সংক্ষিপ্ত
হেমা থেকে লতা। নাইটিঙ্গেল অব ইন্ডিয়া' আখ্যা পাওয়া লতা মঙ্গেশকর ভারতের ৩৬টি ভাষায় প্রায় ৩০ হাজারের মত গান গেয়েছেন। তাঁর গান শুনে কেঁদে ফেলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। লতা মঙ্গেশকরের অজানা কথা লিখছেন, অনিরুদ্ধ সরকার।
শেষ হয়ে গেল ২৭ দিনের লড়াই। আজ সকাল ৮.১২ মিনিটে প্রয়াত হলেন লতা মঙ্গেশকর। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯২। হেমা থেকে লতা। নাইটিঙ্গেল অব ইন্ডিয়া' আখ্যা পাওয়া লতা মঙ্গেশকর ভারতের ৩৬টি ভাষায় প্রায় ৩০ হাজারের মত গান গেয়েছেন। তাঁর গান শুনে কেঁদে ফেলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। লতা মঙ্গেশকরের অজানা কথা লিখছেন, অনিরুদ্ধ সরকার।
জানা যায়, ভারত-চীন যুদ্ধ চলছে, জীবন বিসর্জন দিচ্ছেন ভারতীয় সৈন্যরা। সেসময় লতা গাইলেন ‘এ মেরে ওয়াতান কি লোগো’ গানটি। তার এই গান শুনে কেঁদে ফেললেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু।
১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর দীনানাথ মঙ্গেশকর আর সেবন্তী মঙ্গেশকরের ঘর আলো করে এল তাঁদের প্রথম সন্তান, 'হেমা'। পণ্ডিত দীনানাথ 'ভাউবন্ধন’ নামের এক নাটক পরিচালনার পর নাটকের প্রধান চরিত্র দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে মেয়ের নাম বদলে রাখেন 'লতা'।
মধ্যপ্রদেশের বাসিন্দা লতা মঙ্গেশকরের পরিবারের আদি পদবী ছিল 'হরদিকর'। দীনানাথ সেটিকে বদলে 'মঙ্গেশকর' করেন। যাতে তাঁদের নিজেদের এলাকা গোয়ার মঙ্গেশি শহরের মানুষ বলে তাঁদের চিহ্নিত করা যায়।
লতার পর একে একে সেবন্তীর কোলে আসেন আশা ভোঁসলে, উষা মঙ্গেশকর, মীনা মঙ্গেশকর ও সর্বকনিষ্ঠ হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর। ভাই-বোন বলতে পাগল ছিলেন লতা। কথিত আছে প্রতিদিন ছোট বোন আশা ভোসলেকে নিজের সাথে করে স্কুলে নিয়ে যেতেন। স্কুল কর্তৃপক্ষ নিষেধ করলে রাগ করে সেই স্কুলে যাওয়াই ছেড়ে দেন তিনি। প্রথাগত আনুষ্ঠানিক শিক্ষা পাননি লতা। একজন গৃহকর্মী তাকে মারাঠি বর্ণপরিচয় শিখিয়েছেন এবং স্থানীয় একজন পুরোহিত তাকে সংস্কৃত শেখান। আত্মীয়স্বজন এবং শিক্ষকরা তাদের বাড়িতে এসে তাকে অন্যান্য বিষয় শেখাতেন।
লতার বয়স যখন মাত্র ১৩ বছর, তখন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে দীনানাথ মঙ্গেশকর মারা যান। ফলে পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ে ছোট্ট লতার ওপর।পরিবারের বন্ধু ‘নবযুগ চিত্রপট চলচ্চিত্র কোম্পানি’র মালিক মাস্টার বিনায়ক তখন দাঁড়িয়েছিল মঙ্গেশকর পরিবারের পাশে।বলতে গেলে তিনিই ছিলেন লতার প্রথম গুরু। মাস্টার বিনায়ক তার চলচ্চিত্র ‘পাহিলি মঙ্গলা-গৌর’ এ লতা মঙ্গেশকরের জন্য একটি চরিত্র বরাদ্দ করেন। বিনায়কের মৃত্যুর পর সঙ্গীত পরিচালক গুলাম হায়দার হন লতার গুরু।
১৯৪৩ সালে মারাঠি চলচ্চিত্র 'গজাবাউ'-তে তিনি 'কিছু কথা, কিছু শব্দ' শিরোনামের একটি গান গেয়েছিলেন, যা ছিল চলচ্চিত্রে লতার গাওয়া প্রথম গান। ১৯৪৯ সালে 'মহল' চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার পর থেকে তিনি সবার নজরে চলে আসেন।
পঞ্চাশের দশকে হিন্দি চলচ্চিত্র শিল্পে অপরিহার্য হয়ে ওঠেন লতা মঙ্গেশকর। ১৯৭৪ সালে সবচেয়ে বেশি গানের শিল্পী হিসেবে গিনেস বুকে স্থান পান লতা মঙ্গেশকর।পাকিজা, আওয়ারা, মুঘল এ আজম, শ্রী ৪২০, আরাধনা এবং দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গের মতো সিনেমার গান বছরের পর বছর ধরে একটানা চলেছে।তিনি ছিলেন প্রথম গায়িকা যিনি গান গাওয়ার জন্য ভালো পারিশ্রমিক এবং লভ্যাংশ দাবি তুলেছিলেন।
'নাইটিঙ্গেল অব ইন্ডিয়া' আখ্যা পাওয়া লতা মঙ্গেশকর ভারতের ৩৬টি ভাষায় প্রায় ৩০ হাজারের মত গান গেয়েছেন।বলিউডের শীর্ষ সকল পরিচালকের সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন, যাদের মধ্যে রাজ কাপুর, গুরু দত্ত যেমন রয়েছেন তেমনি রয়েছেন মনি রত্নম থেকে করন জোহর।
ইন্দিরা গান্ধী তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। একবার তিনি লতা মঙ্গেশকরের বাড়ির সামনে দিয়ে যাবেন। খবর পেয়ে লতা ক্যামেরা নিয়ে ছুটে গেছিলেন বারান্দায়। লতার বাড়ির সামনে হঠাৎ করে সেদিন কমে গেছিল ইন্দিরার গাড়ির গতি। তিনি যখন জানতে পেরেছিলেন লতা বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন। একথা শুনে সৌজন্য বিনিময়ের জন্য হাত নেড়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ক্যামেরা রেখে ইন্দিরার উদ্দেশে হাত নেড়েছিলেন লতাও।
লতা মঙ্গেশকর ভালোবাসতেন আড্ডা দিতে। বন্ধু রবি শঙ্করের স্টুডিওতে মাঝেমধ্যে যেতেন আড্ডা দিতে। সেখানে বন্ধু জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে আড্ডা দিতে ভালোবাসতেন লতা। ছিল ফটোগ্রাফির শখ।ছিলেন ক্রিকেটের গোঁড়া সমর্থক। অনেক সময় রেকর্ডিংয়ে বিরতি দিয়ে টেস্ট ম্যাচ খেলা দেখতে গিয়েছেন। ডন ব্রাডম্যানের স্বাক্ষর করা একটি ছবি আগলে রেখেছিলেন লতা। আর ছিল গাড়ির শখ। ধূসর রঙের হিলম্যান এবং নীল শেভ্রোলে ছিল প্রিয়।এছাড়া তাঁর সংগ্রহে ছিল ক্রাইসেলার এবং মার্সিডিজ। বাড়িতে তার নয়টি কুকুর রয়েছে।তিনি মোজার্ট, বিঠোভেনের মিউজিক শোনা পছন্দ করতেন।
বোন আশা ভোসলের সঙ্গে লতার মনোমালিন্য হয়েছিল। লতা বলেছিলেন, আশার প্রথম স্বামী গণপতরাও ভোসলের কারণে তাঁদের সম্পর্কের অবনতি হয়েছিল। সম্ভবত গণপত মনে করতেন, আশা লতার কারণে কাজ পান না। চল্লিশের দশকের শেষদিকে দুই বোনের ক্যারিয়ার শুরুর পর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে লতার দ্রুত উত্থান ঘটে। অন্যদিকে আশা তখনো সংগ্রাম করছিলেন। লতা বলেন, গণপত আশাকে তাঁদের বাড়িতে যেতে নিষেধ করেন। তাঁদের দেখাসাক্ষাৎও তিনি বন্ধ করে দেন। পরে আশার দ্বিতীয় স্বামী রাহুল দেব বর্মণ দুই বোনকে কাছে আনেন।
একবার বেশ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন লতা। ডাক্তার জানায় ধীরে ধীরে রোজ কেউ বিষ দিচ্ছে তার খাবারে। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে দেখলেন রাঁধুনি বেতন না নিয়েই পালিয়েছে। তার মতো একজন সদা হাসিমুখ কোকিলকন্ঠীকে কেউ মারার ষড়যন্ত্র করতে পারে, তা ছিলো কল্পনার বাইরে!
আরও পড়ুন: রবিবার সকালেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ, প্রয়াত সুর-সম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর, শোকের ছায়া দেশ জুড়ে
আরও পড়ুন: 'উনি স্বয়ং মা সরস্বতী', লতা মঙ্গেশকরের প্রয়াণে শোকপ্রকাশ হৈমন্তি শুক্লার
১৯৯৯ সালে ভারতের সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে তাঁকে মনোনীত করা হয়। কিন্তু লতা শারীরিক অসুস্থতার কারণে রাজ্যসভার অধিবেশনে খুব বেশি উপস্থিত থাকতে পারতেন না।
কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পর জানুয়ারি মাসের শুরুতে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। দেবী সরস্বতীর সঙ্গে তুলনা করা হত লতাকে। তাঁর কন্ঠে সাক্ষাৎ দেবী অবস্থান করছেন বলা হত। সেই সরস্বতী পুজোর আবহেই আজ চলে গেলেন লতা মঙ্গেশকর। শেষ হল এক ইতিহাসের।