
Role Kaku Pathikrit Saha: কলকাতায় তখন সদ্য মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে খাবার অর্ডার দিয়ে বাড়িতে বসেই পছন্দমতো খাবার পাওয়ার সুবিধা চালু হয়েছে। অনেকেই মজা করে খাবার অর্ডার দিতেন কিন্তু সেই খাবার নিতেন না। যাঁরা সেই খাবার পৌঁছে দিতে যেতেন, তাঁরা হয় সংশ্লিষ্ট রেস্তোরাঁ বা দোকানে খাবার ফেরত দিতেন, না হলে নিজেদের কাছে রেখে দিতেন। অন্য পথে হাঁটলেন এক যুবক। নাম পথিকৃৎ সাহা। নাম সার্থক। তিনি অন্যদের পথ দেখালেন। যে খাবার কেউ নিত না, সেই খাবার নিজে না রেখে কলকাতার কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলে পথশিশুদের দিতে শুরু করলেন এই যুবক। খাবার বলতে থাকত মূলত রোল। সেই থেকে শিশুদের মধ্যে তাঁর নাম হয়ে গেল 'রোলকাকু'। সেই থেকে সমাজের জন্য কিছু কাজ করা শুরু। তখনও পথিকৃৎ ভাবতে পারেননি, তাঁর আরও অনেক কাজ বাকি। ধীরে ধীরে শুরু হল বৃহত্তর কর্মকাণ্ড।
সময়টা ২০১৩। দমদম ক্যান্টমেন্ট স্টেশনে অনেক শিশু ভিক্ষা করত। তার মধ্যে একজনের নাম ছিল বুধো। সে একদিন পথিকৃতের কাছ থেকে ভিক্ষা চাইছিল। পথিকৃৎ এড়িয়ে যেতে চাইলেও, বুধো ছাড়ছিল না। তখন রেগে গিয়ে তাকে চড় মারেন এই যুবক। পরে তাঁর অনুশোচনা হয়। বুধোকে খুঁজে বের করে কাছে ডাকেন। আদর করে খেতে দেন। জানতে পারেন, বুধোর মা তাকে জোর করে ভিক্ষা করতে পাঠায়। ভিক্ষা করে টাকা নিয়ে না যেতে পারলে মারে। পথিকৃৎ ঠিক করলেন, বুধোকে পড়াবেন। দমদম ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনের প্ল্যাটফর্মেই শুরু হল পড়া। বুধোকে পথিকৃৎ বললেন, 'তোর বন্ধুদের নিয়ে আয়।' আরও কয়েকজন জুটে গেল। স্টেশনে আসা লোকজনের চোখে পড়ে গেলেন পথিকৃৎ। কেউ কেউ সাহায্য করতে শুরু করলেন। 'রোলকাকু' হয়ে গেলেন শিক্ষক।
দমদম ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে পড়ানো শুরু করলেও, সমস্যায় পড়লেন পথিকৃৎ। কারণ, স্টেশনে সবসময়ই লোকজনের আনাগোনা, চিৎকার, কৌতূহলী জনতার নানা প্রশ্ন। স্টেশনের কাছেই অটোরিকশা ইউনিয়নের ঘর পেলেন। সেখানে শুরু হল পড়ানো। ধীরে ধীরে পড়ুয়ার সংখ্যা বাড়তে লাগল। এর মধ্যে খাবার ডেলিভারি দেওয়ার চাকরি ছেড়ে অন্য এক চাকরিতে যোগ দেন পথিকৃৎ। কিন্তু সেই চাকরি করতে গিয়ে বাচ্চাদের পড়ানোর ক্ষেত্রে সমস্যা হওয়ায় চাকরি ছেড়ে দেন। এখন মোটর সাইকেলে লোকজনকে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করেন পথিকৃৎ। একইসঙ্গে চলছে বাচ্চাদের পড়ানো।
৪০০-এর বেশি শিশুর দায়িত্ব নিয়েছেন পথিকৃৎ
অটোরিকশা ইউনিয়নের ঘর ছেড়ে এখন নিজস্ব ঘরে বাচ্চাদের পড়াচ্ছেন পথিকৃৎ। এছাড়া সুন্দরবন ও বেলপাহাড়ির একাধিক জায়গায় বাচ্চাদের পড়ানোর ব্যবস্থা করেছেন। কয়েকজনকে পাশে পেয়েছেন এই যুবক। তাঁরাও বাচ্চাদের পড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছেন। বাচ্চাদের শুধু পড়ানোই নয়, নিয়মিত খেতে দেওয়া, গান, আবৃত্তি শেখানো, ক্যারাটেতেও উৎসাহ দিচ্ছেন পথিকৃৎ। তাঁর উৎসাহে একাধিক বাচ্চা ক্যারাটে প্রতিযোগিতায় পুরস্কারও পেয়েছে। বাচ্চাদের নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতেও যান পথিকৃৎ। একবার নাগেরবাজারে এক শপিং মলে বাচ্চাদের নিয়ে ঢুকতে গিয়ে বাধা পেয়েছিলেন। ছেঁড়া পোশাক পরা বাচ্চাদের ঢুকতে দেননি নিরাপত্তারক্ষীরা। সেই অপমান বুকে নিয়ে সব বাচ্চাকে বড় করে তোলার জন্য নতুন করে শপথ নিয়েছেন পথিকৃৎ।
আরও স্বপ্ন দেখছেন পথিকৃৎ
পথিকৃৎ জানিয়েছেন, ‘আমার নাম পথিকৃৎ। আমার নাম সার্থক করার জন্য সবার আগে বাচ্চাদের জন্য এই কাজ শুরু করেছি। আমার কাছে যে বাচ্চারা পড়তে আসে, ওরা সবার জীবনেই নানা সমস্যা আছে। কারও বাবা মদ খেয়ে এসে মারে, কারও মা জোর করে ভিক্ষা করতে পাঠায়। এই বাচ্চারা যাতে সুস্থভাবে বাঁচতে পারে, সেটাই আমার লক্ষ্য। শুধু কলকাতা নয়, সারা বাংলাতেই আমি এই কাজ করতে চাই। আমার স্বপ্ন, সারা বাংলায় আমার গাড়ি ঘুরবে। সেই গাড়ি থেকে বাচ্চাদের পুষ্টিকর রোল খেতে দেওয়া হবে। রোলকাকুর এটাই স্বপ্ন। সব বাচ্চা পুষ্টিকর খাবার, শিক্ষা পাক।’ পথিকৃতের এই কর্মকাণ্ড দেখে খুশি হয়ে অনেকেই তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন। জন্মদিন বা অন্যান্য বিশেষ দিনে পথিকৃতের শিক্ষাকেন্দ্রে এসে অনেকেই বাচ্চাদের মুখে খাবার তুলে দেন। তবে এতগুলি কেন্দ্র চালাতে গিয়ে প্রতি মাসেই পথিকৃৎকে সমস্যায় পড়তে হয়। নিজের সংসারের কীভাবে চালাবেন, তা ভেবে পান না। তা সত্ত্বেও যে দায়িত্ব নিয়েছেন, তা থেকে সরে আসতে নারাজ পথিকৃৎ। আরও অনেক শিশুকে সুস্থভাবে বাঁচাতে শেখানোই তাঁর লক্ষ্য।
আরও খবরের আপডেট পেতে চোখ রাখুন আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেলে, ক্লিক করুন এখানে।