গোটা টুর্নামেন্টে ধোনি অফ ফর্মে, কিন্তু প্রতি পদক্ষেপে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন রাজার মতোই। তিনি ক্রিকেটের ফেলুদা। স্ট্যাম্পের পিছনে থেকে বিপক্ষের ১১ জনের শরীরীভাষা পড়ে ফেলেন অবলীলায়।
দশমীর সন্ধে থেকেই কলকাতায় আকাশের মুখ ভার। একটু রাত বাড়তে মুখ ভার ক্রিকেটপ্রেমী বাঙালিরও। সাধের টিম যাও বা ফাইনালে গেল, ম্যাজিক ঘটল না। হ্যাঁ, ম্যাজিকই বটে। চেন্নাই-কলকাতা-র মহারণের ফলাফল স্বাভাবিক এবং ন্যায্য। বরং কলকাতা ট্রফি জিতলে তা ম্যাজিক হত। শত দুশ্চিন্তার মধ্যেও মন্নতের বাড়ি থেকে শাহরুখ খান (Shah Rukh Khan) যদি এই ম্যাচটি দেখে থাকেন, তিনি এই ফলাফলে অবাক হয়েছেন কি? আশা করি না। 'হারকার জিতনে ওয়ালে কো বাজিগর কেহতে হ্যায়'। কিন্তু গোটা টুর্নামেন্টে হাতে গোণা কয়েকটা ম্যাচ বাদ দিলে তাঁর দলের পারফরম্যান্স বাজিগর-এর মত মোটেই ছিল না,এ কথা তাঁর চেয়ে ভাল কে-ই বা জানবে! এ কথা ঠিক যে আইপিএল-এর আরব পর্বে নাইটরা অধিকাংশ ম্যাচ জিতেছে। কিন্তু মিডল অর্ডার সেইসব ম্যাচে পরীক্ষিত হয়েছে কি? মরগ্যানের অধিনায়কত্বে কতবারই বা চমক দেখা গিয়েছে? প্রশ্নগুলো সহজ, উত্তরও তো জানা। বলতে গেলে ২০২১ আইপিএলে (IPL 2021) গিল-দের আসল পুরস্কার ফাইনালে ওঠার কামব্যাক-টাই। আইয়ার, রাহুল, মাভিদের তারুণ্যে যে পুরস্কার অর্জিত। কিন্তু কাপ জিততে তারুণ্যের সঙ্গে প্রয়োজন পড়ে সঠিক নেতৃত্বের। আর ঠিক এইখানেই কলকাতার পকেট ফুটো। মরগ্যানকে অবলীলায় ডজ মেরেছেন মহেন্দ্র সিংহ ধোনি (Mahendra Singha Dhoni)। কী নিদারুণ হিমশীতল মানসিকতায় পকেটে ভরলেন নিজের ৩০০তম টি-টোয়েন্টি ম্যাচটি! যদিও নোটবুকে যদি এই ম্যাচের কথা লিখতে বসেন ক্যাপ্টেন কুল, হয়তো অন্যগুলোর চেয়ে একে বিশেষ আলাদা করতে পারবেন না। তার জন্য অতি সাধারণ একটা ম্যাচ, আর পাঁচটার মতোই।
গোটা টুর্নামেন্টে ধোনি অফ ফর্মে, কিন্তু প্রতি পদক্ষেপে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন রাজার মতোই। তিনি ক্রিকেটের ফেলুদা। স্ট্যাম্পের পিছনে থেকে বিপক্ষের ১১ জনের শরীরীভাষা পড়ে ফেলেন অবলীলায়। বিপক্ষের ওপেনিং জুটি ১১ ওভারে ৯১ রান তোলার পরেও ভাবলেশহীন ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে থাকেন। 'আপনা টাইম আয়গা' মন্ত্রে বিশ্বাস রাখেন। আর সেই বিশ্বাসই এনে দেয় ফলাফল। নাইটের মিডল অর্ডার যে দীর্ঘদিন চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগছে, তা নিশ্চয়ই নজর এড়ায়নি ৪০ বর্ষীয় অধিনায়কের। কাজেই শুরুর দুটো-তিনটে উইকেট ফেলাই ছিল মূল লক্ষ্য। আস্কিং রেট ইতিমধ্যেই ১২ ছুঁই ছুঁই। একই ওভারে রানা আর আইয়ারকে ফিরিয়ে দিলেন শার্দূল। এর পর নারাইন আউট হতেই ধোনি জানতেন এবার বাজি তার হাতে। ১৯২-এর লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে দুবাই স্টেডিয়ামে বাকি সময়টা যে মাসল পাওয়ার নিয়ে খেলা দরকার, তা নাইটের ড্রেসিংরুমে কই! দলের বিগেস্ট পাওয়ার হিটার সাইডলাইনে বসে খেলা দেখলেন। বাকি ম্যাচে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে স্লোয়ার আর স্পিনে আটকে গেল অবশিষ্ট নাইট ব্যাটিং লাইন-আপ। শেষদিকে ফারগুসন আর মাভি কিছুটা চেষ্টা চালালেন বটে, কিন্তু ততক্ষণে অনেকেই টিভি বন্ধ করে ডিনার টেবিলে বসে পড়েছেন। গোটা ম্যাচ জুড়ে বোলিং চেঞ্জ থেকে ফিল্ডিং প্লেসমেন্ট, প্লেয়ারদের সাথে হাডল থেকে সাজেশন,ধোনির আত্মবিশ্বাসের ছাপ ফুটে উঠল গোটা দলের পারফরম্যান্সে। ১১ না ২১-এর ফাইনাল খেলছেন ধোনি, কে বলবে! শেষ ৭ বলে যখন নাইটের ৩১ রান বাকি, তখন একটা বাজে বলের জন্য শার্দূল ঠাকুরকে বকাবকিও করতে দেখা গেল তাঁকে। অর্থাৎ শেষ বল অবধি বিপক্ষকে 'টেকেন ফর গ্রান্টেড' নেওয়া মানা। ম্যাচে ধোনি যত আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠলেন, ততই যেন মরগ্যানের দুমড়ে যাওয়া ছবিটা পরিষ্কার দেখা গেল। ব্রিটিশদের উপর বাঙালির যে দীর্ঘকালীন ক্ষোভ, তা ফাইনালের রাতে আর একটু উস্কে দিলেন নাইট অধিনায়ক। ব্যাটিং পিচে প্রথমে ফিল্ডিং-এর সিদ্ধান্ত, উইনিং কম্বিনেশন বজায় রাখতে গিয়ে দলে রাসেলকে না রাখা, নিজের ব্যাটিং-এর কুৎসিততম প্রদর্শন, এমন কয়েকটা কারণই তার জন্য যথেষ্ট। ফাইনালে নামার আগে অধিনায়ক নিশ্চয়ই ভুলে গিয়েছিলেন আইপিএলে তাঁদের প্রথম পর্বের চিত্রটা, সব ম্যাচে পরিত্রাতা যে নারাইন আর রাহুল ত্রিপাঠি হবেন না, তিনি বেমালুম ভুলে বসেছিলেন সেকথা।
আরও পড়ুন: IPL 2021 - 'জেতা উচিত ছিল KKR-এর', CSK-কে ট্রফি জেতানোর পর এ কী বললেন ধোনি
আরও পড়ুন: IPL 2021 - 'পোলার্ডকে ফোন করেই বলব', টি২০ ক্রিকেটে বিরাট রেকর্ড CSK-র ব্রাভোর
বিশ্বকাপের আগে চেন্নাইয়ের জয় বিরাটদের মনোবল বাড়াবে। বিশ্বকাপে টিমের মেন্টর ধোনি। শুক্রবার রাতে ট্রফি জিতে আরও একবার প্রমাণ করে দিলেন সঠিক নীতি নির্ধারণে ভারতীয় ক্রিকেটের চাণক্য এখনও একজনই। জাতীয় দলের জার্সি ছাড়লেও জয়ের অভ্যাস ছেড়ে যায়নি তাঁকে। ফেলুদার মতই ক্রিকেটের জিওমেট্রি তাঁর জানা। কোন বল সরলরেখায় আসে, সার্কেলের কোন অংশে ফিল্ডারের হাতে ক্যাচ ওঠে, কোন অধিনায়ক প্যাঁচালো নেতৃত্ব দেবে, এই নিয়ে বিস্তর অভিজ্ঞতা তাঁর। সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে কোহলি (Virat Kohli) তপেশরঞ্জন-এর ভূমিকা পালন করতে পারেন কী না,সেটাই এখন দেখার।