সংক্ষিপ্ত
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায় মৌর্য্যসম্রাট অশোকের পিতামহ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ও পিতা বিন্দুসারের চিকিৎসক ছিলেন একজন ধন্বন্তরি নামের বৈদ্য ঋষি। যার কথা চাণক্য উল্লেখ করছেন। ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে পুরাতাত্ত্ববিদ পি যশোয়াল যখন পাটলীপুত্র নগরের খননকার্য চালাচ্ছেন তখন সেখান থেকে আবিষ্কৃত হয় একটি বৌদ্ধ বিহার। যেখানে চিকিৎসক ধনন্তরীর উল্লেখ রয়েছে।
প্রতি বছর কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে ধনতেরাসের উৎসব উদযাপিত হয়। অর্থভাগ্য এবং ধনপ্রাপ্তির আশায় ধনতেরাসে দেবী লক্ষ্মী, সম্পদের দেবতা কুবের এবং ভগবান ধন্বন্তরির পূজা করা হয়। ধনতেরাসের আর এক নাম ধন ত্রয়োদশী বা ধনবত্রী ত্রয়োদশী। কথিত আছে, সমুদ্র মন্থনের সময় এই দিনেই দেবী লক্ষ্মী প্রকট এসেছিলেন। তাই এই দিন দেবী লক্ষ্মীর পূজা করা হয়। বলা হয়, ধনতেরাসের দিন দেবী লক্ষ্মী তাঁর ভক্তদের গৃহে যান ও তাদের ইচ্ছাপূরণ করেন। ধনতেরাস ও আয়ূর্বেদাচার্য ধন্বন্তরির এক অজানা অধ্যায় নিয়ে লিখছেন অনিরুদ্ধ সরকার
কে এই ধন্বন্তরির? আসুন জেনে নেওয়া যাক। ইতিহাস বলছে উজ্জয়নির শাসক সম্রাট বিক্রমাদিত্যের রাজসভায় ছিল নবরত্ন সভা। আর সেই সভাতে ছিলেন একজন ধন্বন্তরি। বিক্রমাদিত্যের রাজদরবারের নবরত্নগণ যথাক্রমে, অমরসিংহ, কালিদাস, ক্ষপনক ,ঘটকর্পর, ধন্বন্তরি, বরাহমিহির, বররুচি, বেতলভট্ট, ও শঙ্কু। গুপ্তযুগের সেরা চিকিৎসক ধন্বন্তরি ছিলেন একজন আয়ুর্বেদ ও শল্য চিকিৎসক।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায় মৌর্য্যসম্রাট অশোকের পিতামহ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ও পিতা বিন্দুসারের চিকিৎসক ছিলেন একজন ধন্বন্তরি নামের বৈদ্য ঋষি। যার কথা চাণক্য উল্লেখ করছেন। ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে পুরাতাত্ত্ববিদ পি যশোয়াল যখন পাটলীপুত্র নগরের খননকার্য চালাচ্ছেন তখন সেখান থেকে আবিষ্কৃত হয় একটি বৌদ্ধ বিহার। যেখানে চিকিৎসক ধনন্তরীর উল্লেখ রয়েছে। ধন্বন্তরি প্রতিষ্ঠিত সেই আরোগ্য বিহারের অস্তিত্ব নিয়ে প্রথমদিকে পুরাতাত্ত্বিকরা সন্দিহান হলেও তারা শেষে জানান "ধন্বন্তরির হাত ধরেই প্রাচীন ভারতীয় আয়ুর্বেদ চর্চার সূত্রপাত এবং এই উদ্ধার হওয়া বিহারও আয়ূর্বেদ চর্চার সন্ধান দেয়।"
দক্ষিণভারতের কিছু মন্দিরে ধন্বন্তরির মূর্তিপুজো হয়।সেখানে দেখা যায় মূর্তির চার হাতে শঙ্খ চক্র অমৃতভান্ড ও গুল্মলতা থাকে। পুরাণ ঘেঁটে জানা যায় তিনি উদ্ভব হয়েই সৃষ্টি পালনকর্তা দেব নারায়ণের স্তব করেন, ভগবান নারায়ণ তাকে অব্জদেব বা জলসম্ভুত) নাম দিয়ে পুত্ররূপে স্বীকার করেছিলেন।
মহাভারতেও উল্লেখ রয়েছে ধন্বন্তরির। প্রাচীন শাস্ত্রে উল্লিখিত ধন্বন্তরিকে নিয়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় কাহিনিটি হল সমুদ্রমন্থনের সময় প্রথমেই ধনসম্পদের দেবী লক্ষ্মী,ধবল ক্ষীর ও পারিজাত পুষ্পের পাশাপাশি ধন্বন্তরি উঠে আসেন। যার হাতে ছিল শ্বেত কমন্ডলু পুর্ণ অমৃত। বিষ্ণুধর্মোত্তরো গ্রন্থমতে এই ধন্বন্তরি ছিলেন চতুর্ভুজ সুদর্শন পুরুষ,শ্যামবর্ণ, পীতাম্বর, সুবর্ণখচিত মুকুটধারী। যার চারহাতে শঙ্খ, অমৃতভান্ড, অথর্ববেদ, এবং সবুজ গুল্মলতা থাকে।
বৌদ্ধ গ্রন্থ অনুসারে অনুমান করা হয় বুদ্ধদেবের চারশো বছর আগে এই ধন্বন্তরির আবির্ভাব।ধন্বন্তরির আরেক নাম নাকি দিবোদাস। ভারতীয় পুরাণ বলছে কাশীরাজের আসল নাম নাকি রাজা দিবোদাস। যিনি ছিলেন আচার্য সুশ্রুতের গুরু এবং আয়ুর্বেদ ঐতিহ্য অনুযায়ী শল্যবিদ্যার জনক। তাঁকে ধন্বন্তরির অবতার বলেও মনে করা হত সেযুগে। দিবোদাসের চিকিৎসা ছিল অব্যর্থ তাই লোকমুখে তিনি ধন্বন্তরির অবতার হিসেবে প রিচিতি পান। আবার কেউ কেউ বলছেন উনি ধন্বন্তরি উপাধি নেন।
ধন্বন্তরি ও দিবোদাসের প্রসঙ্গে বিভিন্ন কাহিনির সন্ধান মিলেছে। প্রাচীন কাল থেকে ভারতের বেদজ্ঞ ঋষিরা ভেষজের গুণাগুণ-সম্বন্ধে বিশেষ অভিজ্ঞ ছিলেন। অথর্ববেদ তার একটা জাজ্বল্যমান প্রমাণ।স্বয়ং ব্রহ্মাদেব এই অথর্ববেদ রচনা করেন এবং তাঁর পুত্র প্রজাপতিকে অথর্ববেদজ্ঞান দান করেন। প্রজাপতি সে জ্ঞান দেন তাঁর শিষ্য সুর্য্যদেবকে। যিনি তা দেন তাঁর শিষ্য দেব চিকিৎসক অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে।তাঁরা সেই জ্ঞান দান করেন দেবরাজ ইন্দ্রকে। উপকথা বলে এই অথর্ববেদজ্ঞানকে জনকল্যাণের কাজে মর্ত্যলোকে প্রচার ও প্রসার জরুরী হয়ে পড়লে স্বয়ং প্রজাপালক বিষ্ণু ধন্বন্তরি রূপে পৃথিবীতে জন্মগ্রহন করেন।দেবরাজ ইন্দ্রের থেকে অথর্ববদকে শ্রুতিতে ধারণ করেন মহামুনি ভরদ্বাজ।এই ভরদ্বাজের শিষ্যত্ব নেন কাশীরাজ দীর্ঘতমাপুত্র দিবোদাস। জগৎপতি বিষ্ণুর এক স্তবে পাওয়া যায়,” নমো ধন্বন্তরি কায় অমৃতধারক "
ধন্বন্তরি অমৃতাচার্য । স্কন্দপুরাণ ও মার্কণ্ডেয় পুরাণ থেকে জানা যায় ধন্বন্তরি ত্রেতাযুগের প্রারম্ভে আভির্ভুত হয়েছিলেন। স্কন্দপুরাণ থেকে জানা যায়, “তপস্বী গালব ঋষি তীর্থভ্রমণকালে একবার তৃষ্ণা-কাতর হয়ে পড়েন।পথমধ্যে তিনি হঠাৎ দর্শন পান এক অসামান্য রূপবতী নারীর। যিনি তখন কলসীতে জল নিয়ে যাচ্ছেন। মহর্ষি সেই রমনীর কাছে জল প্রার্থনা করিলেন ও জল পান করে অত্যন্ত পরিতৃপ্ত হলেন। মুনির পিপাসা মিটলে তিনি সন্তোষ সহকারে ওই রমনীকে বর দিলেন “পুত্রবতী হও”। রমণীর নাম বীরভদ্রা। তিনি মুনির আশীর্বাদ শুনে একটু অবাক হ লেন ও মধুর-বাক্যে মুনিকে বললেন,– “আপনার অব্যৰ্থ বাক্য বিবাহিতা নারীর জন্য চিত্তহারী হলেও কুমারীর পক্ষে লজ্জাকর, আমি অবিবাহিতা। একজন কুমারী নারী।” গালব ঋষি ভুল বুঝলেন। মেয়েটির পিতার কাছে গেলেন কথা বলতে।বীরভদ্রার পিতা সবশুনে ঋষির হাতেই কন্যা প্রদান করতে চাইলেন। কিন্তু বীরভদ্রা যেহেতু ঋষিকে জলদানে প্রাণরক্ষা করেছেন সেকারণে প্রাণদাত্রীকে তিনি পত্নী হিসেবে গ্রহণ করতে অস্বীকৃত হলেন। ঋষি গালবের এই ধৰ্ম্ম সঙ্গত ব্যবহারে ঋষিকূল তুষ্ট হলেন। তারা বীরভদ্রার ও ঋষিবাক্য রক্ষার এক উপায় বের করিলেন। বীরভদ্রা গর্ভে ত্রিলোকের হিতার্থে অমৃতাচার্য ধন্বন্তরির উদ্ভব হবে ঋষিরা এবিষয়ে পূৰ্ব্বেই জ্ঞাত ছিলেন। তারা তখন কুশনিৰ্ম্মিত এক কুমারের বেদমন্ত্রে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে বীরভদ্রার ক্রোড়ে স্থাপন করলেন। মাতৃক্রোড় স্পর্শমাত্র বেদ-মন্ত্র-প্রভাবে সে কুশ-কুমার জীবন প্রাপ্ত হইয়া মানবাকার ধারণ করল। তখন সম্মিলিত ঋষিবর্গ উক্ত শিশুর নাম রাখলেন "ধন্বন্তরি"। জনশ্রুতি, এই ধন্বন্তরি থেকেই বৈদ্যদের উৎপত্তি বলে ধরে নেওয়া হয়।