীজ ও দইয়ের মিশ্রণ একটি অসাধারণ প্রাকৃতিক উপায়।
সাবজা বীজ:
সাবজা বীজ, উদ্ভিদবিদ্যার ভাষায় 'Ocimum basilicum' নামে পরিচিত তুলসী গাছের এক প্রকার। রান্নায় ব্যবহৃত তুলসী থেকে এটি ভিন্ন। এর গুণাগুণ জলে ভেজানোর পরে প্রকাশ পায়। জলে ভেজালে এটি প্রায় 30 গুণ ফুলে ওঠে এবং জেলের মতো আবরণ তৈরি করে। এই জেলের মতো আবরণই এর স্বাস্থ্য উপকারিতার মূল কারণ।
সাবজা বীজের পুষ্টিগুণ :
ক্যালোরি: 40-50
ফাইবার: 7-8 গ্রাম (দৈনিক চাহিদার 25-30%)
প্রোটিন: 2-2.5 গ্রাম
চর্বি: 0.5 গ্রাম (ওমেগা-3 ফ্যাটি অ্যাসিড)
কার্বোহাইড্রেট: 7 গ্রাম
খনিজ: ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন, ফসফরাস।
ভিটামিন: ভিটামিন K, ফোলেট।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট: ফ্ল্যাভোনয়েড, পলিফেনল ইত্যাদি।
সাবজা বীজ ও দইয়ের মিশ্রণের উপকারিতা:
চর্বি কমানো:
সাবজা বীজের দ্রবণীয় ফাইবার, পেটে জেলের মতো আবরণ তৈরি করে। এটি পেট ভরা রাখে, ক্ষুধা কমায় এবং খাবার গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। ফলে শরীরের অতিরিক্ত চর্বি এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা কমে। দইয়ের প্রোটিন ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে সাবজা বীজকে সাহায্য করে।
রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ:
সাবজা বীজের ফাইবার, অন্ত্রে কার্বোহাইড্রেট শোষণের গতি কমায়। ফলে খাবার পর রক্তে শর্করার মাত্রা হঠাৎ বেড়ে যাওয়া রোধ করে। দইয়ের প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া, পাচনতন্ত্রের স্বাস্থ্যের উন্নতি করে এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এটি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপকারী।
পাচনতন্ত্রের উন্নতি:
সাবজা বীজের ফাইবার, মলের পরিমাণ বাড়ায় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। দইয়ের উপকারী ব্যাকটেরিয়া, অন্ত্রের সুস্থতা বজায় রাখে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং পুষ্টি শোষণে সাহায্য করে। সাবজা বীজ প্রিবায়োটিক হিসেবে কাজ করে এবং এই উপকারী ব্যাকটেরিয়ার খাদ্য হিসেবে কাজ করে।
শরীর ঠান্ডা রাখা এবং টক্সিন দূরীকরণ:
সাবজা বীজ প্রাকৃতিকভাবে শরীর ঠান্ডা রাখে। এটি গরমের সময় শরীরকে সতেজ রাখে। ফাইবার, শরীর থেকে টক্সিন দূর করতে সাহায্য করে।
হাড় এবং পেশীর স্বাস্থ্য:
দইয়ের ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন D হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য, সাবজা বীজের ম্যাগনেসিয়াম পেশী এবং স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকারিতার জন্য, এবং দইয়ের উচ্চমানের প্রোটিন পেশীর বৃদ্ধি এবং মেরামতের জন্য উপকারী।
সাবজা বীজ ও দইয়ের মিশ্রণ তৈরির পদ্ধতি
এক চা চামচ (প্রায় 10 গ্রাম) শুকনো সাবজা বীজ এক গ্লাস (প্রায় 200 মি.লি) ঠান্ডা জলে 30 মিনিট থেকে 1 ঘন্টা ভিজিয়ে রাখুন। বীজগুলি জল শুষে নিয়ে কালো রঙের, জেলের মতো আবরণ সহ নরম হয়ে যাবে।
এক কাপ (প্রায় 150-200 গ্রাম) চিনি ছাড়া, ঘন দই নিন। ভেজানো সাবজা বীজ জলসহ দইয়ের সাথে ভালো করে মিশিয়ে খান। এই স্বাস্থ্যকর মিশ্রণটি আপনার দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় যোগ করুন।
ইচ্ছা করলে, কাটা ফল বা বাদাম যোগ করে খেতে পারেন।
মিষ্টির প্রয়োজন হলে, এক চা চামচ মধু বা ম্যাপেল সিরাপ যোগ করতে পারেন।
সামান্য এলাচ গুঁড়ো বা দারচিনি গুঁড়ো যোগ করলে স্বাদ এবং গন্ধ বাড়বে, সাথে কিছু স্বাস্থ্য উপকারিতাও যোগ হবে।
কখন, কিভাবে খাবেন?
সকালের নাস্তা: এটি একটি পুষ্টিকর সকালের নাস্তা। এটি দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা রাখবে এবং সারাদিন শক্তি যোগাবে।
দুপুরের খাবারের আগে: দুপুরের খাবারের প্রায় 30 মিনিট আগে এটি খেলে খাবারের পরিমাণ কমাতে সাহায্য করবে।
বিকেলের নাস্তা: তেল-ঝাল খাবারের বদলে, এটি একটি স্বাস্থ্যকর নাস্তা।
রাতের খাবারের বিকল্প: যারা ওজন কমাতে চান, তারা রাতের খাবারের বদলে এই সাবজা-দইয়ের মিশ্রণ খেতে পারেন। এটি হালকা এবং সহজপাচ্য।
বিশেষ বিবেচ্য বিষয়:
সাবজা বীজ অনেক জল শোষণ করে, তাই এটি খাওয়ার দিনগুলিতে প্রচুর জল পান করতে হবে। নাহলে কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডিহাইড্রেশন হতে পারে।
একদিনে কোন অলৌকিক ফলাফল আশা করবেন না। নিয়মিত ব্যবহার করতে হবে। প্রথমে এক চা চামচ সাবজা বীজ দিয়ে শুরু করুন এবং শরীরের সাথে মানিয়ে নেওয়ার পর পরিমাণ বাড়াতে পারেন।
গর্ভবতী মহিলা, স্তন্যদানকারী মা, শিশুদের সাবজা বীজ দেওয়ার আগে বা যারা কোন দীর্ঘস্থায়ী রোগের জন্য ওষুধ খাচ্ছেন (বিশেষ করে রক্তে শর্করার বা রক্তচাপের ওষুধ), তাদের ডাক্তার বা পুষ্টিবিদের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কারণ সাবজা বীজ কিছু ওষুধের শোষণকে প্রভাবিত করতে পারে।
ভালো মানের, পরিষ্কার সাবজা বীজ ব্যবহার করুন।
যাদের ল্যাকটোজ অসহিষ্ণুতা বা দুগ্ধ অ্যালার্জি আছে, তারা সয়া দই, বাদাম দই বা নারকেল দই ব্যবহার করতে পারেন।
সাবজা বীজ ও দইয়ের মিশ্রণ শরীরের অতিরিক্ত চর্বি কমানোর একটি সহজ, প্রাকৃতিক এবং সুস্বাদু উপায়। এটি ওজন নিয়ন্ত্রণ, রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ, পাচনতন্ত্রের উন্নতি এবং সার্বিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। এটি আপনার দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় যোগ করুন এবং নিয়মিত ব্যায়াম ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা অনুসরণ করুন সুস্থ থাকার জন্য।