শমিকা মাইতিঃ- এতদিন বলা হত বাংলার ভোটভাগ্য নির্ধারণ করে মুসলিম ভোট। কারণ তাদের ভোট পড়ে এককাট্টা হয়ে। মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক দখলে রাখতে শাসকদল তোষণের রাজনীতি করত তাই। বিজেপির সৌজন্যে সেই ছবিটাই বদলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। বিজেপি মনে করে, জয়লাভের জন্য মুসলিম নয়, হিন্দু ভোটকে এককাট্টা করতে হবে। কারণ তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের ফল বিচার করলে বোঝা যাবে বিজেপির এই স্ট্র্যাটেজি কাজ করছে বাংলায়। তাই ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে হিন্দু ভোটকে পাখির চোখ করেছে যুযুধান প্রতিপক্ষ তৃণমূলও। মাথার ওড়না ছেড়ে মন্দিরের পর মন্দিরে পুজো দিচ্ছেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন, 'তপনকে ক্ষমা করে দিয়ে ভোটটা দেবেন তো' জনসভায় এসে চরম শঙ্কায় মমতা
পশ্চিমবঙ্গে মোট ভোটারের ৭১ শতাংশ হিন্দু। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হল, ২৯৪টা বিধানসভা আসনের মধ্যে ১৪৫টিতে ৮০ শতাংশের উপর ভোটার হিন্দু। অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার জন্য যত আসন দরকার, তার চেয়ে মাত্র তিনটে কমে বাকি আসনে হিন্দু ভোটাররা ভাগ্য নির্ধারক। তাই মুসলিম ভোটের মতো হিন্দু ভোটও যাতে এককাট্টা হয় তার চেষ্টা করছে বিজেপি। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে এই ১৪৫টা আসনের মধ্যে ৯২টিতে এগিয়েছিল বিজেপি, যেখানে মাত্র ৫৩টাতে এগিয়েছিল তৃণমূল। আর একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাচ্ছে সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে যেমন, মালদা (৭৯%), উত্তর দিনাজপুর (৭৬%), দার্জিলিং (৭৯%), কোচবিহার (৬৫%), দক্ষিণ দিনাজপুর ও নদিয়ায় (৬৩%) বিজেপি হিন্দুভোট বেশি পেয়েছে। সেই তুলনায় কলকাতা (৪৬%), পূর্ব মেদিনীপুর (৪৮%), হাওড়া ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা (৫১%), পশ্চিম মেদিনীপুর ও মুর্শিদাবাদে (৫০%) বিজেপির ভোটশেয়ার কম ছিল। এবাররে ভোটে দক্ষিণের এই সব এলাকাগুলিতে ভোটশেয়ার বাড়ানোর চেষ্টা করছে বিজেপি, যাতে মোট হিন্দু ভোটের ৬০ শতাংশের বেশি তাদের ঝুলিতে আসে।
আরও পড়ুন, ISF কতটা প্রভাব ফেলবে খানাকুলে, তার উপরেই নির্ভর করবে ২১-র ফলাফল
এই প্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে হিন্দু তফসিলি জাতি-উপজাতিদের ভোটও। পশ্চিমবঙ্গে মোট জনসংখ্যার ২৩% তফসিলি উপজাতি। রাজবংশী, মতুয়া আর বাউরিদের সমর্থন বিজেপির দিকে রয়েছে। চা বাগান ও জঙ্গলমহলের দলিতরাও বিজেপিকে পছন্দ করছে। হিন্দু ভোটশেয়ার বাড়ানোর জন্য রাজবংশী, নমঃশূদ্র ও চা-বাগানের শ্রমিকদের ভোট টানার চেষ্টা করছে বিজেপি।বিশেষ করে রাজবংশী ভোটের পুরোটাই চাইছে তারা। সাংসদ নিশীথ প্রামাণিককে দিনহাটা বিধানসভা কেন্দ্র থেকে ফের দাঁড় করানো হয়েছে এই উদ্দেশ্যে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ঘোষণা করেছেন, প্যারামিলিটারি বাহিনীতে নারায়ণী আর্মি ব্যাটেলিয়ন তৈরি করা হবে যেখানে রাজবংশী যুবকদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। একই কারণে মতুয়া ভোট এককাট্টা করার চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশের উদ্বাস্তু মতুয়াদের নাগরিকত্ব দেওয়ার আশ্বাস দিচ্ছে বিজেপি। ৫০তম স্বাধীনতা বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশে গিয়ে মতুয়াদের তীর্থক্ষেত্র ওড়াকান্দি পরিদর্শন করে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
আরও পড়ুন, 'বহিরাগতের হাতে হামলা-শ্লীলতাহানি', প্রতিবাদ সভার ডাক বাংলাপক্ষের, কাঠগড়ায় CAB
অন্য দিকে, মমতা কিছুটা চোখে আঙুল দেখিয়েই মুসলিম তোষণ করেছেন এতদিন। রাজ্যের ২৭ শতাংশ মুসলিম ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তাঁর ঝুলিতে যাবে এবারও। কিন্তু সেই ভোটের উপর ভরসা করে বসে থাকলে যে আর চলবে না, তা বিলক্ষণ বুঝেছেন মমতা। হিন্দু ভোট টানার জন্য তাই নিজের ইমেজ পরিবর্তন করছেন মমতা। মন্দিরে-মন্দিরে পুজো দিচ্ছেন। মাথার উপরে চিরাচরিত ওড়নাটা আজকাল দেখা যাচ্ছে না। হিন্দু ভোট টানার ক্ষেত্রে তফসিলি জাতি-উপজাতিদের ভোটব্যাঙ্কের উপরও অনেকটা ভরসা করছেন মমতা। রাজ্যে ৬৮টি বিধানসভা কেন্দ্রের আসন তফসিলি উপজাতির জন্য সংরক্ষিত হলেও এই ক্যাটেগরিতে তৃণমূলের প্রার্থী ৭৯ জন।
১৭ মার্চ তৃণমূল যে নির্বাচনী ইস্তাহার প্রকাশ করেছে, তাতে ন্যূনতম আয় সুনিশ্চিত প্রকল্পে জেনারেল ক্যাটেগরির মহিলাদের হাতে যেখানে মাসে ৫০০ টাকা ভাতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, সেখানে তফসিলি জাতি-উপজাতি এবং দলিত মহিলাদের ১০০০ টাকা করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। মাহাতোদের এসসি ক্যাটেগরিতে ঢোকানোর জন্য কেন্দ্রে চিঠি পাঠিয়েছেন মমতা। রাজ্য পুলিশে আলাদা করে নারায়ণী ব্যাটেলিয়ন, গোর্খা ব্যাটেলিয়ন ও জঙ্গলমহল ব্যাটেলিয়ন গড়ার ঘোষণা করেছেন, যেখানে সংশ্লিষ্ট এলাকার যুবকেরা কাজে অগ্রাধিকার পাবেন। জমির অধিকার দেওয়া হচ্ছে মতুয়াদের। মতুয়াদের উন্নয়নে বোর্ড গড়তে ১০ কোটি টাকার ফান্ড গড়েছেন মমতা। নমঃশূদ্রদের উন্নয়নেও ৫ কোটি টাকার একটা ফান্ড তৈরি করা হয়েছে। গোর্খা ভোটের জন্য ইতিমধ্যে বিমল গুরুংকে দলে টেনেছে তৃণমূল। এই ভাবে যুযুধান দু’পক্ষই নিজেদের মতো করে হিন্দু ভোট টানার চেষ্টা করে যাচ্ছে। ২ মে জানা যাবে, কাদের চেষ্টা ফলপ্রসূ হল শেষমেশ।
আরও দেখুন, নিজের আখের গোছাতে সিঙ্গুরকে ব্যবহার, মমতা-র দিকে আঙুল তুললেন লকেট