চিকিৎসা করানোর সামর্থ নেই, ৫ বছর ধরে গাছে বাঁধা মানসিক ভারসাম্যহীন যুবক

২০১৭ সালে বন্যায় সর্বস্বান্ত হলেও মেলেনি সরকারি সাহায্য। আবাস যোজনায় নাম তোলার আবেদন করতে গেলেও মুখ ফিরিয়েছে পঞ্চায়েত সদস্য থেকে প্রশাসনের আধিকারিকরা। এই পরিস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তির আবেদন জানিয়েছেন যুবকের পরিবার।

 প্রায় ৫ বছর ধরে বাড়ির সামনে গাছের সঙ্গে শেকল দিয়ে বাঁধা রয়েছেন যুবক। শেকল বাঁধা থাকার ফলে পায়ে ঘা হয়ে গিয়েছে। মালদহর হরিশ্চন্দ্রপুর ২ নম্বর ব্লক এলাকার ভালুকা গ্রাম পঞ্চায়েতের একবালপুর গ্রামের ঘটনা। 

Latest Videos

 

পরিবারের দাবি, যুবক মানসিক ভারসাম্যহীন। ওঝা গুনি থেকে শুরু করে চিকিৎসক সকলের কাছেই ছুটতে ছুটতে আজ আর পরিবারের কিছু করার নেই। নিয়মিত রোজকার অন্ন জোগার করাই এখন দায় হয়ে গিয়েছে। ঘরের বাইরে ওই যুবককে শেকল বেঁধে রাখা ছাড়া কোনও উপায় নেই। শাসকদলের গ্রাম-পঞ্চায়েতের দ্বারস্থ হয়ে, প্রধান, মেম্বারের হাতে পায়ে ধরেও ফল হয়নি। বিধায়ক, জেলা পরিষদ সদস্যকে বহুবার বলার পরেও ঘুরে তাকাননি কোনও জনপ্রতিনিধি। তৈরি হয়নি যুবকের প্রতিবন্ধী সার্টিফিকেটও। চিকিৎসার ব্যবস্থা তো দূর অস্ত সরকারি রেশনটুকুও যথাযথ পায় না পরিবার। ২০১৭ সালে বন্যায় সর্বস্বান্ত হলেও মেলেনি সরকারি সাহায্য। আবাস যোজনায় নাম তোলার আবেদন করতে গেলেও মুখ ফিরিয়েছে পঞ্চায়েত সদস্য থেকে প্রশাসনের আধিকারিকরা। 

"

এই পরিস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তির আবেদন জানিয়েছেন যুবকের পরিবার। মানসিক ভারসাম্যহীন যুবকের নাম সেলিম আকতার (১৯)। জরাজীর্ণ মাটির বাড়ির সামনে একটা গাছে শেকল বাঁধা। দিনের পর দিন। বছরের পর বছর। বৃষ্টি হলে মাথা গোঁজার ঠাঁই মেলে ঘরের দাওয়ায়, না হলে গাছের নীচই তাঁর ঠিকানা। শেকল ক্রমশ শরীরে চেপে বসে তৈরি করেছে দগদগে ঘা। ধুলো ময়লা, আবর্জনা, মাছি বিষাক্ত করে তুলেছে সেই ঘা। বিষ ছড়িয়ে পড়ছে গোটা শরীরে। সেলিমের দাদা হারুণ রশীদ এবং মা লাইলি বিবিও মানসিক ভারসাম্যহীন। ঘর ছাড়া তাঁরা। গ্রামের লোকজন কখনও তাঁদের দেখতে পান কখনও পান না। ছোটো ভাই আসিফ সুস্থ। বাবা জাকির হোসেন আর দাদু আবদুল হক দিনমজুর। তা দিয়েই কোনওরকমে চলে সংসার। এখন করোনার জেরে বন্ধ কাজ। রোজগারও প্রায় নেই বললেই চলে। রেশন কার্ড মাত্র একজনের নামেই রয়েছে। তাও জাকিরের দাদার নামে। সেই রেশন তুলে এনে ভাগাভাগি করেই চলে সংসার। রেশন কার্ড করার জন্যে বহুবার দরবার করেও ফল হয়নি। কষ্ট করে যে ঘর তৈরি করেছিল জাকির তাও গত ২০১৭ সালের বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে। কোনক্রমে ধার দেনা করে মাটির চালাঘর করেই দিন গুজরান।

এই অবস্থায় সেলিমকে চিকিৎসা করার সামর্থ্য কোথায়। জাকির ও তাঁর বাবার অভিযোগ, পঞ্চায়েত সদস্য, প্রধান, বিধায়ক, জেলা পরিষদ সদস্য, এলাকার শাসক দলের নেতাদের পায়ে ধরে কান্নাকাটি করেও কোনও ফল হয়নি। কেউ মুখ তুলে তাকায়নি। বন্যার সময়েও মেলেনি সরকারি সাহায্য। জোটেনি সামান্য ত্রিপলটাও। পরবর্তীতে আবাস যোজনার জন্যে নাম তোলাতে গেলে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁদের। সেলিমের প্রতিবন্ধী সার্টিফিকেট তৈরির জন্যে বহুবার দরবার করেও লাভ হয়নি। কোনও সরকারি মানসিক চিকিৎসালয়ে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্যে বলতে গিয়ে একরকম ঘাড় ধাক্কাই খেতে হয়েছে। দুর্বিষহ যন্ত্রণার মধ্যে যখন এই পরিবার তখন অন্যদিকে তাঁদের নিয়ে তরজায় মাঠে নেমে পড়েছে দুই যুযুধান রাজনৈতিক দল, তৃণমূল আর বিজেপি। 

 

বিজেপির অভিযোগ, তৃণমূল আসলে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি। গরীবের খোঁজ ওরা রাখে না। কাটমানির সরকার। অন্যদিকে পাল্টা অভিযোগ তুলে তৃণমূলের বক্তব্য, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে গরীবের স্বার্থের সরকার। তাই দলগত ভাবেই ওই পরিবারের পাশে সব রকমভাবে পাশে থাকার আশ্বাস তৃণমূল জেলা সাধারণ সম্পাদক জম্বু রহমানের।

যুবকের বাবা জাকির হোসেন বলেন, “ছেলে প্রায় সাত বছর ধরে মানসিক ভারসাম্যহীন। তাই ওকে বেঁধে রেখেছি। ওকে মালদহ, বহরমপুর, শিলিগুড়ি, সব জায়গায় চিকিৎসা করিয়েছি। ওর চিকিৎসার জন্য দু’কাঠা জমি বিক্রি করেছি। ঠিক করতে পরিনি। এদিকে খোলা রাখলেই বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। এর আগে ওকে আগ্রা, উত্তরপ্রদেশ, মুম্বই, ঝাড়খণ্ড, হিমাচল সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে খুঁজে নিয়ে এসেছি। ওর চিকিৎসার জন্য সব জায়গায় গিয়েছি। পঞ্চায়েত সদস্য, প্রধানের পা ধরেছি। কোনও সাহায্য পাইনি। ছেলের প্রতিবন্ধী কার্ড, স্বাস্থ্যসাথী কার্ড, রেশন কার্ড, কিছুই নেই। আমাদের পরিবারে সাতজন সদস্য। রেশন কার্ড নেই। কীভাবে ছেলের চিকিৎসা করাব?”

নাতির কথা বলতে বলতে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন আবদুল হক। বলেন, “প্রায় পাঁচ বছর ধরে নাতিকে শিকলে বেঁধে রেখেছি। ছোটতেই ওর পাগলামো শুরু হয়ে যায়। অনেক জায়গায় চিকিৎসা হয়েছে। ঠিক হয়নি। এদিকে খোলা রাখলেই বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। শিকলে বাঁধা থাকতে থাকতে ওর হাত-পায়ে ঘা হয়ে গিয়েছে। সবার কাছে গিয়েছি। সাহায্য পাইনি। তবে বিডিওর কাছে এখনও যাইনি। আমরা ওকে সুস্থ করতে চাই। তার সঙ্গে যাতে আমরা সরকারি সাহায্য পাই, তার আবেদন জানাচ্ছি।”

সেলিমকে নিয়ে এই মুহূর্তে হরিশ্চন্দ্রপুরে তুঙ্গে উঠেছে রাজনৈতিক চাপানউতোর। বিজেপির জেলা সম্পাদক কিষান কেডিয়া বলছেন, “ভালুকা গ্রাম পঞ্চায়েত, হরিশ্চন্দ্রপুর ২ নম্বর পঞ্চায়েত সমিতি তৃণমূলের। এলাকার বিধায়ক, এমনকি রাজ্য সরকারও তৃণমূলের। অথচ প্রশাসন চুপ করে বসে রয়েছে। ওই গ্রামে কি প্রশাসনের কেউ কখনও যায় না? তাদের কি ওই যুবককে চোখে পড়েনি? এটা কি তৃণমূলের সরকার? নাকি তোলাবাজির? পরিবারের সদস্যরা কোনও সাহায্য না পেয়ে ওই যুবককে গাছে শিকলবন্দী করে রাখতে বাধ্য হয়েছেন। ওই যুবকের কিংবা তাঁর পরিবারের কিছুই নেই। প্রশাসনের তরফে যুবকটির চিকিৎসার ব্যবস্থা হলে হয়তো তিনি এতদিনে সুস্থ হয়ে যেতেন। আবার এই সরকার নিজেদের গরিবের সরকার বলে দাবি করে।”

তৃণমূলের জেলা সম্পাদক জম্মু রহমান নাকি সংবাদমাধ্যমের কাছেই সেলিমের খবর জানতে পারলেন। তিনি বলেন, “এই খবর আপনাদের মুখেই জানতে পারলাম। আমরা ওই পরিবারের কাছে যাব। প্রধানকেও বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে বলব। মুখ্যমন্ত্রী গরিবদের জন্য নানা ব্যবস্থা করেছেন। ওই পরিবার সেসব সরকারি সাহায্য কেন পায়নি তা প্রধানের কাছে জানতে চাওয়া হবে। ওই পরিবার এবং অসুস্থ যুবকটির জন্য আমরা সব ব্যবস্থা নেব। সম্প্রতি দুয়ারে সরকার প্রকল্পে সবার স্বাস্থ্যসাথী কার্ড করে দেওয়া হয়েছে। এই পরিবারের কেন তা হয়নি তাও খোঁজ নিয়ে দেখা হবে। আমি কথা দিচ্ছি, তৃণমূল ওই যুবক ও তাঁর পরিবারের পাশে থাকবে।”

Share this article
click me!

Latest Videos

'একত্রিত হতে হবেই, ওরা ৫০ পেরলেই শরিয়া আইন চালু করবে' গর্জে উঠলেন শুভেন্দু | Suvendu Adhikari | News
'Mamata Banerjee-র জন্যই অভয়ার এই অবস্থা' বলতে গিয়ে এ কী বললেন Suvendu Adhikari, দেখুন
শুভেন্দুর বিরাট ঘোষণা! সোনাচূড়ার আড়াই বিঘা জমিতে হবে বিশাল Ram Mandir | Suvendu Adhikari
'সনাতনী সম্মেলন'-এ Suvendu Adhikari-র বিশেষ বার্তা, দেখুন সরাসরি
‘RG Kar-র তথ্য প্রমাণ Mamata Banerjee-র নির্দেশে লোপাট হয়েছে’ বিস্ফোরক Adhir Ranjan Chowdhury