সংক্ষিপ্ত
উত্তমকুমারকে নিয়ে এই আইনি লড়াই ইতিমধ্যে হইচই ফেলে দিয়েছে। বাংলা ছবিতে এই ধরনের বিতর্ক খুব একটা দেখা যায় না। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই ধরনের বিষয়ে আইনি লড়াইয়ে প্রবেশ করার আগে বাদী ও বিবাদী পক্ষ আপস করে একটা ফায়সালায় পৌঁছে যায়। কিন্তু, উত্তমকুমারকে নিয়ে এই লড়াই কোন দিকে যায় সেটাই দেখা ছাড়া আর কোনও গতি নেই।
একদিকে 'অচেনা উত্তম', আর অন্যদিকে 'অতি উত্তম'। আর এই নিয়ে এখন শুরু হয়েছে আইনি লড়াই। যার ফলে আদৌ উত্তমকুমারের কোনও বায়োপিক বাংলায় তৈরি হবে কি না তাতেই সংশয়ের দোলাচল। উত্তমকুমারের প্রয়াণ হয়েছে ১৯৮০ সালে। কিন্তু, আজ পর্যন্ত বাঙালির মহানায়ককে নিয়ে কোনও বায়োপিক তৈরি হয়নি। 'অচেনা উত্তম'-এর প্রযোজক সংস্থা অলোকানন্দা আর্টস। ছবির পরিচালক অতনু বসু। আর 'অতি উত্তম'-এর পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়। প্রযোজনায় ক্যামেলিয়া আর্টস। এছাড়াও রয়েছে সৃজিতের নিজস্ব প্রযোজনা সংস্থা এবং ছায়াবাণী। নাম ভূমিকায় আবার উত্তমকুমারের নাতি গৌরব চট্টোপাধ্যায়। সৃজিতের এই ছবি এবং তার নামভূমিকায় গৌরবের অভিনয় নিয়েই আপত্তি অলকানন্দা আর্টসের। আর সেই কারণেই অলকানন্দা আর্টস থেকে ক্যামেলিয়া, সৃজিত মুখোপাধ্যায় এবং গৌরব চট্টোপাধ্যায়কে আইনি নোটিস পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন অচেনা উত্তম-এর পরিচালক অতনু বসু।
অচেনা উত্তম-এর শ্যুটিং-এর মাঝে ফোটো সেশন
এশিয়ানেট নিউজ বাংলা-কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে অতনু বসু জানিয়েছেন, '২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর পার্ক হোটেলে উত্তমকুমারের পরিবারের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে অলকানন্দা আর্টস। চুক্তিপত্রে যে সব বিধিনিষেধ রাখা হয়েছিল, তারমধ্যে অন্যতম ছিল যে কোনওভাবেই উত্তমকুমারকে নিয়ে কোনও ধরনের বিনোদনমূলক কাজ অন্য কোনও সংস্থার সঙ্গে করতে পারবে না উত্তমকুমারের পরিবারের সদস্যরা। এক্ষেত্রে অলকানন্দা আর্টসের অনুমতি তাদের নিতে হবে। উত্তমকুমারকে নিয়ে বিনোদনমূলক কাজে হাত দেওয়ার ক্ষমতা একমাত্র অলোকানন্দা আর্টসের হাতেই থাকবে। আলোকানন্দা আর্টসের প্রধান যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন পর্যন্ত এই চুক্তি কার্যকর থাকবে। এমনকী, উত্তমকুমার নিয়ে কোনও ধরনের বিনোদনমূলক কাজেও তার পরিবারের সদস্যরা কাজ করতে গেলে অলকানন্দা আর্টসের অনুমতি লাগবে। এমনকী এই চুক্তি-তে স্বাক্ষর করেন উত্তমকুমারের পরিবারের পাঁচ সদস্য। উত্তমকুমারের ছেলে প্রয়াত গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম পক্ষের স্ত্রী সুমনা চট্টোপাধ্যায় এবং তাঁর ছেলে গৌরব চট্টোপাধ্যায়, মেয়ে নবমিতা চট্টোপাধ্যায়। এছাড়াও চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী মহুয়া চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর মেয়ে মৌমিতা চট্টোপাধ্যায়। যদি এই চুক্তির সময় অন্য কোনও সংস্থার সঙ্গে আগে থেকেই চুক্তি গৌরবরা করেছিলেন তাহলে তখন জানাননি কেন?'
অচেনা উত্তম-এর পরিচালক অতনু বসু
অলোকানন্দা আর্টসের আইনি নোটিস প্রাপ্তির কথা স্বীকার করে নিয়েছেন অতি উত্তম-এর পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়। তবে, এশিয়ানেট নিউজ বাংলা-কে তিনি জানিয়েছেন যে, 'অলোকানন্দা আর্টসের সঙ্গে চুক্তি সাইন করার আগে আমাদের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন গৌরব এবং তাঁর পরিবার। উত্তমকুমারের ৬৬টি ছবির স্বত্ব আমরা আগে কিনেছি। আমাদের সঙ্গে আগে কথা হয়েছে। খাতায় কলমে যা যা লেখা হয়েছে, তার এ দিক-ওদিক করিনি আমরা কেউ।' অভিনেতা গৌরব চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গেও কথা বলার চেষ্টা করে এশিয়ানেট নিউজ বাংলা। যদিও গৌরবের সঙ্গে কোনওভাবেই যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে, একটি অনলাইন ইউটিউব চ্যানেলকে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় গৌরব জানিয়েছেন, 'উত্তমকুমারের অভিনয়ের ব্যপ্তিকে এভাবে টাকার অঙ্কে বেঁধে রাখা যায় না। অলোকানন্দা আর্টসের সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে চুক্তি হয়েছে। সেখানে কোনওভাবেই এমনকিছু কমিটমেন্ট করা হয়নি যে উত্তমকুমারকে নিয়ে অন্য কেউ কাজ করতে পারবে না। সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে উত্তমকুমারকে সারাজীবনের জন্য বন্ধক দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। আর আইনি নোটিস পাঠিয়ে আমার অভিনেতা সত্তাকে বেঁধে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে। এর জবাব আইনগতভাবেই দেওয়া হবে।'
পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়
ক্যামেলিয়া প্রোডাকশনের কর্ণধার নীলরতন দত্ত একটি দৈনিককে প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে বলেছেন যে তাঁরা আগেই উত্তমকুমারের পরিবারের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। তাই আইনি নোটিস তাঁদেরই পাঠানো উচিত ছিল। কিন্তু নানা কাজে ব্যস্ত থাকায় তারা সেটা করে উঠতে পারেননি। এবার আইনি নোটিস তারাও পাঠাবেন। উত্তমকুমারকে নিয়ে অন্য কেউ বিনোদনমূলক প্ল্যাটফর্মে কাজ করতে পারবে না বলে অলকানন্দা আর্টস-এর পক্ষ থেকে যে দাবি করা হয়েছে তাতেও প্রশ্নও তুলেছেন নীলরতন দত্ত। তাঁর প্রশ্ন- তাহলে যারা উত্তমকুমারের ছবির স্যাটেলাইট স্বত্ত্ব কিনেছেন তাদের কী হবে? তারা তো উত্তমকুমারের ছবি-র সম্প্রচার করে যাচ্ছেন। সেখানেও তো অভিনেতাদের নাম দেখানো হচ্ছে।
সৃজিত মুখোপাধ্যায় আরও জানিয়েছেন যে- অলোকানন্দা আর্টস যে আইনি নোটিস পাঠিয়েছে তার জবাব শীঘ্রই দেওয়া হবে। ২০১৯ সালে গৌরবরা যে চুক্তি ক্যামেলিয়া ও অলোকানন্দা আর্টসের সঙ্গে করেছিলেন তার মধ্যে কোনও গরমিল রয়েছে কি না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সৃজিত। গৌরব এবং তাঁর আইনজীবী এই বিতর্কের সমাধান অতি দ্রুত করতে পারেন বলেই মনে করছেন সৃজিত।
অভিনেতা তথা উত্তমকুমারের নাতি গৌরব চট্টোপাধ্য়ায়
এই আইনি লড়াই-এ নিয়ে কার্যত হতাশার সুর অচেনা উত্তম-এর পরিচালক অতনু বসুর গলায়। তিনি জানিয়েছেন, ছবিটি ২০২১ সালের পুজোর সময় মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল। অতিমারির কারণে শ্যুটিং এক বছরের জন্য পিছিয়ে যায়। চলতি বছরে কাজ করে ছবিটি-র ৬৫ শতাংশ শ্যুটিং সম্পন্ন করা গিয়েছে। বাংলা ছবিতে এতবড় স্টার কাস্ট এর আগে হয়নি বলেও জানিয়েছেন অতনু। ৬৫ থেকে ৭০ জন অভিনেতা-অভিনেত্রীকে এই ছবি তৈরি হচ্ছে। এর সঙ্গে আরও কিছু জুনিয়ার আর্টিস্ট এবং ছোট-ছোট চরিত্রের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সংখ্যাটা জুড়ে দিল সংখ্যাটা আরও বড় আকার ধারণ করবে। উত্তমকুমারের চরিত্রেই রয়েছেন মোট চার জন অভিনেতা। উত্তমকুমারের তরুণ বয়সের চরিত্রে অভিনয় করছেন তীর্থরাজ বসু। সিনেমার উত্তমকুমারের খ্যাতি থেকে শেষজীবন পর্যন্ত চরিত্রে অভিনয় করছেন শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। রানি রাসমণি সিরিয়াল খ্যাত দিতিপ্রিয় রায় রয়েছেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের চরিত্রে। সুচিত্রা সেনের ভূমিকায় ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। উত্তমকুমারের স্ত্রী গৌরীদেবীর চরিত্রে শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায়। সম্পূর্ণা রয়েছেন সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়ের চরিত্রে। সুপ্রিয়াদেবীর ভূমিকায় স্বায়ন্তনী চট্টোপাধ্যায়। অতনু-রা চেষ্টা করছেন ২০২২-এর মধ্যে ছবিটিকে হল রিলিজ করতে। কিন্তু অতি উত্তম-এর পোস্টার প্রকাশ্যে আসতেই কার্যত মাথায় হাত অলোকানন্দা আর্টসের। অতনু-র আরও প্রশ্ন ছবিটি নিয়ে তিন বছর আগে থেকেই যদি সৃজিত কাজ শুরু করেছিলেন তাহলে এতদিন এর কথা কেন প্রকাশ্যে আসেনি? জানা গিয়েছে অলোকানন্দা আর্টসের পাঠানো আইনি নোটিস মঙ্গলবার সৃজিত, গৌরব এবং ক্যামেলিয়ার কাছে পৌঁছয়। উত্তম 'বিতর্ক' যে এখন কিছুদিন বাংলা চলচ্চিত্র মহলকে সরগরম করে রাখবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।