সংক্ষিপ্ত
বঙ্গের নবাবিয়ানার সেকালের রাজধানী মুর্শিদাবাদেও ধুলো ঝেড়ে চকচকে হয়ে উঠছে রেডিও। কেউ দাঁড়াচ্ছেন পাড়ার মোড়ের রেডিওর দোকানে, কেউ কেউ আবার রেডিওর মিস্ত্রিকে বেশি টাকার টোপ দিয়ে বাগিয়ে নিয়ে চলেছেন সোজা বাড়িতেই।
‘আকাশবাণী কলকাতা’, তারপরেই তিনটি শঙ্খধ্বনির সুর, আর তারপরেই মা চণ্ডীর আরাধনা স্তব দিয়ে শুরু সারা বিশ্বের আপামর বাঙালি জনগণের প্রাণমন্ত্র, ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। এই চেনা স্তুতির মধ্যেই বাঙালি জন্ম নেয়, বাঙালি বেড়ে ওঠে, বাঙালি নিজের ক্ষুদ্র পরিসর ছেড়ে সীমা-গণ্ডী পেরিয়ে সারা বিশ্বের উন্মুক্ততায় ঝাঁপ দেয়। কিন্তু, ফিরে এসে সেই বছর বছর অ্যালার্ম দিয়ে জেগে ওঠে পিতৃপক্ষের অবসানে, আর দেবীপক্ষের সূচনায়। শুধু মাছভাত নয়, লর্ডসে ঘুরপাক জার্সি নয়, ঋত্বিক-সত্যজিত-মৃণালের তর্কবিতর্ক নয়, পঁচিশ বা বাইশের রবীন্দ্রস্মরণ নয়, সবুজ-মেরুনের বাইরেও জন্ম থেকে বাঙালির রক্তে জীবন্ত থাকে একটা বিশেষ ভোর, তার নাম মহালয়া।
শুধুই কি ইউনেস্কোর নজরের শহর? তৎকালীন ব্রিটিশদের কল্লোলিনী তো আছে বটেই, সগৌরবে দুর্গাপুজোকে মাথায় করে বয়ে নিয়ে চলেছে তৎকালীন নবাবদের আঁতুড়ঘরও। বঙ্গের নবাবিয়ানার সেকালের রাজধানী মুর্শিদাবাদেও ধুলো ঝেড়ে চকচকে হয়ে উঠছে রেডিও। কারণ, বাঙালিদের ঘরে ঘরে মন্ত্রপাঠ শোনাতে আসছেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। মহালয়ার আগে তাই নস্টালজিয়ার আবেগে ভাসছে মুর্শিদাবাদ। বেতার বাণী শোনার আগ্রহে উত্তর থেকে দক্ষিণ রেডিও সারাইয়ের হিড়িকে বেসামাল অবস্থা জেলাজুড়ে। দেবীপক্ষের শুরু হতে বাকি আর মাত্র কয়েকদিন। সারা বছর যারা খুঁজেও দেখেননি বেচারি বুড়ো রেডিওটাকে, তাঁরাও অধীর আগ্রহে লাইন দিয়ে রয়েছেন রেডিও সারাইয়ের দোকানে।
কেউ দাঁড়াচ্ছেন পাড়ার মোড়ের রেডিওর দোকানে, কেউ কেউ আবার রেডিওর মিস্ত্রিকে বেশি টাকার টোপ দিয়ে বাগিয়ে নিয়ে চলেছেন সোজা বাড়িতেই। নবাব নগরী লালবাগের আস্তাবল মোড় থেকে শুরু করে সদর বহরমপুর শহরের জনবহুল এলাকার কাদাই মোড়, খাগড়া, গোরাবাজার, নিমতলা, স্বর্ণময়ী সর্বত্র ছবিটা একই। এমনকি প্রত্যন্ত এলাকা কান্দি থেকে থেকে শুরু করে সামশেরগঞ্জ, লালগোলা রেডিওর চাহিদায় মিলেমিশে একাকার। আর এই সুযোগে দম ফেলার ফুরসত নেই রেডিও দোকানের মালিকদের। ইন্টারনেট, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টিভি মোবাইলের রমরমায় থুরথুরে রেডিও তাঁর যৌবনের ঔজ্জ্বল্য হারিয়েছে বহুদিন। প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই রেডিও সেটটি ঠাকুরদার ইজি চেয়ারের মতো এককোণে পড়ে থাকে বন্ধ হয়েই। সেই রেডিওর চাহিদা বছরের একটা দিনে হুড়মুড় করে বাড়িয়ে তোলে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’।
টিভিতে বা মোবাইলে মহিষাসুরমর্দিনী দেখে মন ভরে না আপামর বাঙালির। পিতৃপক্ষের অবসান ও দেবীপক্ষের সূচনার ভোরে ঠিক ৪টেয় রেডিওতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের দরাজ গলায় সংস্কৃত স্তোত্রপাঠ ও তাঁর কণ্ঠে দেবীর আগমনী বার্তা না শুনলে যেন মনেই হয় না দুর্গাপুজো এসে গেছে। তাই মহালয়ার আগের দিন বাড়ির এক কোণে পড়ে থাকা রেডিও সেটটিকে চাঙ্গা করে নেওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়।
নবাব নগরীর এক বাসিন্দার কথায়,‘‘পুরনো হয়েছে রেডিও। এখন তো সেভাবেই চালানোই হয় না। কিন্তু মহালয়ার সকাল মানেই রেডিও চলা চাই। থাকতে হবে আকাশবাণী। ঘড়ির কাঁটা ৪টে ছুঁলেই চলবে রেডিও। সারা বছর ধরে রেডিও-র এই মেগা ইভেন্টের জন্য মন প্রতীক্ষা করে। আগে তো রেডিও চালানোর কিছুক্ষণ পরেই কোঁ শব্দের পরেই ঘোষণা হত ‘এখন আপনারা শুনছেন আকাশবাণী কলকাতা’। শঙ্খধ্বনির সঙ্গে শুরু হয়ে যেত আমাদের দুর্গাপূজা।' আর এক জনের মতে 'পাড়া জুড়েই যেন উৎসবের আবহ তৈরি হত মহালয়ার সকালে। এক সঙ্গে একাধিক বাড়ি থেকে ভেসে আসত বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মন্ত্রমুগ্ধ করা চণ্ডীপাঠ।' আবার অনেকের আক্ষেপ, 'মহালয়ার সেই সব দিন এখন অতিত। ভোরবেলায় কষ্ঠ করে ৪টার সময় উঠে আকাশবাণীর মহালয়া শোনায় এখন উৎসাহের ভাটা। কারণ, যখন-তখন নিজের ইচ্ছে মতো মহিসাসুর মর্দিনী শোনার ব্যবস্থা রয়েছে। তার সঙ্গে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে আবার মহিষাসুর মর্দিনীর নাট্যরূপ দেখানো হয় সকাল বেলায়। স্বাভাবিকভাবেই মানুষ এখন ওই সহজলভ্য এবং শরীরকে কষ্ঠ না দিয়ে মহালয়া শোনা বা দেখায় আগ্রহী।'
এমন এক পরিস্থিতির মধ্যেও এমন কিছু মানুষ রয়েছে যারা মহালয়ার এই দিনটিতে প্রস্তুত থাকেন। আগেভাগে বাড়ির পুরনো-অকেজো রেডিও সারাইয়ের জন্য দোকানগুলিতে ভিড় করেন। এরা আবার মহালয়ার দিন কয়েক আগে থেকেই রেডিও ঝাড়া মোছা শুরু করে দেন। পুরোনো ব্যাটারি পাল্টে নতুন ব্যাটারি লাগিয়ে ঝালিয়েও নেন বেশ কয়েকবার। অপেক্ষারতদের মতে, 'ইন্টারনেট বলুন আর সিডি ডিভিডি-ই বলুন, মহালয়ার ভোরের আগে আকাশবাণীতে উদাক্ত কন্ঠে চণ্ডীপাঠ শোনার দমবন্ধ করা উৎকণ্ঠা আর কোনওকিছুতে নেই।' ঐতিহাসিক মুর্শিদাবাদে রাত বাড়ে, নবাবের এককালের তোপখানার পাশে বেজে ওঠে ‘বাজল তোমার আলোর বেণু, মাতল রে ভুবন’, ঠাকুরদার আমলের রেডিওটা কোলে নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন ওঁরা, ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ না বাজলে শারদীয়ার সূচনাই যে মলিন।
আরও পড়ুন-
মুর্শিদাবাদের নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর আমলের দুর্গাপুজো পার করেছে ৪৫০ বছর, আজও আনন্দে মেতে ওঠে নবাবনগরী
নবমীর যজ্ঞের কলা খেয়ে সন্তান লাভ করেন নিঃসন্তান নারী, বীরভূমের নাকপুরে ১৭৬ বছরের দুর্গাপুজো
কর্কট রাশি কেমন কাটবে দুর্গা পুজা, জেনে নিন পুজো মাস কেমন প্রভাব ফেলবে কর্কট রাশির উপর