দিল্লি থেকে হরিশ্চন্দ্রপুর। না কোনও ট্রেনে এই সফর নয়। একদল পরিযায়ী শ্রমিক অটো আর ওলা-উবার-এ চেপে হাজার-হাজার কিলোমিটার রাস্তা পার করেছেন। আর ২ দিন ধরে টানা গাড়ি ছুটিয়ে তারা প্রবেশ করেছেন হরিশ্চন্দ্রপুরে। হ্যাঁ, ঠিক-ই পড়ছেন হরিশ্চন্দ্রপুর। যে স্থানের নাম গত কয়েকদিন ধরে শিরোনামে। কারণ এখানেই মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় ১০ জন কোভিড ১৯ রোগীকে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর এই ১০ জনই পরিযায়ী শ্রমিক। অটো ছুটিয়ে দিল্লি থেকে হরিশ্চন্দ্রপুরের এই দুঃসাহসিক যাত্রা স্বাভাবিকভাবেই এখন আলোচনায়।
আরও পড়ুন- আতঙ্ক বাড়িয়ে মালদহে বাড়ল কনটেইনমেন্ট জোনের সংখ্যা, ৪৮ ঘণ্টায় আক্রান্ত ১১
দিল্লি থেকে হরিশ্চন্দ্রপুরের দূরত্ব প্রায় ১৫০০ কিলোমিটার। গুগল ম্যাপ বলছে এএইচ২ ধরে এনএইচ২৭ ধরে হরিশ্চন্দ্রপুর পৌঁছতে সময় লাগার কথা ২৭ ঘণ্টা। আর এই সফরের পুরোটাই উত্তর প্রদেশের ভিতর দিয়ে বিহারের বুক চিরে পাটনা দিয়ে কিষাণগঞ্জ দিয়ে হরিশ্চন্দ্রপুর-এ ঢোকা সম্ভব। হরিশ্চন্দ্রপুর এক্কেবারে বিহার লাগোয়া হওয়ায় এই সুবিধেটা রয়েছে। কিন্তু তা বলে অটো ছুটিয়ে! যে অটো সাধারণত স্বল্প দৈর্ঘের যাত্রা করার জন্য সক্ষম, সেই অটোতে চেপে দিল্লি থেকে হরিশ্চন্দ্রপুরের এই যাত্রা অবাক করেছে সকলকে। আর সেই সঙ্গে বাড়িয়ে দিয়েছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আতঙ্ক।
আরও পড়ুন- মালদহে ৪৮ ঘণ্টায় আক্রান্ত ১০, উত্তর দিনাজপুরে ৩, মোট আক্রান্ত ১৩
রবিবার সকাল থেকেই হরিশ্চন্দ্রপুর বাস স্ট্যান্ড লাগোয়া বিভিন্ন স্থানে দুইটি অটো এবং চারটি অ্যাপ-ক্যাব-কে পার্ক করে রাখা হয়েছিল। দুইটি অটোতেই দিল্লির নম্বর। আর অ্যাপ-ক্যাবগুলোর মধ্যে দুইটি-তে হরিয়াণার নম্বর প্লেট এবং বাকি দুটিতে দিল্লির নম্বর প্লেট লাগানো। কিছুক্ষণের মধ্যে খোঁজ মেলে দুজনের। যাদের মধ্যে একজন অটো চালিয়ে এবং অন্যজন একটি ক্যাব চালিয়ে দিল্লি থেকে হরিশ্চন্দ্রপুরে পৌঁছেছেন। কথা প্রসঙ্গেই দুই জনেই জানান তাঁরা হরিশ্চন্দ্রপুর এক নম্বর ব্লকের অধীনে থাকা কয়েকটি গ্রামের মানুষ। দিল্লিতে অটো এবং ক্যাব চালান।
শেখ মণিরুল নামে এক অটোচালক জানান, লকডাউনের পর থেকেই দিল্লি-তে রুটি-রুজি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। প্রায় অর্ধাহারেই দিন কাটাতে হচ্ছিল তাঁদের। হরিশ্চন্দ্রপুরে থাকা পরিবার ব্যাঙ্কের মাধ্যমে টাকা পাঠালেও তা শেষ হয়ে যায়। এরপর হরিশ্চন্দ্রপুরের বাড়িতে ফেরা ছাড়়া আর কোনও রাস্তা ছিল না। শ্রমিক ট্রেন চালু হলেও তাতে আদৌ জায়গা পাওয়া যাবে কি না- এই সব চিন্তায় অটো চালিয়ে তিনি দিল্লি থেকে হরিশ্চন্দ্রপুরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। আর অটো-তে তাঁর পরিবারের বাকি সদস্যদেরও তুলে নেন। হরিশ্চন্দ্রপুরের আরও কিছু মানুষজন ছিলেন যারা সেখানে অটো এবং ক্যাব চালান। তাঁরাও মণিরুলের সঙ্গে অটো ও ক্যাব নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। অটোগুলি এবং ক্যাবগুলি মিলিয়ে অন্তত ৩০ থেকে ৩৫ জন সওয়ারি ছিল।
আরও পড়ুন- মালদহে রেশন 'পাচারের চেষ্টা' বানচাল, পিকঅ্যাপ ভ্যানে মিলল চাল ও আটা
মনোহর হুসেন নামে আরও এক চালক জানান, তিনি ক্যাব নিয়ে হরিশ্চন্দ্রপুরে এসেছেন। লকডাউন এবং রোজগারহীনতায় এছাড়া আর কোনও রাস্তা খোলা ছিল না বলে তিনি দাবি করেন। কিন্তু, এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে প্রবেশ করতে নাকা-চেকিং-এ অনুমতি পত্র দেখাতে হচ্ছে। এরপর স্ক্রিনিং হচ্ছে। তারপরে মিলছে নতুন করে এগোনোর অনুমতি। শেখ মণিরুল ও মনোহর হুসেন দুজনেই জানান, তাঁদের কাছে কোনও অনুমতি ছিল না। যেখানে যেখানে নাকা-চেকিং-এর সামনে পড়েছেন সেখানে পুলিশ-কে অনুরোধ করেছেন। তাদের আর্জি শুনে পুলিশ ছেড়েও দিয়েছে। শেখ মণিরুল জানান, কয়েকটি নাকা-চেকিং-এ তাঁদের থার্মাল থার্মোমিটারে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ে হরিশ্চন্দ্রপুরের বাড়ির ঠিকানাও নেওয়া হয় এবং হাতে সিল মেরে দেওয়া হয়। কিন্তু, বিহারে ঢুকে সেভাবে কোনও নাকা-চেকিং-এর সামনে পড়তে হয়নি। যার ফলে হরিশ্চন্দ্রপুরে প্রবেশে খুব একটা বাধার সম্মুখিন হতে হয়নি। এমনকী হরিশ্চন্দ্রপুরে প্রবেশের পথে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশেরও কোনও নাকা চেকিং ছিল না বলে দাবি করেছেন শেখ মণিরুল ও মনোহর হুসেন।
বিনা নাকা-চেকিং-এ কীভাবে একদল পরিযায়ী শ্রমিকরা হরিশ্চন্দ্রপুরে ঢুকে পড়ল তা নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। পুলিশ কেন এই দুইটি অটো এবং চারটি ক্যাবকে চিহ্নিত করতে পারেনি তা নিয়েও আলোচনা করছেন হরিশ্চন্দ্রপুরবাসী। অভিযোগ, পুলিশের ঢিলো-ঢোলা নজরদারির জন্যই অটো ও ক্যাবে থাকা পরিযায়ী শ্রমিকরা গ্রামে ঢুকে গিয়েছেন। এদের এলাকায় ঢোকানোর আগে কেন যথাযথ স্ক্রিনং এবং সোয়াব টেস্ট করানো হল না তা নিয়ে পুলিশ প্রশাসনের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন অনেকে। শুক্রবার থেকে রবিবারের মধ্যে হরিশ্চন্দ্রপুরে ১০ জনের শরীরে কোভিড ১৯-এর জীবাণু আছে বলে সনাক্ত করা হয়েছে। এই ঘটনা জেলা-পুলিশ প্রশাসনের ঘুম ছুটিয়ে দিয়েছে। তারপরও কীভাবে পুলিশ ঢিলোঢোলাভাবে পরিস্থিতি সামলানোয় ক্ষিপ্ত এলাকার মানুষ। সকলেই ক্ষোভ উগড়ে দিচ্ছেন। অনেকেরই দাবি, কয়েকদিন আগে পর্যন্ত হরিশ্চন্দ্রপুরে কোনও করোনা আক্রান্তের খোঁজ মেলেনি। সকলেই শান্তিতে বসবাস করছিলেন। কিন্তু পরিযায়ী শ্রমিকদের দল এলাকায় ঢুকে বাসিন্দাদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। ক্ষোভ জানানো এই মানুষগুলির মতে, পুলিশ যদি পরিযায়ী শ্রমিকদের বিষয়টি নিয়ে সচেতন থাকত এবং হোম কোয়ারান্টাইন-এ না পাঠিয়ে হাসপাতাল ও প্রশাসনের ব্যবস্থায় চলা কোয়ারান্টাইন সেন্টারগুলিকে চালু রাখত- তাহলে হয়তো পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যেত না। সন্দেহ নেই হরিশ্চন্দ্রপুরে লাগাতার করোনা আক্রান্তের হদিশ মেলাতে যে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে তাতে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছেন অটো এবং ক্যাবে করে দিল্লি থেকে আসা পরিযায়ী শ্রমিকদের দলটি। এর জন্য না পুলিশ, না স্থানীয় প্রশাসন দায় ঝেড়়ে ফেলতে পারেন।