রামকৃষ্ণের আদর্শে হতে চেয়েছিলেন সন্ন্যাসী, আজ অ্যান্টিবায়োটিক ও কেমোথেরাপির জনক
বারবার ছিটকে যেতে চাইতেন সংসারের চিরাচরিত ধারা থেকে। অভাব-দারিদ্র তাঁকে এতটাই নাড়া দিত যে তিনি আধ্যাত্মিক ভাবনায় নিজেকে নিমগ্ন করে দিতে চাইতেন। তাই কখনও পালিয়ে চলে আসতেন বারাণসীর ঘাটে তীর্থযাত্রীদের কলা বিক্রি করতে। আবার কখনও হাজির হতেন রামকৃষ্ণ মিশনের সন্যাসীদের ছত্রছায়া। সংসারকে বিদায় জানিয়ে শুরু করতে চাইতেন সন্ন্যাস জীবন। কিন্তু জীবন বোধহয় ইয়াল্লাপ্রজ্ঞাড়া সুব্বারাও-এর জন্য আলাদা কোনও কাহিনি লিখতে চেয়েছিল। দিতে চেয়েছিল এক ডেস্টিনি। তাই শতবাধা পেরিয়েও আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের ওষুধের দ্বারা চিকিৎসায় এক প্রাণপুরুষ হয়ে রয়েছেন তিনি। তাঁর ফেলে যাওয়া গবেষণায় আজ বিশ্বজুড়ে তৈরি হচ্ছে অত্যাধুনিক সব ওষুধ। এমনকী, করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কারেও হয়তো পথপ্রদর্শক হয়ে উঠতে পারে তাঁর গবেষণা। কিন্তু এহেন ভারতীয় সুব্বারাও-এর কথা ক'জন স্মরণে রেখেছেন এই সময়ে।
- FB
- TW
- Linkdin
সালটা ১৯৫০। এক বিখ্যাত মার্কিনি বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ডোরোন কে অ্যান্ট্রিম লিখলেন- আপনারা সম্ভবত কেউই ইয়াল্লাপ্রজ্ঞাড়া সুব্বারাও-এর নাম শোনেনি। তথাপি তিনি বেঁচেছিলেন বলেই আজ আমরা বেঁচে আছি এবং ভালো আছি। তিনি বেঁচেছিলেন বলেই হয়তো আপনি আরও বেশিদিন বেঁচে থাকবেন।--- সুব্বারাও-কে নিয়ে এই উক্তি আজ মিথে পরিণত হয়েছে।
কে এই ইয়াল্লাপ্রজ্ঞাড়া সুব্বারাও? অধিকাংশ মানুষ-ই জানেনন না এর কথা। যারা জানতেন তাদের অনেকেও আজ ভুলে গিয়েছেন সুব্বারাও-এর কথা। গত কয়েক মাস ধরে বারবার আলোচনায় উঠে আসছে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সঠিক ওষুধ আবিষ্কারের কথা। কিন্তু, অনেকেরই জানা নেই এই ওষুধ আবিষ্কারে পথ প্রদর্শক হয়ে উঠতে পারে সুব্বারাও-এর করে যাওয়া গবেষণা। কারণ, সুব্বারাও যেভাবে শরীরের কর্মপ্রক্রিয়া থেকে শুরু করে শীরা-উপশীরার কর্মপ্রণালি-কে ব্যাখ্যা করে একের পর এক আবিষ্কার করেছিলেন তাতে চিকিৎসাবিজ্ঞান পেয়েছিল এক নয়া দিশা। মানুষের শরীরের ভিতরের অনেক অজানা কাহিনিকে বিশ্বের সামনে উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন সুব্বারাও। আর পরবর্তীকালে সেই সব সূত্র-কে সামনে নিয়ে এগিয়ে গিয়েছে নিত্য-নতুন ওষুধের আবিষ্কার।
কী করেননি সুব্বারাও! তিনি প্রথম খুঁজে বের করেছিলেন শরীরে মধ্যে শক্তির উৎসকথা। দেখিয়েছিলেন কীভাবে খাদ্যগ্রহণের মাধ্যমে শক্তি সঞ্চয় করে এটিপি বা অ্যাডেনাসাইন ট্রাইপোসফাটে। সুব্বারাও-এর এই আবিষ্কারের আগে এটিপি-র অস্তিত্ব নিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানে কোনও ধারণাই ছিল না। এটিপি-র আবিষ্কার মানুষের শরীরে কোনও ওষুধ-কে কীভাবে কাজে লাগাবে সেই ধারণা-কে অনেকটাই পরিষ্কার করে দিয়েছিল।
এই এটিপি আবিষ্কারের হাত ধরেই সুব্বারাও একে একে অবিষ্কার করেছিলেন বায়োকেমিস্ট্রি পদ্ধতিতে তৈরি অ্যান্টিবায়োটিক, যা চিকিৎসাবিজ্ঞানে এক যুগান্তকারী গবেষণা বলে ধরা হয়। কারণ, এর আগে আলেকজান্ডার ফ্লেমিং পেনিসিলিন থেকে অ্যান্টিবায়োটিক তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার করলেও তা মানব শরীরে রেজিটান্সে পরিণত হয়েছিল। ফলে, নতুন কোনও অ্যান্টিবায়োটিক অবিষ্কারের দরকার ছিল। যা মানবদেহ-কে সবধরনের রোগের হাত থেকে রক্ষা করবে। আর সেই যুগান্তকারী আবিষ্কার ঘটেছিল ইয়াল্লাপ্রজ্ঞাড়া সুব্বারাও-এর নেতৃত্বে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন সরকারের মদতে তৈরি হয়েছিল এক বিশাল গবেষণা বাহিনী। যার মাথায় ছিলেন সুব্বারাও। তাঁর নির্দেশে মার্কিন সেনারা যেখানে যেখানে যুদ্ধ করতে যেতেন- সেখান থেকে মাটি সংগ্রহ করে নিয়ে আসতেন। এরপর বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পাওয়া মাটি নিয়ে চলত বিশ্লেষণ। খুঁজে বের করা হত সেই সব সংক্রমণকে যা যুদ্ধক্ষেত্রে এক জখম সৈনিকের দেহের মধ্যে দিয়ে শরীরের ভিতরে প্রবেশ করে তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিত। এভাবেই ,সুব্বারাও আবিষ্কার করে ফেলেন চিকিৎসাবিজ্ঞানে-র প্রথম বায়েকেমিস্ট্রি পদ্ধতিতে তৈরি অ্যান্টিবোয়াটিক- টেট্রাসাইক্লিন ও ক্লোরটেট্রাসাইক্লিন।
অ্যানিমিয়া রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও এক যুগান্তকারী গবেষণা করেছিলেন সুব্বারাও। ১৯৪৫ সালে তিনি ফলিক অ্যাসিডের সিন্থেসিস প্রক্রিয়া এবং আইসোলেশন-কে আবিষ্কার করেন। এর ফলে অ্যানিমিয়ার চিকিৎসা আরও সহজ হয়ে গিয়েছিল। সেই সঙ্গে রক্তের সঙ্গে সম্পর্কৃত আরও কিছু রোগের চিকিৎসাও সম্ভব হয়েছিল সুব্বারাও-এর এই আবিষ্কারে।
এর দুই বছর পরে সুব্বারাও-এর আরও এক আবিষ্কার যা ফিলারিয়াসিস এবং এলিফ্যান্টিয়াসিস-এর চিকিৎসা-কে সহজ ও ফলদায়ক করে তোলে।
১৯৪৮ সালে অ্যামিনোপ্টেরেইন নামে এক যৌগের আবিষ্কার করেন, যার দ্বার ক্যানসারের চিকিৎসা থেকে শুরু করে শৈশবাস্থার লিউকোমিয়া-র চিকিৎসা করার অস্ত্র হাতে পান চিকিৎসকরা।
এহেন সুব্বারাও-এর জীবনটা এতটা সহজ ছিল না। অন্ধ্রপ্রদেশের ভিমাভরমে ১৮৯৫ সালের ১২ জানুয়ারি জন্মেছিলেন। মোট ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয় সন্তান। তাঁরা তিন ভাই এবং তিন বোম ছিলেন। সুব্বারাও-এর বাবা জগন্নাথ ছিলেন রেভেনিউ অফিসার। কিন্তু, অসুস্থতার কারণে তিনি অল্প-বয়সেই চাকরি থেকে অবসর নিয়ে নেন। স্বভাবতই ছোট থেকেই নিদারুণ অভাব এবং আর্থিক কষ্ঠকে মাথায় নিয়ে বড় হয়েছিলেন সুব্বারাও।
আর্থিক অনটনে পরিস্থিতি এতটাই চরমে ওঠে যে মেধাবী ছাত্র সুব্বারাও বাড়ি থেকে পালিয়ে হাজির হন বারাণসীর গঙ্গার ঘাটে। পরিকল্পনা করেছিলেন সেখানে তীর্থযাত্রীদের কলা বেচবেন এবং সেই অর্থ বাড়িতে পাঠাবেন।
কিন্তু, কোনওভাবে নিখোঁজ সুব্বারাও-এর খোঁজ মেলে বারাণসীতে। মা ভেঙ্কাম্মা গিয়ে বছর আটের ছেলেকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনেন। এবং ছেলে-র কাছে প্রতিশ্রুতি আদায় করেন যে আর সে কোনওদিন পালিয়ে যাবে না। পড়াশোনায় মন দেবে। ছেলের পড়াশোনার খরচ জোগাতে ভেঙ্কাম্মা তাঁর সমস্ত গয়না বন্ধকও দিয়ে দিয়েছিলেন।
এই ঘটনার পাঁচ বছরের মাথায় সুব্বারাও-এর অসুস্থ বাবা জগন্নাথ প্রয়াত হন। অঙ্কে তুখোড় ছিলেন সুব্বারাও। তবু তিনি পুঁথিগত বিদ্যায় তেমন পারদর্শী ছিলেন না। যার জন্য তিনবারের চেষ্টায় ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। এরপর মাদ্রাজ অধুনা চেন্নাই-এর হিন্দু হাইস্কুল থেকে হাইস্কুল পাসের ডিগ্রি লাভ করেন। চেন্নাই-এর প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে তিনি ইন্টারমিডিয়েট ও পাস করেছিলেন।
এই সময় তিনি রামকৃষ্ণ মিশন চেন্নাইয়ের সংস্পর্শে আসেন এবং আধ্যাত্মিক দর্শনে প্রভাবিত হন। সংসার ছেড়ে রামকৃষ্ণ পরমহংসের দর্শনে জীবনকে চালিত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে সন্নাসী হতে চেয়েছিলেন সুব্বারাও। কিন্তু, রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজ জানান, মা-এর অনুমতি ব্যতিরেক তাঁরা সুব্বারাওকে সন্নাসী হিসাবে বরণ করবেন না। মা ভেঙ্কাম্মা-র কাছ থেকে এই অনুমতি বের করাটা সুব্বারাও-এর কাছে কার্যত অসাধ্য ছিল।
মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে চেয়েছিলেন সুব্বারাও। তাই, চিকিৎসকরে ডিগ্রি অর্জনের লক্ষে ১৯১৫ সালে তিনি মাদ্রাজ মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। এই সময় দেশজুড়ে স্বদেশী আন্দোলন শুরু হয়। গান্ধীজির দর্শনে অনুপ্রাণিত হয়ে পড়েন সুব্বারাও।
চিকিৎশাাস্ত্র নিয়ে পাঠরত পড়ুয়াদের ল্যাবে যাওয়ার জন্য অ্যাপ্রন পরতে হত। আর এই অ্যাপ্রন আসত বিলেত থেকে। সুব্বারাও স্বদেশী ভাবধারায় বিলাতী অ্যাপ্রন ত্যাগ করেন। তিনি খাদি দিয়ে তৈরি অ্যাপ্রন পরতে শুরু করেন। এতে ডাক্তারি কলেজের ইংরেজ সাহেবরা চটে যায়।
শাস্তি হিসাবে সুব্বারাও-কে কোর্স শেষে এমবিবিএস ডিগ্রি দেওয়া হয় না। তাঁকে এলএম ডিগ্রি দেওয়া হয়। এতে তিনি বড়়জোর কমপাউন্ডারগিরি করতে পারতেন।
১৯২১ সালে দেশে ট্রপিক্যাল স্পর বলে একটি ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে। এতে মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন সুব্বারাও। এই ভাইরাসের সংক্রমণে খিদের ইচ্ছে চলে যাওয়া থেকে বদহজম এবং অ্যামিনিয়ার মতো রোগের প্রাদুর্ভাব হতে থাকে। সংক্রমণে সুব্বারাও-এর দুই ভাইর মারা যায়। কোনওভাবে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় প্রাণে বাঁচেন সুব্বারাও।
এরপর পরই মাদ্রাজ আয়ুর্বেদিক কলেজে লেকচার হিসাবে চাকরি পান সুব্বারাও। কিন্তু, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি-র ট্রপিক্যাল মেডিসিন-এর ডিন রিচার্ড স্ট্রং তাঁকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে বলেন।
১৯২৩ সালে আমেরিকার উদ্দেশে পাড়ি জমান সুব্বারাও। এর জন্য তাঁর শ্বশুরমশায় তাঁকে অর্থ দান করেছিলেন। এছাড়াও একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তাঁকে অর্থ প্রদান করে। এরপরও জাহাজে কেবিন বুক করার মতো অর্থ সুব্বারাও-এর কাছে ছিল না। ফলে, জাহাজের ডেকে বসেই তিনি আমেরিকা রওনা হন। দেশে পড়ে থাকে তাঁর অন্তঃস্বত্বা স্ত্রী। যাঁদের তিনি আর কোনওদিনই দেখতে পাননি।
আমেরিকায় পৌঁছে অর্থসংস্থানের জন্য একটা সময় রোগীদের বেডপ্যান ধোয়ারও কাজ করেছিলেন সুব্বারাও। ইতিমধ্য়ে তাঁর সদ্যোজাত ছেলেরও মৃত্যু হয়। যে সন্তানকে তিনি কোনওদিন-ই চোখের দেখা দেখতে পাননি, তার মৃত্যুর খবর আমেরিকায় বসে পেয়েছিলেন। ট্রপিক্যাল মেডিসিনে আমেরিকায় ডিপ্লোমা লাভের পর ১৯৩০ সালে তিনি হার্ভাড মেডিক্যাল কলেজে পিএইচডি করার সুযোগ পান।