পৃথক মুসলমান রাষ্ট্রের প্রস্তাব দিয়েছিলেন ঊর্দু কবি ইকবাল, জানুন সেই কাহিনি

  • মহম্মদ ইকবাল ছিলেন বিখ্যাত উর্দু কবি, রাষ্ট্রতাত্ত্বিক ও দার্শনিক।
  •  একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে বিপুল জনপ্রিয় সারে জহাঁ সে অচ্ছা
  •  পরবর্তীতে গানটি ভারতীয় সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজ সঙ্গীতে পরিণত হয়
  • ঊর্দু কবি আল্লামা ইকবালের পরিচিতি আগে থেকেই রাষ্টতাত্ত্বিক হিসেবে প্রসার লাভ করেছিল

Tapan Malik | Published : Nov 9, 2020 11:33 AM IST / Updated: Nov 09 2020, 05:13 PM IST

সারে জহাঁ সে অচ্ছা হিন্দোসিতাঁ হমারা / হম বুলবুলেঁ হ্যাঁয় ইসকী ইয়ে গুলসিতাঁ হমারা… এই  উপমহাদেশে এমন একজনকে পাওয়া যাবে না যার কাছে এই পংতি দুটি অচেনা বা অজানা। প্রায় ১১৬ বছর আগে সাপ্তাহিক পত্রিকা ইত্তেহাদ-এ ছোটদের জন্য লেখা এই কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। রচয়িতা লাহোর গভর্ণমেন্ট কলেজের শিক্ষক আল্লামা ইকবাল। ওই বছর লাহোর গভর্ণমেন্ট কলেজের একটি  অনুষ্ঠানে ছাত্রদের অনুরোধে সভাপতি আল্লামা ইকবাল তাঁর ভাষণের পরিবর্তে ওই কবিতাটি গেয়ে শোনান। 
গানটি একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে এ দেশে বিপুল জনপ্রিয়। কথিত  মহাত্মা গান্ধী পুণে শহরের ইয়েরাওয়াড়া জেলে বন্দী থাকার সময় এই গানটি বারবার গাইতেন। গানটি রবি শঙ্করের সুরে অন্য মাত্রা লাভ করে। পরবর্তীতে গানটি ভারতীয় সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজ সঙ্গীতে পরিণত হয়। ভারতের প্রথম মহাকাশচারী রাকেশ শর্মাকে যখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মহাকাশ থেকে ভারতকে কেমন দেখতে লাগে প্রশ্ন করে জানতে চান, তখন রাকেশ শর্মা এই গানের প্রথম পংতিটি বলেছিলেন। 

গানটির রচয়িতা আল্লামা মহম্মদ ইকবাল ছিলেন বিখ্যাত উর্দু কবি, রাষ্ট্রতাত্ত্বিক ও দার্শনিক। তাঁর কাব্যে একদিকে সর্বেশ্বরবাদী মরমীয়া অনুভূতি অন্যদিকে স্বদেশের প্রতি অনুরাগ। তিনি যে কোনও রকম শোষণের বিরোধী ছিলেন, শ্রমিক, কৃষকদের ন্যায্য দাবিদাওয়ার পক্ষে ছিল তাঁর মত। তবে তার বিচার ছিল কোরানের বাণীর প্রেক্ষিতে। ভারতীয় জাতীয়তাবেদের থেকেও মনে প্রাণে চাইতেন ইসলামী নবজারণ। কেবল তাই নয়, তিনি ছিলেন অখণ্ড ভারতের বিরোধী। ইকবাল মনে করতেন, ভারতে মুসলমানদের ভবিষ্যত গঠন করতে পারে একটি পৃথক রাষ্ট্র। যে কারণে তিনি গেল শতকের তিরিশের দশকের গোড়ায় ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের প্রদেশগুলিকে সংযুক্ত করে একটি মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব দেন। ভারতে মুসলমানদের জন্য মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের আলাদা ও স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনায় ইকবালের ওই প্রস্তাব নতুন করে ইন্ধন যোগায়। ইতিমধ্যে মহম্মদ আলি জিন্নার চোদ্দ দফা দাবি কংগ্রেস মেনে না নেওয়ায় জিন্নার নেতৃত্বে মুসলিম লিগ সর্বদলীয় সম্মেলন বয়কট করে। দেশের রাজনীতিতে তৈরি হয় নতুন সংকট- বাড়তে থাকে হিন্দু-মুসলিম ব্যবধান।

ভারতে মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনায় ইকবাল ছাড়াও ইন্ধন যোগান কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র চৌধুরী রহমত আলি। প্রসঙ্গত, রহমত আলির মুসলিম জাতীয় রাষ্ট্র তত্ত্ব বা মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব প্রথমদিকে মুসলমান নেতৃবৃন্দ উদ্ভট মস্তিষ্ক প্রসূত কল্পনা বলে উড়িয়ে দেন। এমনকি ইকবালও এর ভয়ঙ্কর পরিণামের কথা ভেবে সমালোচনা করেছিলেন। তবে তিনি ভারতে মুসলিমদের স্বার্থরক্ষায় যে যুক্তরাষ্ট্র গঠনের কথা বলেছিলেন, তাতে অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলিতে হিন্দু মুসলমানের পৃথক কর্তৃত্ব থাকলেও বৈদেশিক, প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ প্রভৃতি ক্ষেত্রে যৌথ দায়িত্ব থাকার প্রস্তাব দেন। 

অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসক শুরু থেকেই ভারতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে ভাঙন ধরাতে উন্মুখ হয়ে থাকত। পাকিস্তান প্রস্তাব তাঁদের ইচ্ছে ও প্রচেষ্টাকে সফল করার ইন্ধন যোগায়। গোলটেবিল বৈঠকে জিন্না এবং অন্যান্য মুসলমান নেতারা মুসলমানদের জন্য বিশেষ সুযোগ সুবিধা জোরদার দাবি তোলে। দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে গান্ধিজি বহু চেষ্টা করেও জিন্নাকে তাঁর সাম্প্রদায়িক দাবি থেকে নড়াতে পারেন নি। কারণ ইতিমধ্যে মহম্মদ আলি জিন্নার নেতৃত্বে মুসলিম লিগ মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য অনেক দূর ভাবনা চিন্তা করে ফেলেছেন। এদিকে নেহরু সংবিধান বানচাল হওয়ার পর বহু জাতীয়তাবাদী মুসলিম নেতা কংগ্রেস ছেড়ে মুসলিম লিগে যোগ দেওয়ায় সেই দলের সাংগঠনিক শক্তি বহুগুণে বৃদ্ধি হয়। ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইনে সাম্প্রদায়িক বিভাজন নীতি স্বীকৃতি পায়। তাতে মুসলিম নেতৃবৃন্দ খুশি হন। প্রসঙ্গত, ঊর্দু কবি আল্লামা ইকবালের পরিচিতি তার আগে থেকেই রাষ্টতাত্ত্বিক হিসেবে সমধিক প্রসার লাভ করেছিল। 
 
নতুন ভারত শাসন আইনের রূপরেখা অনুযায়ী সারা দেশের সাধারণ নির্বাচনে তখনকার ভারতের এগারোটি রাজ্যের মধ্যে সাতটিতে কংগ্রেস বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। ওই সাতটি রাজ্যে সেবার কংগ্রেস মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। মুপাশাপাশি মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত নির্বাচন ক্ষেত্রগুলিতে এবং অন্যান্য মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যগুলিতে মুসলিম লিগও সাফল্য অর্জন করে। উল্লেখ্য, নির্বাচনের পর মুসলিম লিগ কংগ্রেসের সঙ্গে যুগ্মভাবে মন্ত্রিসভা গঠনের প্রস্তাব দিলে কংগ্রেস তা প্রত্যাখ্যান করে। কংগ্রেসের আচরণে জিন্না ভীষণভাবে অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন।

Share this article
click me!