দীর্ঘদিন ধরে স্কুলে আসছিল না নবম শ্রেণির দুই ছাত্রী। দরিদ্র পরিবারের দুই পড়ুয়ার পড়াশোনায় দাঁড়ি টানার সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিলেন বাড়ির লোকরা। দিন আনা দিন খাওয়া পরিবারে মেয়েদের পড়াশোনাটা এখনও অকারণ খরচ বলেই মনে হয়। তাই স্কুলে না পাঠিয়ে রিংকি দাস ও সম্বরী মান্ডিকে সংসারের কাজেই লাগাতে শুরু তাদের পরিবার।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হারিয়ে যায় রিংকি, সম্বরীরা। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রায় তিন মাস পরে স্কুলে প্রত্যাবর্তন ঘটেছে তাদের। কারণ নবম শ্রেণির দুই ছাত্রী যে স্কুলে আসা বন্ধ করে দিয়েছে, তা চোখে পড়েছিল স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার। আর তাঁর থেকেই এ খবর পেয়ে রিংকি, সম্বরীদের বাড়ির লোককে বুঝিয়ে মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে রাজি করিয়েছেন পূর্ণিমা লাঙল নামে এক আশা কর্মী।
হুগলির সেকেন্দারপুরের বাসিন্দা রিঙ্কি এবং সম্বরী দাদপুর থানার মহেশ্বরপুর হাইস্কুলের নবম শ্রেণির পড়ুয়া। কিন্তু মাস তিনেক আগে থেকে আচমকাই স্কুলে আসা বন্ধ করে দেয় তারা। বিষয়টি নজরে পড়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা সোমা চৌধুরীর। তিনি খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, দুই ছাত্রীর পরিবারেই প্রবল আর্থিক অনটন রয়েছে। রিঙ্কি দাসের বাবা নেই। মা দিন মজুর হিসেবে কাজ করে কোনওক্রমে সংসার চালান। আর সম্বরীর বাবা, মা কেউই নেই। দিদিমার কাছে মামাবাড়িতে মানুষ সে। দুই ছাত্রীর বাড়ি থেকেই তাই আর পড়াশোনা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার আগ্রহ ছিল না।
আরও পড়ুন- পড়াশোনার চাপে ছাত্রের আত্মহত্যা, সেন্ট স্টিফেন্স স্কুলে বিক্ষোভ
আরও পড়ুন- আবেগহারা সাউথ পয়েন্ট, ১২,০০০ ছাত্র-ছাত্রীর স্বাক্ষর পৌঁছবে অভিজিৎ-এর কাছে
দুই ছাত্রীকে স্কুলে ফেরাতে মরিয়া প্রধান শিক্ষিকা। স্কুলের তরফে স্থানীয় স্বাস্থ্য দফতরের সাহায্য নেওয়া হয়। দুই ছাত্রীর কথা শুনে এগিয়ে আসেন ওই অঞ্চলেরই বাসিন্দা পূর্ণিমা লাঙল নামে এক আশা কর্মী। তাঁর কাজের মধ্যে না পড়লেও বার বার ওই দুই ছাত্রীর বাড়িতে যান তিনি। অভিভাবকদের বোঝাতে শুরু করেন তিনি। এ ভাবে প্রায় তিন মাসের চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত ফের মঙ্গলবার থেকে স্কুলে আসতে শুরু করেছে ওই দুই পড়ুয়া। দুই ছাত্রীর স্কুলে প্রত্যাবর্তনে সোমাদেবী এবং পূর্ণিমাদেবী যেমন খুশি, তেমনই খুশি রিঙ্কি এবং সম্বরীর সহপাঠীরাও।
প্রধান শিক্ষিকা সোমা চৌধুরী বলেছেন ,ওই দুই ছাত্রীর স্কুলের পোশাক এবং বই খাতার ব্যবস্থা তিনি নিজে করে দেবেন। তাদের যাতে অন্য কোনও অসুবিধা না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখা হবে। দুই ছাত্রীকে তিনি বলেন, 'তোমাদেরও প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে কোনও অবস্থাতেই পড়াশোনা ছাড়বে না। ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়েছো, মাধ্যমিকটা অবশ্যই দেও। দেখবে এর পর সব ঠিক হয়ে যাবে। সরকার তোমাদের জন্য অনেক প্রকল্প চালু করেছে, কোনও অসুবিধা হবে না।' মঙ্গলবারই স্কুলে একটি ডাইনিং হলের উদ্বোধনে আসেন স্থানীয় বিধায়ক এবং মন্ত্রী অসীমা পাত্র। তিনিও আশা কর্মী পূর্ণিমাদেবী এবং স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার উদ্যোগের প্রশংসা করেন।
স্কুলে ফিরতে পেরে খুশি দুই ছাত্রীও। কিন্তু কতদিন তারা পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবে, তা নিয়ে যেন এখনও কিছুটা সংশয়ে রিঙ্কি আর সম্বরী। রিঙ্কি বলে, 'মায়ের খুব শরীর খারাপ ছিল বলে টাকা ছিল না। তাই স্কুলে আসতে পারিনি। দিদিমণি গিয়ে ফিরিয়ে এনেছেন। এবার থেকে স্কুলেও আসব, পড়াশোনাও করব।' আর সম্বরী বলে, 'পাঁচ বছর বয়সে বাবা- মা মারা গিয়েছেন। বাড়িতে শুধু দিদা রয়েছেন, তিনিও বয়সের কারণে কাজ করতে পারেন না। পড়াশোনার খরচ দেওয়ার কেউ নেই বলেই স্কুলে আসা বন্ধ করেছিলাম। দিদিমণিই বললেন যে পড়াশোনার খরচ স্কুল থেকেই দেবে, তাই আবার ফিরেছি।' রিঙ্কির মা বিমলা দাস বলেন, 'আমার স্বামী অনেক দিন আগে আমাকে ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছেন। আমাকে তাই মাঠে কাজ করে সংসার চালাতে হয়। আমার শরীর খারাপ ছিল, তাই কয়েকমাস মেয়েকে স্কুলে পাঠাইনি। তাহলে বাড়ির কাজ কে করবে? আমাদের ওসব করলে চলে? দিদিমণিরা গিয়ে বোঝালেন যে মেয়েকে পড়াতে পারলে ভবিষ্যতে অনেক সুবিধে। তাই অনিচ্ছা স্বত্বেও ওদের স্কুলে পাঠিয়েছি।'