সংক্ষিপ্ত

ঐতিহাসিকরা মনে করেন আর্যাবর্তের প্রায় সমস্ত শিল্পধারাই বিশ্বকর্মার দ্বারা নির্মিত কিম্বা অনুপ্রাণিত।বিশ্বকর্মা রচিত স্থাপত্যশিল্প বিষয়ক একটি বিখ্যাত গ্রন্থ হল "বাস্তুশাস্ত্রম"।বিশ্বকর্মা রচিত এই গ্রন্থে মন্দির, নগর, গৃহ ,অস্ত্র, যন্ত্র প্রভৃতি নির্মাণের বর্ণনা দেখতে পাওয়া যায়।

অনিরুদ্ধ সরকার, প্রতিবেদক- হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী বিশ্বকর্মা দেবতাদের শিল্পী বা 'দেবশিল্পী' নামে পরিচিত। পুরাণ মতে তাঁর জন্ম অষ্টবসুর অন্যতম প্রভাসের ঔরসে দেবগুরু বৃহস্পতির ভগিনী বরবর্ণিনীর গর্ভে। অন্যদিকে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে প্রজাপতি ব্রহ্মার নাভিদেশ থেকে বিশ্বকর্মার উৎপত্তি। বেদে বিশ্বকর্মাকে সনাতন পুরুষ রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। বিশ্বকর্মার একহাতে দাঁড়িপাল্লা থাকে। দাঁড়িপাল্লার একটি পাল্লা জ্ঞান ও অন্যটি কর্মের প্রতীক। বিশ্বকর্মার একহাতে থাকা হাতুড়ি নির্মাণশিল্পের সাথে সম্পর্কযুক্ত। 

বিশ্বকর্মার বাহন হাতি। হিন্দু ধর্মে চার বেদের পাশাপাশি চারটি উপবেদ আছে। উপবেদগুলি হল আয়ুর্বেদ, ধনুর্বেদ, গান্ধর্ববেদ এবং স্থাপত্যবেদ। এই চার উপবেদের মধ্যে স্থাপত্যবেদের রচয়িতা বিশ্বকর্মা। বলা হয় তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রধান বাস্তুকার। তাঁর রচিত দশখানি পুঁথির সন্ধান মিলেছে। ঐতিহাসিকরা মনে করেন আর্যাবর্তের প্রায় সমস্ত শিল্পধারাই বিশ্বকর্মার দ্বারা নির্মিত কিম্বা অনুপ্রাণিত।বিশ্বকর্মা রচিত স্থাপত্যশিল্প বিষয়ক একটি বিখ্যাত গ্রন্থ হল "বাস্তুশাস্ত্রম"।বিশ্বকর্মা রচিত এই গ্রন্থে মন্দির, নগর, গৃহ ,অস্ত্র, যন্ত্র প্রভৃতি নির্মাণের বর্ণনা দেখতে পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন- বিশ্বকর্মা পুজোয় দারুণ সুখবর, ৫ মাসে সবথেকে সস্তা হল সোনা, এখনই কেনার সুর্বণ সুযোগ 
আরও পড়ুন- বিশ্বকর্মা পুজোর দিন দূরে থাকুন নেগেটিভ এনার্জি থেকে, সুফল পেতে নিষ্ঠাভরে পালন করুন এই বিধিগুলি

হিন্দুপুরাণ জুড়ে রয়েছে বিশ্বকর্মার বিভিন্ন নির্মাণের গাথা। রামায়ণ, মহাভারতে বর্নিত বেশ কিছু নগরের নির্মাতা ছিলেন দেবতাদের ইঞ্জিনিয়ার বিশ্বকর্মা। যার মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের রাজধানী দ্বারকা ছাড়া বাকীগুলি কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। এক নজরে বিশ্বকর্মার চার অমর কীর্তি দেখে নেওয়া যাক- 
আরও পড়ুন- কন্যা সংক্রান্তিতে কেন পূর্ণ বা মহা পূর্ণকলা, এই সংক্রান্তির প্রভাবে আপনার রাশিতে কী প্রভাব পড়তে চলেছে

রাবণের স্বর্ণলঙ্কা 
বাল্মীকি রামায়ণ অনুযায়ী ত্রেতা যুগে রাবণ রাজার রাজধানী ছিল লঙ্কা। মানে আজকের শ্রীলঙ্কা। রাবণের আমলে যা প্রসিদ্ধ ছিল সোনার লঙ্কা বলে। পার্বতীর সঙ্গে বিয়ের পর মহাদেব একটি ভব্য প্রাসাদ নির্মাণের ভার দেন দেবশিল্পী বিশ্বকর্মাকে। সোনা দিয়ে অসাধারণ এক প্রাসাদ নির্মাণ করেন বিশ্বকর্মা। প্রাসাদে প্রবেশের আগে পুজোর জন্য রাবণকে আমন্ত্রণ জানান মহাদেব। তখন রাবণ শিবভক্ত এক ঋষি।  এদিকে রাবণ পুজো শেষে দক্ষিণাস্বরূপ মহাদেবের কাছে সেই প্রাসাদ ও স্বর্ণলঙ্কা চেয়ে নেন। মহাদেব রাবণের হাতে স্বর্ণলঙ্কা তুলে দেন। সেই থেকেই রাবণের রাজধানী হয় স্বর্ণলঙ্কা। 
আবার কেউ কেউ বলেন বিশ্বকর্মা নির্মিত লঙ্কা ছিল কুবেরের। রাবণ যুদ্ধে সৎ ভাই কুবেরকে হারিয়ে লঙ্কার দখল নেন৷ এমনকি, সোনার পুষ্পক বিমানও ছাড়িয়ে নেন কুবেরের কাছ থেকে। যে পুষ্পক বিমানে করে রাবণ সীতাহরণ করেন৷ বাল্মীকি রামায়ণ অনুসারে হনুমান যখন সীতার খোঁজে লঙ্কা যায় তখন সে সোনার শহর দেখে অবাক হয়েছিল৷ রামকে হনুমান বলেছিল যে "সোনা দিয়ে তৈরি লঙ্কা নগরের যেকোনো জায়গায় আঘাত করা মুশকিল, শহরের চারপাশে মনি- মুক্তো, রত্ন, প্রবাল ছড়ানো আছে৷ সেখানে একটি টানা-সেতুও আছে যার পাশে  দেওয়ালটি অবধি সোনায় তৈরি ৷"

স্বর্ণলঙ্কার প্রতীকি ছবি

শ্রীকৃষ্ণের রাজধানী দ্বারকা
দ্বাপর যুগে শ্রীকৃষ্ণের রাজধানী দ্বারকা বিশ্বকর্মার অপর একটি অমর সৃষ্টি। মথুরা ত্যাগের পর কৃষ্ণ নতুন এক শহর প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন বোধ করেন। এক্ষেত্রে দুটি ভিন্ন কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। প্রথমটির মতে কৃষ্ণ গরুঢ়ে চড়ে ভারতের উত্তর-পশ্চিমের সৌরাষ্ট্র মানে, আজকের গুজরাতে আসেন এবং সেখানে দ্বারকা নগরী প্রতিষ্ঠা করেন। দ্বিতীয় কাহিনী অনুসারে নতুন এই শহর প্রতিষ্ঠার জন্য কৃষ্ণ নির্মাণের দেবতা ‘বিশ্বকর্মার’ সাহায্য নেন। বিশ্বকর্মা কৃষ্ণকে জানান, যদি  ‘সমুদ্রদেব’ তাদেরকে কিছু জমি প্রদান করেন শুধুমাত্র তবেই এ কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। কৃষ্ণ তখন সমুদ্রদেবের পূজা করেন। সমুদ্রদেব খুশি হয়ে কৃষ্ণকে বারো যোজন জমি প্রদান করেন। জমি পাওয়ার পর বিশ্বকর্মা সেখানে দ্বারকা নগরী নির্মাণ করেন।মহাভারত অনুযায়ী দ্বারকা ছিল শ্রীকৃষ্ণ তথা যদুবংশীয়দের রাজধানী। পরিকল্পনা করেই দ্বারকা নগরী নির্মাণ করা হয়েছিল। পুরো শহরটি মোট ৬টি ভাগে বিভক্ত ছিল। আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা, চওড়া রাস্তা, নগরচত্বর, সোনা, রূপা ও দামী পাথর দিয়ে নির্মিত বিশাল বিশাল প্রাসাদ, জনগণের সুযোগ সুবিধার জন্য নানা স্থাপনা সহ নানা উদ্যান ও সরোবর ইত্যাদি নিয়ে গড়ে উঠেছিল দ্বারকা নগরী। প্রায় ৭ লক্ষ ছোটবড় প্রাসাদ ছিল এ নগরীতে। এখানে ছিল ‘সুধর্ম সভা’ নামের এক বিশাল হলঘর, যেখানে নানা ধরনের আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হত। শ্রীকৃষ্ণ দেহত্যাগ করার পর দ্বারকা সমুদ্রে বিলীন হয়ে যায়।

দ্বারকা

মহাভারতের হস্তিনাপুর
কলিযুগে কৌরব ও পাণ্ডবদের রাজধানী ছিল  হস্তিনাপুর। এই প্রাচীন নগরীর নির্মাণও করেন বিশ্বকর্মা। এই নগরীকে কেন্দ্র করেই মহাভারত। আর মহাভারতের অজস্র ঘটনা।  কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে হস্তিনাপুরে অভিষিক্ত করেন কৃষ্ণ।

মহাভারত সিরিয়ালে হস্তিনাপুর রাজসভার ছবি

পাণ্ডবদের ইন্দ্রপ্রস্থ 
শ্রীকৃষ্ণের অনুরোধে পাণ্ডবদের শহর ইন্দ্রপ্রস্থ নির্মাণ করেছিলেন বিশ্বকর্মা। মহাভারতের আদিপর্বের রাজ্যলাভ পর্ব থেকে জানা যায়, পাণ্ডবদের থাকার জন্য এক টুকরো জমি দিয়েছিলেন ধৃতরাষ্ট্র। সেই খাণ্ডবপ্রস্থে ভাইদের সঙ্গে থাকতেন যুধিষ্ঠির। অগ্নিদেব খাণ্ডব দাহনের সময় তক্ষক পুত্র অশ্বসেন, ময়দানব, চারটি শার্ঙ্গক পক্ষী— এই ছ'জন বেঁচে যান। ময় দানব প্রাণভিক্ষার কৃতজ্ঞতা স্বরূপ এক অসাধারণ নগর নির্মাণ করতে আরম্ভ করেন। যাকে পূর্ণাঙ্গতা দেওয়ার জন্য বিশ্বকর্মাকে আমন্ত্রণ জানান কৃষ্ণ। তৈরি হয় ইন্দ্রপ্রস্থ। যুধিষ্ঠিরের রাজধানী ইন্দ্রপ্রস্থ এতটাই সুন্দর ছিল যে একে অনেকেই 'মায়ানগরী' বলত। পাণ্ডবদের প্রাসাদ নির্মাণে মৈনাক পর্বত থেকে আসে মণিরত্ন।প্রাসাদ তৈরির পর পাণ্ডবদের নিমন্ত্রণ রক্ষায় ইন্দ্রপ্রস্থে যান কৌরবরা। মায়ানগরীর মায়া বুঝতে না পেরে রাজদরবারে একটি সরোবরের জলে পড়ে যান দুর্যোধন।তা দেখে হেসে ফেলেন দ্রৌপদী। 'অন্ধ বাবার অন্ধ ছেলে' বলে কটাক্ষ করেন দুর্যোধনকে। আর এই ঘটনা থেকেই সূত্রপাত হয় কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের।

প্রতীকি ছবি ইন্দ্রপ্রস্থ

এই চার নগরী ছাড়াও বিশ্বকর্মা বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র, শিবের ত্রিশূল, কুবেরের অস্ত্র, ইন্দ্রের বজ্র, কার্তিকেয়র অস্ত্র প্রভৃতি তৈরি করেন। শ্রীক্ষেত্রের দারুব্রহ্ম থেকে প্রসিদ্ধ জগন্নাথ মূর্তিও বিশ্বকর্মাই নির্মাণ করেন।