যা চকচক করে তা সব সময় কিন্তু সোনা হয় না। আর এই নকল সোনার লোভে আজকের নব্য যুবক এবং আগামী প্রজন্ম গভীরভাবে ডুবে রয়েছে। যা তাদের ভবিষ্যৎ চুরি করে নিচ্ছে, নিঃশব্দে। গর্ধভ অর্থনীতির শিকার সমাজের এক বিরাট অংশ। যাদের ফেরাতে না পারলে ঘোর বিপদ অপেক্ষা করছে।

আজকে কুইক ডেলিভারি অ্যাপস—Zepto, Swiggy Instamart, Blinkit, Dunzo, আপনি যার নামই নিন না কেন—যে হারে প্রসারিত হচ্ছে, তা সত্যিই বিস্ময়কর। তারা সুবিধাকে একটি সংস্কৃতিতে পরিণত করেছে। কিন্তু তাৎক্ষণিক তৃপ্তির এই চকচকে আবরণের নীচে একটি নীরব ট্র্যাজেডি লুকিয়ে আছে, যা নিয়ে খুব কম লোকই কথা বলছেন। একেই আমি 'গর্ধভ অর্থনীতি' বা The Donkey Economy বলছি।

একটু কাছ থেকে দেখুন, দেখতে পাবেন ২০ থেকে ২৮ বছর বয়সি যুবকদের একটি গোটা প্রজন্ম এমন একটি চক্রে আটকে পড়েছে, যা দেখতে লোভনীয় হলেও আসলে বিপজ্জনকভাবে ফাঁপা। এই ছেলে-মেয়েরা, যাদের অনেকেই তাদের বয়সের তুলনায় "ভালো টাকা" উপার্জন করছে বলে মনে হয়, তারা অজান্তেই তাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বছরগুলোকে স্বল্পমেয়াদী আরামের জন্য অপচয় করছে।

শেখা এবং প্রশিক্ষণ থেকে দূরে

এই সময়টা তাদের দক্ষতা শেখার কথা। আসল, বাস্তব, জীবন-ধারণের উপযোগী দক্ষতা শেখার কথা। যারা মেকানিক, ইলেক্ট্রিশিয়ান, প্লাম্বার, কাঠমিস্ত্রি বা মেশিন অপারেটর হতে পারত, যারা কর্মশালায়, কারখানার ফ্লোরে, বা দক্ষ কারিগরদের সঙ্গে কাজ করতে পারত, কীভাবে তৈরি করতে হয়, মেরামত করতে হয় এবং নির্মাণ করতে হয় তা শিখতে পারত। এই পেশাগুলোই তাদের ভবিষ্যতে স্থায়িত্ব, আত্ম-মর্যাদা এবং সমাজে একটি সম্মানিত স্থান দিত। তারাই এর পরিবর্তে এমন কিছুর পিছনে ছুটছে যাকে আমি শুধুমাত্র আধুনিক যুগের গর্ধভ বলেই বর্ণনা করতে পারি—ক্লান্ত, লক্ষ্যহীন, এবং প্রতিস্থাপনযোগ্য (replaceable).

আমার শৈশবের একটি উজ্জ্বল স্মৃতি নিয়ে আমি এই কথা বলছি। আমার বাবা নির্মাণ ব্যবসায় ছিলেন, এবং আমার মনে আছে নির্মাণের সাইটে এই গর্ধভদের ব্যবহৃত হতে দেখতাম। তাদের কাজ ছিল সহজ এবং পুনরাবৃত্তিমূলক: পিঠে বালি বা সিমেন্ট বহন করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া, নামানো, এবং আবার হেঁটে ফিরে আসা। তাদের মালিক এই যান্ত্রিক চলাচলের অন্তহীন চক্র থেকে উপার্জন করত।

এখন, যখন আমি ডেলিভারি বাইক চালকদের শহরের মধ্যে দিয়ে দ্রুত গতিতে ছুটতে দেখি, তখন কোনও পার্থক্য দেখি না। তারা আমাদের যুগের নতুন গাধা। ঝুড়ির বদলে ব্যাগের ভারে জর্জরিত, চাবুকের বদলে অ্যাপের নোটিফিকেশন দ্বারা চালিত। তারা এক পিকআপ পয়েন্ট থেকে অন্য পিকআপ পয়েন্টে ছুটে চলে, চোখ GPS স্ক্রিনে আঠার মতো লেগে থাকে, দশ মিনিটের মধ্যে কারও অর্ডার পৌঁছে দেয়, বারবার, সারাদিন, প্রতিদিন।

এখানে কোনও শিক্ষা নেই, কোনও বৃদ্ধি নেই, কোনও অভিজ্ঞতা নেই, আছে শুধু উদয়াস্ত দৌড়োদৌড়ি। আর এই দৌড়কে ভুল করে অগ্রগতি মনে করাটাই আমাদের সময়ের সবচেয়ে বিপজ্জনক বিভ্রম।

এই যুবকরা যখন ৩০ বা ৩৫ বছরে পৌঁছাবে, তখন তাদের কী হবে? ক্লান্তি চেপে বসবে। তাদের শরীর ব্যথা করবে, মন ক্লান্ত হয়ে পড়বে, এবং সবচেয়ে খারাপ বিষয় হলো, তারা বুঝতে পারবে যে তাদের কোনও স্থানান্তরযোগ্য দক্ষতা (transferable skill), কোনও নৈপুণ্য বা কোনও পেশা নেই। তাদের আয়ের ক্ষমতা কমে যাবে ঠিক তখনই যখন তাদের অন্যান্য দায়িত্ব অনেকটাই বেড়ে যাবে।

আর তখন? AI, রোবটিক্স বা অটোমেশন তাদের রক্ষা করবে না। এরা মানুষ, অ্যালগরিদম নয়। যখন শরীর ধীর হয়ে যায় এবং মন কোনও দিশা খুঁজে পায় না, তখন জীবন হয়ে ওঠে শুধুমাত্র কোনওক্রমে বেঁচে থাকা, বাস্তবে জীবন যাপন করা নয়।

এটি কেবল একটি অর্থনৈতিক উদ্বেগ নয়; এটি একটি সামাজিক উদ্বেগ

প্রত্যেক সমাজেরই দক্ষ কর্মী দরকার, প্লাম্বার, ইলেক্ট্রিশিয়ান, পেইন্টার, মেকানিক, রাজমিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি ইত্যাদি। এরা আমাদের সমাজের অপরিহার্য অঙ্গ। যারা আমাদের বসবাসের এই বাস্তব পৃথিবীটাকে তৈরি করে এবং মেরামত করে। কিন্তু প্রতি বছর এই পেশাগুলোতে কম সংখ্যক যুবক প্রবেশ করছে। তারা দ্রুত নগদ অর্থ এবং সহজে স্বাধীনতার মায়ায় হারিয়ে যাচ্ছে। দ্রুত এবং সহজ রোজগারের হাতছানি এরা উপেক্ষা করতে পারছে না।

যদি এটি চলতে থাকে, তবে ভবিষ্যতে একটি অদ্ভুত বৈপরীত্য দেখা দেবে। এমন একটি দেশ যেখানে লক্ষ লক্ষ যুবক রয়েছে, কিন্তু দক্ষ হাতের বড্ড অভাব। কেউ কোনও কিছু গভীরভাবে শিখবে না। তা নিয়ে চর্চা করবে না।

এই নিয়ে আমাদের সততার সঙ্গে কথা বলার সময় এসেছে। পিতা-মাতা, শিক্ষাবিদ এবং সম্প্রদায়ের নেতাদের যুবকদের মনে করিয়ে দিতে হবে: তাড়াতাড়ি উপার্জন করা আর একটি কেরিয়ার গড়া এক জিনিস নয়। দক্ষতা ছাড়া অর্থ অস্থায়ী। কিন্তু একবার অর্জিত দক্ষতা আজীবন সঙ্গী হয়ে থাকে।

তাই যদি আপনি যুবক হন এবং এই লেখাটি পড়েন, তবে অন্তহীন ডেলিভারির এই ট্রেডমিল থেকে নেমে আসুন।

আসল কিছু শিখুন।

কিছু তৈরি করুন।

কিছু মেরামত করুন।

এমন কিছু তৈরি করুন যা আপনার শিফটের পরেও টিকে থাকবে।

এভাবেই আপনি সত্যিকারের ডেলিভারি দেবেন, খাবার বা মুদি জিনিস নয়, বরং একটি ভবিষ্যৎ।

লেখক: আর্কিটেক্ট জিতেন্দ্র নায়েক