একদিন বোম্বে রেল স্টেশনে নেমে ছেলেটি গিয়ে দাঁড়াল সিনেমার হোর্ডিং আঁকিয়ে শাবাবের কাছে। কিন্তু শাবারের কাছে তাঁর সৃজনশীল ছবির কোনও দাম নেই। কয়েকটা সরু মোটা রেখা আর বিভিন্ন রং – একে কি পেইন্টিং বলা যায়? রিয়েলিস্টিক পোর্ট্রেট না হলে কিসের পেইন্টিং? শাবার তাঁকে বললেন, ‘আমার কথা শোনও, ইন্দোরে ফিরে যাও’। ছেলেটি কাতর কণ্ঠে বললেন, ‘আমাকে দয়া করুন, আমার আর কোথাও, কারও কাছে যাবার নেই’। শেষমেশ শাবাবই দৈনিক ছ’আনা বেতনে ছেলেটিকে চাকরি দিল। ওই ছ’আনায় খিচদিওয়ালার দোকান থেকে দু’বেলায় যা খাবার মেলে তাতে ছেলেটির পেট ভরে যায়।
একদিন খিচদিওয়ালা তাঁর মায়ের পোর্ট্রেট করাতে চাইলেন। ছেলেটি কয়েকটি স্কেচ করে একটি ধারণা নিলেন। তারপর একটি গোটা দিন শাবারের কাছে কামাই করে কাগজ কিনে কয়েক ঘন্টায় খিচদিওয়ালার মায়ের পোর্ট্রেটটি শেষ করল সেই ছেলেটি। রিয়েলিস্টিক সেই পোর্ট্রেটে কেবল এক নারীর চেহাড়া নয়, ব্যক্তিত্বও ধরা পড়ল। খিচদিওয়ালা মায়ের ছবি আঁকিয়ে ছেলেটিকে যথেষ্ট সম্মান করে বললেন, ‘এক মাস তোমার কাছ থেকে খাবারের দামই নেব না’। শাবাবের কাছে কাজ করতে করতে ছেলেটি কাঠের কাজ শিখল। মাচা বানিয়ে ফ্রেমে চট ঢুকিয়ে টানটান করে তাতে বিলবোর্ড বানানো। ইতিমধ্যে হোর্ডিং আঁকার কাজ করে বিশাল ফ্রেমে ছবি আঁকার কাজটা পোক্ত করে ফেলেছে। তবে শরীর আর মনের জোর সবসময় একরকম থাকে না।
প্রতিদিন এবেলা-ওবেলা অপুষ্টিকর খাবার শরীরের ওপর চাপ পরবেই। দু-একবার উঁচু মাঁচায় উঠে মাথা ঘুরে গিয়েছে। ওপর থেকে পড়ে গিয়ে মাথা ফেটেছে। কঠিন আমাশয় হয়েছে। গ্যালন গ্যালন তিসির তেল, কেরোসিন, দস্তার রঙের ঘ্রাণ টানতে টানতে দুরারোগ্য কাশি হয়েছে। মুসলমান বিধবা মেহমুদাবিবি তাঁর বাড়িতে একটি মেস চালাতেন। যুবকটি সেখানে গিয়ে উঠলেন। একবার দুমাসের বকেয়া ভাড়া বাকি পড়ে গেল। তার ছেলে একদিন বিছানা-বালিশ রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে যুবকটিকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। ঠিক এই সময় যুবক্টি একাই পেল জিন্দেগি ছবির হোর্ডিং তৈরির কাজ। পরদিন ভোরের আগে মারাঠি সিনেমার নায়িকা দুর্গা খোটের ৪০ ফুট কাট-আউট তৈরি করতে হবে। মাঝরাত থেকে ভোর চারটা পর্যন্ত ট্রাম চলাচল বন্ধ। রাস্তার এ মোড় থেকে ওই মোড় পর্যন্ত ক্যানভাস বিছিয়ে দিয়ে যুবকটি চারটে বাজার আগেই কাট-আউট শেষ করে ফেলল।
জিন্দেগি’র কাট আউট করে তাঁর হাতে বেশ কিছু টাকা এল। সব পাওনাদারের টাকা শোধ করে মেহমুদাবিবির হাতেও তুলে দিলেন দুমাসের বকেয়া-সহ আগাম দু’মাসের টাকা। অপদস্থ হলেও সে বাড়িতে বাড়তি আকর্ষণ ফজিলা, মেহমুদাবিবির মেয়ে। ইতিমধ্যে তাকে যুবকটি দশ পাতার একটি প্রেমপত্র লিখেছে। সবাই বিরোধিতা করেছে, এমন চালচুলোহীন ভবঘুরের সঙ্গে মেয়ে বিয়ের প্রশ্নই আসে না, কিন্তু মেহমুদাবিবির মৌন সমর্থনে কিছু খেজুর বিতরণ করে তাদের নিকাহ সম্পন্ন হয়। বিয়ের দিনও বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত সেই যুবক সিনেমার হোর্ডিং এঁকেছে। সিনেমার হোর্ডিং আঁকতে আঁকতেই তিনি একদিন মকবুল ফিদা হুসেন হয়েছেন। হুসেনের প্রথম একক প্রদর্শনী হয় বোম্বেতে। দ্বিতীয়টি কলকাতা আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে। সে-সময়কার বাংলার সবচেয়ে খ্যাতিমান শিল্প-সমালোচক ও সি গাঙ্গুলি তাঁর কাজের ওপর সিল মেরে দেন, ‘বিট্রেয়াল অব যামিনী রায়’ অর্থাৎ যামিনী রায়ের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। কলকাতায় তাঁর একটি ছবিও বিক্রি হলনা। হুসেন কলকাতায় পড়ে রইলেন। কারণ, ফিরতি টিকিট কিনে বোম্বেতে ফিরে যাওয়ার মতো পয়সাও তাঁর হাতে নেই।
পরের বছর একাডেমির আয়োজনে অনুষ্ঠিত হলো প্রথম ভারতীয় জাতীয় প্রদর্শনী। এম এফ হুসেনের ক্যানভাস ‘জমিন’ পেয়ে গেল প্রথম জাতীয় পুরস্কার। কিন্তু হুসেনের পুরস্কারপ্রাপ্তিতে শিল্পীমহলের অনেকেই অসন্তুষ্ট হলেন। ন্যাশনাল মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষও হুসেনের ছবি দেওয়াল থেকে নামিয়ে গুদামে পাঠিয়ে দেয়। হুসেন মানে সাদা পোশাক, বিদেশি গাড়ি, লম্বা তুলি, খালিপা এবং বিতর্ক –সব মিলিয়ে তিনি ভারতীয় চিত্রশিল্পের বিরাট প্যাকেজিং। কী ভাবে যে হুসেন স্যাভিল রো-র মহার্ঘ সুট আর খালি-পায়ের পদচারণাকে সহাবস্থান করাতে পারেন একই শরীরে। অথচ, এই সম্মেলন নিয়েই মকবুল ফিদা হুসেন। সমালোচকেরা সরবে বলেন, ‘গিমিক’! হুসেন দৃকপাত করেন নি। আপন খেয়ালে ছবি এঁকে গিয়েছেন। নিজের মতো করে বেঁচেছেন। বার বার বদলেছেন তাঁর ‘মানসী’-কে, মাধুরী দীক্ষিত থেকে টাব্বু, বিদ্যা বালন থেকে অমৃতা রাও, গুঞ্জন উঠেছে, কান দেননি। তাঁকে ঘিরে বিতর্ক যত প্রবল, ততই খ্যাতির শিখর থেকে শিখরে উত্থান।